রমনা কালীমন্দিররের এই ছবিটি ১৯৬৭ সালের আগে তোলা
এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, একসময় বাঙালি জাতির ঐতিহাসিক সংগ্রামের সঙ্গে রমনা কালীমন্দিরের নিবিড় সম্পর্ক ছিল৷ বঙ্গভূমির স্বাধীনতা রক্ষার জন্য ইশা খাঁ সহ বারো ভুঁইয়ার অনেকেই রাজা মানসিংহের সঙ্গে যুদ্ধের আগে সমবেত হয়েছিলেন রমনা মন্দিরে৷ তাঁরা নিজেদের আঙুল কেটে রক্ত দিয়ে মা কালীর সামনে শপথ নেন যে, বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়বেন৷ ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রেও এই মন্দিরের ভূমিকা কম নয়৷ সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সময় বহু সন্ন্যাসী এখানে সমবেত হয়ে বিদ্রোহের বিভিন্ন কৌশল নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছেন৷ এমনকী তাঁরা এখানে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণও নিয়েছেন৷
পাকিস্তানি শাসনের সময় স্বাধীনতাকামী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এই মন্দির এলাকায় প্রচুর সভা-সমাবেশ করেছে৷ জাতীয় নেতারা সেইসব সমাবেশ থেকেই আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন৷ এমনকী শেখ মুজিবর রহমানও রমনা কালীমন্দিরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন৷ রেসকোর্স ময়দানের সেই বিশাল সমাবেশের আগে তিনি রমনা কালীমন্দিরের পূজারি অধ্যক্ষ পরমানন্দ গিরির কাছে লিখিত অনুমতি চাইলেন৷ লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশ হলে মন্দিরের হয়তো কোনও অসুবিধা হতে পারে৷ পরমানন্দ গিরি সাগ্রহে অনুমতি দেন৷
এখানেই কিন্তু রমনা কালীমন্দিরের ভূমিকার শেষ নয়৷ এই মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে বাংলাদেশের মহান বিজয় ১৬ ডিসেম্বরের মধুর স্মৃতি৷ কারণ, রমনা মন্দিরের পাশেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজির নেতৃত্বে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছিল৷ অত্যাচারীদের উপযুক্ত শাস্তি! রমনার জাগ্রত দেবী ভদ্রকালীর ইচ্ছা বোধহয় এরকম ছিল৷ যে মন্দিরটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে ও মন্দিরে আশ্রয় নেওয়া প্রায় শ’দেড়েক হিন্দু নর-নারীকে হত্যা করতে পাকিস্তানি সেনাদের হাত কাঁপেনি, তাদের পেশিশক্তির ঠুনকো অহংকারকে একেবারে গুঁড়িয়ে দিতে মন্দির সংলগ্ণ জায়গাটিই যে সবথেকে মানানসই ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷
একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করা যায়৷ মুক্তিযুদ্ধের সূচনা লগ্নেই এই পবিত্র মন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম ধ্বংস করলেও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কিন্তু ঢাকেশ্বরী মন্দির পুরোপুরি বিনষ্ট করেনি৷
কেন এই বিপরীত আচরণ? এর পিছনে কোনও গূঢ় কারণ? বিষয়টি নিয়েও যথাসময়ে আলোচনা করব৷
১৯৭১ সালের ২৬ ও ২৭ মার্চ৷ এই দুটো দিন রমনা কালীমন্দিরের পবিত্র ভূমি ঘিরে যে বিভীষিকার রাজত্ব তৈরি হয় তার তুলনা বিশেষ মেলে না৷ এক তীর্থভূমি রাতারাতি পরিণত হয়েছিল বধ্যভূমিতে৷ এবার সেই করুণ কাহিনি শুনুন৷
