বড় রাস্তা থেকে খানিকটা হেঁটে এসে রমনা কালীবাড়ির তোরণ৷ তবে এটি কোনও পাকা নির্মাণ নয়, কাপড়ের তৈরি৷ সাদা টাইলসে বাঁধানো গোটা চত্বর৷ প্রথমেই কালীমন্দির৷ পাথরের বেদির ওপর শ্রীশ্রীভদ্রকালীর সু-উচ্চ প্রতিমা৷ চতুর্ভুজা মাতৃমূর্তি মহাদেবের শয়ান মূর্তির ওপর দণ্ডায়মান৷ দু’পাশে ডাকিনী-যোগিনী৷
ভদ্রকালিকা দেবীর কণ্ঠে মুণ্ডমালা৷ লাল জবা ফুলের মালা৷ তিনি লালবস্ত্র পরিহিতা৷ বাংলাদেশে যত কালীমূর্তি আমি দর্শন করেছি, প্রতিটি প্রতিমাই দামি বস্ত্রে আবীতা৷ দিগম্বরী নন৷ এপার আর ওপার বাংলার কালীমূর্তিগুলির মধ্যে এই পার্থক্যটুকু দর্শনার্থীদের চোখে পড়বেই৷ ভদ্রকালীর একপাশে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও মা সারদামণির ফোটো৷
ভদ্রকালীর সামনে পিতলের মাঝারি মাপের একটি ঘট৷ তার গায়ে সিঁদুরে আঁকা মঙ্গলচিহ্ন৷ ঘটের ওপর স্থাপিত আস্ত একটি ঝুনো নারকেল৷ তাতে একটুকরো শালু৷ তার ওপর লাল জবা ও গাঁদাফুল৷ ভদ্রকালীমূর্তির সামনে দু’দণ্ড দাঁড়ালেই মনে এক আশ্চর্য অনুভূতি জাগে৷ বিক্ষিপ্ত চিত্ত ভক্তিভাবে ভরে ওঠে৷
মন্দিরের প্রধান পূজারি শুকদেব চক্রবর্তীর সঙ্গে কথাবার্তা হল৷ বললেন, ‘প্রায় ৬০০ বছরের প্রাচীন জাগ্রত মন্দির৷ দুর্গাপুজোর সময় লক্ষ লোকের সমাগম এখানে৷ আর তখনই বোঝা যায় বাংলাদেশে হিন্দু আছে কি না৷ মুসলমানরাও মানত করেন রমনা কালীমন্দিরে৷ একদিন দশটা মুরগি ও একজোড়া কবুতর নিয়ে মন্দিরে এলেন এক মুসলমান ভদ্রমহিলা৷ তাঁর মানত পূরণ হয়েছে৷ চিররুগ্ণ স্বামী ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠেছে৷ মাতা ভদ্রকালীকে মুরগি ও কবুতর নিবেদন করতে চান৷ নিবেদনের পর মুরগি ও কবুতর ছেড়ে দেওয়া হল৷’
মাসকয়েক আগে কলকাতায় বাংলাদেশের ‘যায় যায় দিন’ পত্রিকার সাংবাদিক কিশোরকুমার সরকারের মুখে শুনলাম, মূল রমনা কালীমন্দির আবার নতুনভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে৷
শুকদেববাবুকে নিয়ে রমনা কালীমন্দিরের পূজারির সংখ্যা ৩৷ গত ২০০১ সাল থেকে এই মন্দিরে পুজোর দায়িত্ব পালন করছেন শুকদেববাবু৷ বললেন, ‘১৯৭১ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ৩০ বছর কোনও মন্দিরই ছিল না এখানে৷ তাহলে বুঝতে পারছেন আমাদের মনের অবস্থা কী হতে পারে! দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সাল থেকেই শুরু হয় রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন৷ সেইসঙ্গে এখানে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পুজো-অর্চনার চেষ্টা হয়েছে৷ দুঃখের ব্যাপার কী জানেন, পূজারি ও ভক্তরা যখনই মন্দির পুনঃপ্রতিষ্ঠার পাশাপাশি এখানে পুজো করার চেষ্টা করেছেন, তখনই বিভিন্ন সরকার নানাভাবে বাধাদান করেছে৷
