শুক্রবার ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


রমনা কালীমন্দিরে সস্ত্রীক ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ।

পাক সেনারা রমনা ত্যাগ করার আগে বলে যায়, যাদের বাঁচিয়ে রাখা হল, তারা যেন পরদিনই ভারতে চলে যায়৷ এক ভয়ংকর শোকবিহ্বল পরিবেশে রাত কাটানোর পর সব হারানোর বেদনায় মুহ্যমান মন্দির ও আশ্রমবাসীরা রমনা ত্যাগ করে ভোরবেলায় নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন৷ পিছনে রেখে যান রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রমের ধ্বংসস্তূপ আর শহিদ আপনজনদের লাশের দগ্ধাবশেষ অথবা ছাই-ভস্ম৷ যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের উষালগ্নে দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিলেন, তাঁদের শোকে-দুঃখে পাথর জনাকয়েক বেঁচে যাওয়া মানুষ আতঙ্কে সেদিন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠতেও পারেননি৷
২৮ মার্চ ভোরে স্বামী পরমানন্দ গিরির বিধবা পত্নী শ্রীমতী সুচেতা গিরি, মা আনন্দময়ী আশ্রমের সন্ন্যাসিনী জটালি মা সহ জনাকয়েক বেঁচে থাকা মানুষ রমনা এলাকা ত্যাগ করেন৷ সুচেতা গিরিকে একসময় ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়৷ ভাঙা কুঁড়েঘরে বসবাস করতেন৷ পাকিস্তানিদের হাতে লাঞ্ছিত ও আহত বেশ কয়েকজন এখনও বেঁচে আছেন৷ তদন্ত কমিশনের কাছে কয়েকজনের জবানবন্দির কিছু কিছু এখানে উল্লেখ করলাম—

রমনা কালীমন্দির ও আনন্দময়ী আশ্রমে সেই সময়ে বসবাস করতেন শ্রীমতী কমলা রায়৷ তিনি কমিশনকে সজল চোখে বলেন, পুরুষ ও মহিলাদের আলাদা আলাদা লাইনে দাঁড় করানোর পর পুরুষদের গুলি করলে তাঁরা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন৷ অনেকে আধমরা অবস্থায় ‘পানি পানি’ (বাংলাদেশের হিন্দুরাও জলকে পানি বলেন) বলে গোঙাতে থাকেন৷

পাকিস্তানি বাহিনী মৃত ও অর্ধমৃতদের জড়ো করে ও ঘরের বাঁশের বেড়া ভেঙে তাঁদের ওপর ফেলে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়৷ কয়েকটি শিশু ভয়ে চিৎকার করে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছিল দেখে পাকিস্তানি সেনারা ওদেরও আগুনে ছুড়ে ফেলে পুড়িয়ে মারে৷ হায়, মানুষ এত নিষ্ঠুরও হতে পারে! পৈশাচিক আনন্দে এভাবে মেতে ওঠে!

আর এক বাসিন্দা শংকরলাল ঘোষ বলেন, রমনা কালীমন্দিরের পুরোহিত স্বামী পরমানন্দ গিরিকে পাকিস্তানিরা জিজ্ঞাসা করে, তিনি হিন্দু না মুসলমান৷ স্বামী পরমানন্দ হিন্দু ও এই মন্দিরের পুরোহিত বলে নিজের পরিচয় দেওয়ার পরই মৃত্যুবরণ করেন৷ স্ত্রীহারা রঘুবীর চৌহান বলেছেন, আমার ঘরে ওই হানাদার বাহিনী আগুন লাগিয়ে দিলে আমি ও আমার ছেলে পিছনদিক দিয়ে পালিয়ে গেলেও আমার স্ত্রী বেরোতে পারেনি৷ ও আগুনে পুড়ে মারা যায়৷

স্বামীহারা গেনিয়া দাস কাঁদতে কাঁদতে কমিশনকে বলেন, আমার স্বামী রঘুলাল দাসকে ধরে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানি সেনারা লাইনে দাঁড় করাল৷ ওরা আমার স্বামীকে জিজ্ঞাসা করল—তুমি কী খাবে? উনি সিগারেট খেতে চাইলে দেওয়া হয়৷ সিগারেট শেষ হওয়ার পর ওঁকে গুলি করে মারা হল৷

পিতৃহারা লক্ষ্মীরানি ঠাকুর জানান, ২৫ মার্চ রাতে তার বাবা কিশোরী ঠাকুর তাকে দেখতে এসেছিলেন৷ কিশোরীবাবুর বাড়ি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়৷ তিনি লক্ষ্মীরানির বিয়ে দেন ঢাকায়৷ স্বামীর সঙ্গে লক্ষ্মী মন্দিরেই থাকতেন৷ ২৭ মার্চ পাকিস্তানিরা কিশোরীবাবুকে ঘর থেকে ধরে নিয়ে এসে লাইনে দাঁড় করায়৷ গুলি করে হত্যা করে৷ পরে তাঁর লাশ আগুনে ফেলে দেওয়া হয়৷