২৫ মার্চ গভীর রাত৷ পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল৷ ঢাকার রাজপথে ভারী বুটের আওয়াজ৷ গোলাগুলির একটানা শব্দ৷ মিলিটারি ট্রাকের কনভয়৷ ট্যাঙ্কের ঘর্ঘর শব্দ৷ সেইসঙ্গে প্রবল জন কোলাহল ও অগণিত মরণাপন্ন মানুষের ‘বাঁচাও…বাঁচাও…’ আর্তনাদ৷ সব মিলিয়ে এক ভয়াবহ পরিবেশ৷
২৬ মার্চ সকাল ১১টা নাগাদ পাকিস্তানি সেনারা রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে৷ তারা মন্দির ও আশ্রম থেকে লোকজনদের বের না হতে বলে যায়৷
মন্দিরের লোকজন পাকিস্তানি সেনাদের বিশ্বাস করে বিরাট ভুল করেছিল৷ এই সময় ওই সেনাদলের সঙ্গে মুসলিম লিগের এক নেতা খাজা খায়েবউদ্দিনকে দেখা যায়৷ ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে পুরনো ঢাকা থেকে দাঁড়িয়ে পরাজিত হয় এই প্রার্থী৷ ২৭ মার্চ গভীর রাতে রমনা কালীমন্দির ও আনন্দময়ী আশ্রমের হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ প্রধানত তারই পরামর্শে হয়েছিল৷
পাকিস্তানি বাহিনী তাদের সহযোগীদের নিয়ে ২৭ মার্চ গভীর রাতে সান্ধ্য আইন চলাকালীন রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম ঘেরাও করে৷ সেনাবাহিনী সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল সার্চলাইট৷ এই সার্চলাইটের তীব্র আলোয় গোটা রমনা এলাকা আলোকিত হয়ে যায়৷ অন্ধকারে কেউ পালাতে না পারে৷ এরই মধ্যে শুরু হয় গোলাবর্ষণ৷ রমনা কালীমন্দিরে ঢুকে পাকিস্তানিরা কালীমূর্তির দিকে এক ধরনের বিস্ফোরক ছুড়ে দেয়৷ অবশ্য কারও কারও মতে সাধারণ কোনও বিস্ফোরক নয়, গোলাবর্ষণই করা হয়৷ ফলে মূর্তিসহ মন্দিরের পিছনের অংশ সঙ্গে সঙ্গে উড়ে যায়৷ পরে পুরো মন্দির ও আশ্রম ধ্বংস করে৷
মন্দির ও আশ্রম এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ঘাতকরা ঢোকার সময় সেখানে বসবাসরত অনেকেই ঘুমিয়েছিলেন৷ কেউ কেউ উৎকণ্ঠায় জেগেছিলেন৷ কয়েকটি পরিবার তখন খাওয়া-দাওয়া করছিল৷ এই সময় আচমকা ঘাতক বাহিনী হানা দিলে লোকজন প্রাণভয়ে দৌড়োদৌড়ি শুরু করে৷ আতঙ্কিত সকলেই ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিতে থাকে৷ মেয়েরা শাঁখা খুলে ফেলেন৷ কপালের সিঁদুরও মুছে ফেলেন৷ মন্দির ও আশ্রমের বিভিন্ন স্থানে অনেকেই প্রাণভয়ে লুকিয়ে পড়ে৷ পাক-সেনারা বন্দুকের মুখে তাদের খুঁজে বের করে৷ তারপর মন্দিরের সামনে এনে দাঁড় করায়৷
পুরুষদের এক লাইনে এবং মহিলা ও শিশুদের অন্য লাইনে দাঁড় করানো হয়৷ এরপর সেনাবেশী ওই দুর্বৃত্তরা তাদের সামনে গিয়ে বলে—‘তুম লোগ আওয়ামি লিগ করতা হ্যায়? শেখ মুজিবকো ভোট দিয়া? তুম লোগো কো হিন্দুস্থান ভেজ দেগা৷’
ঠিক এরকম এক মানসিকতার বশবর্তী হয়েই কিন্তু হানাদার বাহিনী প্রথমেই রমনা কালীমন্দির ও আনন্দময়ী মায়ের আশ্রম ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করে৷ প্রথমত, যে অঞ্চল থেকে শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতার ডাক দিলেন সেই জায়গাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা৷ দ্বিতীয়ত, সু-প্রাচীন এক হিন্দু তীর্থকে বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে চিরতরে মুছে ফেলা৷
হানাদার বাহিনীর হুমকির সামনে মাথা নত করেননি রমনা কালীমন্দিরের অধ্যক্ষ স্বামী পরমানন্দ গিরি৷ তিনি বলেন, ‘এরা সবাই নিরীহ লোক৷ এদের ছেড়ে দাও৷ মারতে হলে আমাকে মারো৷’ কিন্তু বর্বর খুনিদের এ সমস্ত কথা শোনার মতো ধৈর্য ছিল না৷ তারা নরখাদক পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে মন্দিরের নিরীহ মানুষদের ওপর৷