এমনকী হিন্দু সমাজের বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করে জেলে পর্যন্ত পাঠানো হয়েছে৷ অনেককে ভোগ করতে হয়েছে পুলিশের নির্যাতন৷ টানা আন্দোলন ও সংগ্রামের পর অবশেষে ২০০০ সালে প্রথম রমনায় দুর্গাপুজো হয় ঘটপুজোর মধ্য দিয়ে৷ ২০০২ সালে রমনায় দুর্গাপুজো হয় মহা ধুমধামে৷ পুজোর প্রস্তুতি হিসেবে মন্দির প্রাঙ্গণে তৈরি হয় বিরাট প্যান্ডেল ও গেট৷ খালেদা জিয়ার সরকার নিরাপত্তাসহ আর্থিক সাহায্যও করেন পুজো কমিটিকে৷ এরপর ২০০৬ সালে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার আমলেই রমনা কালীমন্দির আবার নতুন করে প্রতিষ্ঠা হল৷ প্রতিমা তৈরি করে দুর্গাপুজোও হয়৷ সবই শেষপর্যন্ত কোনওরকমে হল, কিন্তু ১৯৭১-এ বর্বর পাকিস্তানি সেনাদের ধ্বংসযজ্ঞের কথা ভাবলে এখনও বুক কেঁপে ওঠে৷ পোড়া মন্দিরটা শুধু ধ্বংসের চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়েছিল৷ এমনকী ওই সেনাদের হামলা থেকে মসজিদ ও গির্জাও রক্ষা পায়নি৷’
পূজারি মধুসূদন অধিকারী বয়সে নবীন৷ শুকদেববাবু আমার সঙ্গে কথা বলছেন দেখে মধুসূদন অধিকারীই দর্শনার্থীদের পুজো করাচ্ছিলেন৷ রোদ মাথায় করে মা ভদ্রকালীর পুজো দিতে এসেছেন গৃহবধূ সবিতা সরকার৷ মন্দির থেকে কয়েক কিমি দূরে বাড়ি তাঁর৷ আস্ত তরমুজ ও জবাফুল দিয়ে পুজো দিলেন৷ প্রায়ই এসে পুজো দেন সবিতাদেবী৷ বললেন, ‘ঢাকেশ্বরী দেবীর মতো রমনার কালীমন্দিরও খুব জাগ্রত৷ আমাদের দেশের বাঙালি হিন্দুদের কাছে দুটো মন্দিরেরই বিরাট আকর্ষণ৷ রমনা কালীমন্দিরে কয়েকদিন আসতে না পারলেই হাঁফিয়ে উঠি৷’
ভদ্রমহিলা তাঁর নাম-গোত্র বলার পর কয়েক মিনিটের পুজো৷ ভদ্রকালীমূর্তিকে সাষ্টাঙ্গে প্রণামের পর মায়ের শ্রীচরণের সামনে রাখা আস্ত একটা সিঁদুরের কৌটো চেয়ে নেন সবিতাদেবী৷ তারপর এক চিলতে সিঁদুর নিয়ে সিঁথি স্পর্শ করলেন৷ শাঁখা-পলায় ছোঁয়ালেন৷
লক্ষ করলাম, সেই মুহূর্তে পরম তৃপ্তিতে ভরে উঠেছে তাঁর মুখখানি৷ যখন শুনলেন যে, আমি কলকাতা থেকে এসেছি; সঙ্গে সঙ্গে বেশ উৎসাহের সঙ্গে তাঁর কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর ও তারাপীঠ দর্শনের কথা বললেন৷ তবে তাঁর কথাবার্তায় মনে হল, কালীঘাটের পাণ্ডাদের অহেতুক জ্বালাতন ভদ্রমহিলার ভালো লাগেনি৷