দৈনিক ইত্তেফাক কাগজের সহ-সম্পাদক আহসানউল্লাহ গণতদন্ত কমিশনে দেওয়া সাক্ষ্যে বলেছেন, ‘রমনার ওই ধ্বংসযজ্ঞের তিনদিন পর আমি সেখানে গিয়ে আগুনে পুড়ে যাওয়া মানুষের স্তূপীকৃত কঙ্কালের পাশাপাশি প্রায় ১৪টির মতো বিকৃত লাশ দেখতে পাই৷ সেগুলো ফুলে পচা গন্ধ বেরিয়েছিল৷ ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দির ও আশ্রমের ভেতরেও আরও ১০টির মতো গলিত লাশ দেখতে পাই৷’

রমনা কালীমন্দিরের অদূরে শাহবাগ জামে মসজিদের খাদেম প্রত্যক্ষদর্শী আবদুল আলি ফকির বলেছেন, ‘রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হামলা শুরু করার পর সবাইকে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ও ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ (আল্লাই একমাত্র উপাস্য) বলতে বলে৷ লাইনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো পুরুষ-মহিলা সবাই তা সমস্বরে উচ্চারণ করেন৷ এরপরই গুলি করা হয়৷’

২৭ মার্চের ধ্বংসযজ্ঞের পর পোড়া রমনা কালীমন্দির তবুও দাঁড়িয়েছিল৷ কিন্তু পাক বাহিনীর তা সহ্য হয়নি৷ এপ্রিল মাসের শেষাশেষি তারা মন্দিরটি ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়৷ মন্দির এলাকায় অনেক দামি গাছ ছিল৷ সেগুলোও কেটে ফেলে৷ তারা নানাভাবে চেষ্টা করেছে রমনা কালীমন্দিরের সমস্ত চিহ্ন মুছে ফেলতে৷

এদিকে রমনার ঐতিহাসিক শ্রীশ্রীকালীমন্দির ও মা আনন্দময়ীর আশ্রম ধ্বংসের পর নেপালের রাজা প্রয়াত বীরেন্দ্র তীব্র ক্ষোভপ্রকাশ করেন তৎকালীন পাকিস্তানের সেনাশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে৷ উত্তরে জেনারেল ইয়াহিয়া দুঃখপ্রকাশ করে নেপালের রাজাকে জানান যে, এটা অনিচ্ছাকৃত একটা ঘটনা৷ এই মন্দির নতুন করে নির্মাণের জন্য ৫ লক্ষ টাকা ব্যয়বরাদ্দ করা হয়েছে৷ কিন্তু তা যে শুধু কথার কথা তা বলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না৷

স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ হওয়ার পর ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি তৎকালীন সরকারের গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তারা শ্রমিক দিয়ে বুলডোজার চালিয়ে মন্দির ও আশ্রমের ভগ্নাবশেষ নিশ্চিহ্ন করে দেয়৷ মন্দির ও আশ্রমবাসী যাঁরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হামলার পর কোনওক্রমে প্রাণে বেঁচে পালিয়ে গিয়ে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁরা স্বাধীনতার পরপরই এখানে ফিরে আসেন৷ অস্থায়ী মন্দির গড়ে আবার পুজো-অর্চনা শুরু করেন৷ ছোটখাট ঘরবাড়ি তৈরি করে বসবাসের উদ্যোগ নেন৷

সেইসময় রমনার অদূরে শাহবাগ জামে মসজিদের খাদেম ও রমনা কালীমন্দিরের নিহত পূজারি স্বামী পরমানন্দের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবদুল আলি ফকিরও চেয়েছিলেন মন্দির ও আশ্রম পুনর্নির্মিত হোক৷ তিনি মন্দির ও আশ্রমের ভক্ত-শিষ্য এবং অন্য বাসিন্দাদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে মন্দির ও আশ্রম নির্মাণের জন্য এক স্মারকলিপি দেন৷ তাঁদের সঙ্গে ছিলেন সুচেতা গিরি ও জটালি মা৷

অদ্ভুত ব্যাপার, এরপর শহিদ পরিবারের সদস্যদের একপ্রকার জোর করেই পাঠিয়ে দেওয়া হল পোস্তগোলার শ্মশান সংলগ্ন বালুর মাঠে৷ তবে তাঁদের দয়া করে কিছু কিছু তাঁবু সরবরাহ করা হয়েছিল৷ তাঁদের জন্য রেশনেরও ব্যবস্থা করা হয়৷ তবে এসব লোকদেখানো ব্যাপার কি না কে জানে!

এরপর তাঁদের ওপর আরও দুর্গতি নেমে আসে৷ জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর পুলিশ তাঁদের বন্দুকের মুখে সেখান থেকে উৎখাত করে৷ তাঁদের ভারতে চলে যাওয়ার জন্য বলা হয়৷ তখন আশ্রম ও মন্দিরবাসীরা এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়েন৷ সুচেতা গিরিসহ অনেকেই ভারতে চলে যান৷ তারপর জটালি মা-ও মারা যান৷ একদা আইন-আদালতে জড়িয়ে যায় রমনা কালীমন্দির৷ ১৯৮৪ সালে মন্দির ও আশ্রম ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে ঢাকার দেওয়ানি আদালতে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল৷ —চলবে

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

সৌজন্যে দীপ প্রকাশন

Skip to content