পাকিস্তানি সেনারা সকলের সামনে রমনা কালীমন্দিরের অধ্যক্ষ স্বামী পরমানন্দ গিরিকে কলমা পড়তে বাধ্য করে ও তারপরেই তাঁর পেট বেয়নেট দিয়ে চিরে ফেলে৷ তাঁকে খুন করার পর অনেককে কলমা পড়িয়ে হত্যা করা হয়৷ পাকিস্তানি খুনিরা উল্লাসধ্বনি করে বলতে থাকে—নৌকায় ভোট দেওয়ার মজা বোঝো এবার৷ এরপর লাইনে দাঁড়ানো সকলকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয়৷
গণতদন্ত কমিশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসটি) ক্যাফেটেরিয়া সংলগ্ন শিক্ষক লাউঞ্জে ২০০০ সালের ১৩ এপ্রিল থেকে প্রায় ছয় মাস ধরে রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রমের নারকীয় গণহত্যাযজ্ঞে অনেকেরই বক্তব্য ও সাক্ষ্যগ্রহণ করে৷ তাঁদের মধ্যে ছিলেন শহিদ পরিবারের সদস্য, আহত ব্যক্তিবর্গ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা৷
ওই সাক্ষ্য বিবরণে জানা যায় যে, ব্রাশ ফায়ারে প্রায় ১০০ জন সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়৷ ভয়াল এই দৃশ্য দেখে মহিলাদের আর্ত চিৎকার আরম্ভ হলে তাঁদের বন্দুক দিয়ে নির্বিচারে পেটানো হয়৷ তাতে অনেকেই অজ্ঞান হয়ে যান৷ একবার অত্যাচারের মাত্রা বুঝুন! এরপর পাকিস্তানি ঘাতকরা মৃত ও অর্ধমৃত দেহগুলো জড়ো করে পেট্রোল ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়৷ আহতদের অনেকে আগুনে পুড়ে মারা যান৷
সাক্ষ্যে কয়েকজন মহিলা ও শিশুর পুড়ে মারা যাওয়ার কথা বলা হয়েছে৷ পাক সেনারা লুকিয়ে থাকা দু’জন যুবককে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে আসে৷ তাদের ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি দিতে বাধ্য করে৷ তারপর তাদের মুখের ভেতর গুলি করে তাদের হত্যা করে৷ এই হত্যাযজ্ঞের সময় রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছিল৷
ঢাকায় অবস্থানকালে মা আনন্দময়ীর ভক্তরা রমনার পাশাপাশি শ্রীসিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়িতেও মায়ের জন্য একটি আশ্রম করে দিয়েছিলেন৷ রমনায় মা আনন্দময়ী আশ্রমের প্রবেশদ্বার ছিল পূর্বদিকে৷ পশ্চিমদিকে একটি নাটমন্দির ছিল৷ তার উত্তরদিকে ছোট একটি ইটের কোঠায় মা আনন্দময়ীর পাদপদ্ম সংরক্ষিত ছিল৷
কোঠা সংলগ্ন আশ্রম মন্দিরের বেদির ওপর বিষ্ণু ও মা অন্নপূর্ণা বিগ্রহ স্থাপিত ছিল৷ বেদির নীচে অন্য এক কালীমূর্তির আলোকচিত্র দেখা যেত৷ এই আলোকচিত্র যে মূর্তির তা বেদির নীচে এক গহ্বরে স্থাপিত ছিল৷ বছরে মাত্র একবার মা আনন্দময়ীর জন্মোৎসবের সময় ওই মূর্তি বের করা হত৷ অন্য সময় তা গহ্বরের অভ্যন্তরে থাকত৷ মা আনন্দময়ী থাকতেন উত্তর-পূর্বদিকে একটি চারচালা খড়ের ঘরে৷
আশ্রম ও মন্দিরের গোয়ালে প্রায় ৫০টির মতো গোরু ছিল৷ গোরুগুলোকেও পুড়িয়ে মারা হয়৷ ভয়াবহ আগুন, গোলাগুলি, মাংসপোড়া গন্ধ ও ভয়ার্ত চিৎকারে গোটা রমনা এলাকায় এক নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়৷ সারারাত ধরে চলে পাকিস্তানি সেনাদের হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলা৷ তারা রমনা অপারেশন শেষ করে ভোর চারটার দিকে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার সময় লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখা মহিলাদের মধ্য থেকে বেশ কয়েকজন যুবতী মেয়েকে ধরে নিয়ে যায়৷ যাঁদের আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি৷ এঁদের সংখ্যা কম করেও বারো-চোদ্দোজন বলে সাক্ষ্যদাতাদের কয়েকজন জানিয়েছেন৷ —চলবে
সৌজন্যে দীপ প্রকাশন
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।
পাকিস্তানি শাসনের সময় স্বাধীনতাকামী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এই মন্দির এলাকায় প্রচুর সভা-সমাবেশ করেছে৷ জাতীয় নেতারা সেইসব সমাবেশ থেকেই আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন৷ এমনকী শেখ মুজিবর রহমানও রমনা কালীমন্দিরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন৷ রেসকোর্স ময়দানের সেই বিশাল সমাবেশের আগে তিনি রমনা কালীমন্দিরের পূজারি অধ্যক্ষ পরমানন্দ গিরির কাছে লিখিত অনুমতি চাইলেন৷ লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশ হলে মন্দিরের হয়তো কোনও অসুবিধা হতে পারে৷ পরমানন্দ গিরি সাগ্রহে অনুমতি দেন৷
এখানেই কিন্তু রমনা কালীমন্দিরের ভূমিকার শেষ নয়৷ এই মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে বাংলাদেশের মহান বিজয় ১৬ ডিসেম্বরের মধুর স্মৃতি৷ কারণ, রমনা মন্দিরের পাশেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজির নেতৃত্বে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছিল৷ অত্যাচারীদের উপযুক্ত শাস্তি! রমনার জাগ্রত দেবী ভদ্রকালীর ইচ্ছা বোধহয় এরকম ছিল৷ যে মন্দিরটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে ও মন্দিরে আশ্রয় নেওয়া প্রায় শ’দেড়েক হিন্দু নর-নারীকে হত্যা করতে পাকিস্তানি সেনাদের হাত কাঁপেনি, তাদের পেশিশক্তির ঠুনকো অহংকারকে একেবারে গুঁড়িয়ে দিতে মন্দির সংলগ্ণ জায়গাটিই যে সবথেকে মানানসই ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷
একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করা যায়৷ মুক্তিযুদ্ধের সূচনা লগ্নেই এই পবিত্র মন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম ধ্বংস করলেও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কিন্তু ঢাকেশ্বরী মন্দির পুরোপুরি বিনষ্ট করেনি৷
কেন এই বিপরীত আচরণ? এর পিছনে কোনও গূঢ় কারণ? বিষয়টি নিয়েও যথাসময়ে আলোচনা করব৷
১৯৭১ সালের ২৬ ও ২৭ মার্চ৷ এই দুটো দিন রমনা কালীমন্দিরের পবিত্র ভূমি ঘিরে যে বিভীষিকার রাজত্ব তৈরি হয় তার তুলনা বিশেষ মেলে না৷ এক তীর্থভূমি রাতারাতি পরিণত হয়েছিল বধ্যভূমিতে৷ এবার সেই করুণ কাহিনি শুনুন৷
২৫ মার্চ গভীর রাত৷ পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল৷ ঢাকার রাজপথে ভারী বুটের আওয়াজ৷ গোলাগুলির একটানা শব্দ৷ মিলিটারি ট্রাকের কনভয়৷ ট্যাঙ্কের ঘর্ঘর শব্দ৷ সেইসঙ্গে প্রবল জন কোলাহল ও অগণিত মরণাপন্ন মানুষের ‘বাঁচাও…বাঁচাও…’ আর্তনাদ৷ সব মিলিয়ে এক ভয়াবহ পরিবেশ৷
২৬ মার্চ সকাল ১১টা নাগাদ পাকিস্তানি সেনারা রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে৷ তারা মন্দির ও আশ্রম থেকে লোকজনদের বের না হতে বলে যায়৷
মন্দিরের লোকজন পাকিস্তানি সেনাদের বিশ্বাস করে বিরাট ভুল করেছিল৷ এই সময় ওই সেনাদলের সঙ্গে মুসলিম লিগের এক নেতা খাজা খায়েবউদ্দিনকে দেখা যায়৷ ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে পুরনো ঢাকা থেকে দাঁড়িয়ে পরাজিত হয় এই প্রার্থী৷ ২৭ মার্চ গভীর রাতে রমনা কালীমন্দির ও আনন্দময়ী আশ্রমের হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ প্রধানত তারই পরামর্শে হয়েছিল৷
পাকিস্তানি বাহিনী তাদের সহযোগীদের নিয়ে ২৭ মার্চ গভীর রাতে সান্ধ্য আইন চলাকালীন রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম ঘেরাও করে৷ সেনাবাহিনী সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল সার্চলাইট৷ এই সার্চলাইটের তীব্র আলোয় গোটা রমনা এলাকা আলোকিত হয়ে যায়৷ অন্ধকারে কেউ পালাতে না পারে৷ এরই মধ্যে শুরু হয় গোলাবর্ষণ৷ রমনা কালীমন্দিরে ঢুকে পাকিস্তানিরা কালীমূর্তির দিকে এক ধরনের বিস্ফোরক ছুড়ে দেয়৷ অবশ্য কারও কারও মতে সাধারণ কোনও বিস্ফোরক নয়, গোলাবর্ষণই করা হয়৷ ফলে মূর্তিসহ মন্দিরের পিছনের অংশ সঙ্গে সঙ্গে উড়ে যায়৷ পরে পুরো মন্দির ও আশ্রম ধ্বংস করে৷
মন্দির ও আশ্রম এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ঘাতকরা ঢোকার সময় সেখানে বসবাসরত অনেকেই ঘুমিয়েছিলেন৷ কেউ কেউ উৎকণ্ঠায় জেগেছিলেন৷ কয়েকটি পরিবার তখন খাওয়া-দাওয়া করছিল৷ এই সময় আচমকা ঘাতক বাহিনী হানা দিলে লোকজন প্রাণভয়ে দৌড়োদৌড়ি শুরু করে৷ আতঙ্কিত সকলেই ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিতে থাকে৷ মেয়েরা শাঁখা খুলে ফেলেন৷ কপালের সিঁদুরও মুছে ফেলেন৷ মন্দির ও আশ্রমের বিভিন্ন স্থানে অনেকেই প্রাণভয়ে লুকিয়ে পড়ে৷ পাক-সেনারা বন্দুকের মুখে তাদের খুঁজে বের করে৷ তারপর মন্দিরের সামনে এনে দাঁড় করায়৷
পুরুষদের এক লাইনে এবং মহিলা ও শিশুদের অন্য লাইনে দাঁড় করানো হয়৷ এরপর সেনাবেশী ওই দুর্বৃত্তরা তাদের সামনে গিয়ে বলে—‘তুম লোগ আওয়ামি লিগ করতা হ্যায়? শেখ মুজিবকো ভোট দিয়া? তুম লোগো কো হিন্দুস্থান ভেজ দেগা৷’
ঠিক এরকম এক মানসিকতার বশবর্তী হয়েই কিন্তু হানাদার বাহিনী প্রথমেই রমনা কালীমন্দির ও আনন্দময়ী মায়ের আশ্রম ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করে৷ প্রথমত, যে অঞ্চল থেকে শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতার ডাক দিলেন সেই জায়গাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা৷ দ্বিতীয়ত, সু-প্রাচীন এক হিন্দু তীর্থকে বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে চিরতরে মুছে ফেলা৷
হানাদার বাহিনীর হুমকির সামনে মাথা নত করেননি রমনা কালীমন্দিরের অধ্যক্ষ স্বামী পরমানন্দ গিরি৷ তিনি বলেন, ‘এরা সবাই নিরীহ লোক৷ এদের ছেড়ে দাও৷ মারতে হলে আমাকে মারো৷’ কিন্তু বর্বর খুনিদের এ সমস্ত কথা শোনার মতো ধৈর্য ছিল না৷ তারা নরখাদক পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে মন্দিরের নিরীহ মানুষদের ওপর৷
পাকিস্তানি সেনারা সকলের সামনে রমনা কালীমন্দিরের অধ্যক্ষ স্বামী পরমানন্দ গিরিকে কলমা পড়তে বাধ্য করে ও তারপরেই তাঁর পেট বেয়নেট দিয়ে চিরে ফেলে৷ তাঁকে খুন করার পর অনেককে কলমা পড়িয়ে হত্যা করা হয়৷ পাকিস্তানি খুনিরা উল্লাসধ্বনি করে বলতে থাকে—নৌকায় ভোট দেওয়ার মজা বোঝো এবার৷ এরপর লাইনে দাঁড়ানো সকলকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয়৷
গণতদন্ত কমিশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসটি) ক্যাফেটেরিয়া সংলগ্ন শিক্ষক লাউঞ্জে ২০০০ সালের ১৩ এপ্রিল থেকে প্রায় ছয় মাস ধরে রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রমের নারকীয় গণহত্যাযজ্ঞে অনেকেরই বক্তব্য ও সাক্ষ্যগ্রহণ করে৷ তাঁদের মধ্যে ছিলেন শহিদ পরিবারের সদস্য, আহত ব্যক্তিবর্গ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা৷
ওই সাক্ষ্য বিবরণে জানা যায় যে, ব্রাশ ফায়ারে প্রায় ১০০ জন সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়৷ ভয়াল এই দৃশ্য দেখে মহিলাদের আর্ত চিৎকার আরম্ভ হলে তাঁদের বন্দুক দিয়ে নির্বিচারে পেটানো হয়৷ তাতে অনেকেই অজ্ঞান হয়ে যান৷ একবার অত্যাচারের মাত্রা বুঝুন! এরপর পাকিস্তানি ঘাতকরা মৃত ও অর্ধমৃত দেহগুলো জড়ো করে পেট্রোল ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়৷ আহতদের অনেকে আগুনে পুড়ে মারা যান৷
সাক্ষ্যে কয়েকজন মহিলা ও শিশুর পুড়ে মারা যাওয়ার কথা বলা হয়েছে৷ পাক সেনারা লুকিয়ে থাকা দু’জন যুবককে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে আসে৷ তাদের ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি দিতে বাধ্য করে৷ তারপর তাদের মুখের ভেতর গুলি করে তাদের হত্যা করে৷ এই হত্যাযজ্ঞের সময় রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছিল৷
ঢাকায় অবস্থানকালে মা আনন্দময়ীর ভক্তরা রমনার পাশাপাশি শ্রীসিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়িতেও মায়ের জন্য একটি আশ্রম করে দিয়েছিলেন৷ রমনায় মা আনন্দময়ী আশ্রমের প্রবেশদ্বার ছিল পূর্বদিকে৷ পশ্চিমদিকে একটি নাটমন্দির ছিল৷ তার উত্তরদিকে ছোট একটি ইটের কোঠায় মা আনন্দময়ীর পাদপদ্ম সংরক্ষিত ছিল৷
কোঠা সংলগ্ন আশ্রম মন্দিরের বেদির ওপর বিষ্ণু ও মা অন্নপূর্ণা বিগ্রহ স্থাপিত ছিল৷ বেদির নীচে অন্য এক কালীমূর্তির আলোকচিত্র দেখা যেত৷ এই আলোকচিত্র যে মূর্তির তা বেদির নীচে এক গহ্বরে স্থাপিত ছিল৷ বছরে মাত্র একবার মা আনন্দময়ীর জন্মোৎসবের সময় ওই মূর্তি বের করা হত৷ অন্য সময় তা গহ্বরের অভ্যন্তরে থাকত৷ মা আনন্দময়ী থাকতেন উত্তর-পূর্বদিকে একটি চারচালা খড়ের ঘরে৷
আশ্রম ও মন্দিরের গোয়ালে প্রায় ৫০টির মতো গোরু ছিল৷ গোরুগুলোকেও পুড়িয়ে মারা হয়৷ ভয়াবহ আগুন, গোলাগুলি, মাংসপোড়া গন্ধ ও ভয়ার্ত চিৎকারে গোটা রমনা এলাকায় এক নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়৷ সারারাত ধরে চলে পাকিস্তানি সেনাদের হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলা৷ তারা রমনা অপারেশন শেষ করে ভোর চারটার দিকে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার সময় লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখা মহিলাদের মধ্য থেকে বেশ কয়েকজন যুবতী মেয়েকে ধরে নিয়ে যায়৷ যাঁদের আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি৷ এঁদের সংখ্যা কম করেও বারো-চোদ্দোজন বলে সাক্ষ্যদাতাদের কয়েকজন জানিয়েছেন৷ —চলবে
সৌজন্যে দীপ প্রকাশন
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।