আর এক ভদ্রমহিলা অনন্যা সাহা এসেছেন ময়মনসিংহ থেকে৷ তিনি ফিজিওথেরাপিস্ট৷ সঙ্গে তাঁর স্বামী প্রদীপবাবু৷ ভদ্রলোক পেশায় চিকিৎসক৷ দু’জনেই রমনা কালীর ভক্ত৷ অনন্যা বললেন, ‘ঢাকায় এলেই মা ভদ্রকালীকে পুজো দিতে চলে আসি৷ মা-কে আমরা দু’জনেই ভীষণ মানি৷’
করজোড়ে চোখ বুজে প্রার্থনা করছিলেন স্বামী-স্ত্রী৷ মায়ের ললাটে পরানোর জন্য একটা সোনার টিপ সঙ্গে এনেছেন অনন্যা৷ সেটা প্রধান পূজারির হাতে দিয়ে বললেন, ‘মা-কে সোনার টিপ পরানোর ইচ্ছা ছিল৷ আপনি সুবিধামতো মা-কে সেটা পরিয়ে দেবেন৷’
প্রতিদিন সকাল ৭টায় মন্দির খোলে৷ নানারকমের ফলমূল ও ফুল দিয়ে মায়ের পুজো৷ প্রতিদিন বড় করেই সন্ধ্যারতি৷ মৃদঙ্গ, খোল-করতাল সহযোগে কীর্তন৷ অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় শ্রীশ্রীভদ্রকালীমাতার বিশেষ পুজো ও ভোগ৷ প্রতি অমাবস্যায় কম করেও এক হাজারের কাছাকাছি মানুষ মন্দিরে আসেন৷ বাসন্তীপুজো হয় বেশ ধুমধাম করে৷ দীপান্বিতা কালীপুজোয় মন্দির প্রাঙ্গণে তিল ধারণের জায়গা থাকে না৷
অন্যান্য উৎসবের মধ্যে রয়েছে গণেশপুজো, লক্ষ্মীপুজো, সরস্বতীপুজো, জন্মাষ্টমী, রাধাষ্টমী, ঝুলনযাত্রা, দোলপূর্ণিমা প্রভৃতি৷ মন্দিরটি দেখাশোনার জন্য একটি কার্যনির্বাহী কমিটি আছে৷ সভাপতি পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত ডি.আই.জি সত্যরঞ্জন বারুই, সাধারণ সম্পাদক দয়াময় বিশ্বাস৷ ২০০৮ সালে এই নতুন কমিটি তৈরি হয়৷
সাড়ে ৭ বিঘা জমির ওপর রমনা কালীমন্দিরের একপাশ জুড়ে আরও দেব-দেবীর সুন্দর কয়েকটি মন্দির রয়েছে৷ সময় হাতে নিয়ে এই মন্দিরগুলো ঘুরে-ফিরে দেখা অন্যরকম অভিজ্ঞতা বইকি!
রমনা কালীবাড়ি এমনই এক তীর্থক্ষেত্র যাকে ঘিরে ঘটনার ঘনঘটা৷ যেন রুদ্ধশ্বাস কোনও উপন্যাসের উপাদানে ভরপুর৷ প্রাচীন ইতিহাসের পাশাপাশি কিছু অলৌকিক ঘটনাও মিশে রয়েছে এই কালীবাড়ির সঙ্গে৷ মিশে আছে শ্রীশ্রীমা আনন্দময়ী আশ্রমের এক বৈচিত্র্যপূর্ণ ইতিহাস৷
ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে যে মা আনন্দময়ীর আশ্রম সব গড়ে উঠেছিল, তাঁর আদি আশ্রম ছিল রমনায়৷ তখন তিনি ছিলেন শাহবাগের ‘মা’ নামে পরিচিত৷ ঐশ্বরিক ক্ষমতাসম্পন্ন এক স্নেহময়ী মাতা, মানুষের দুঃখ-বেদনায় যাঁর প্রাণ কেঁদে ওঠে৷ শ্রীশ্রীমা আনন্দময়ী পূর্বাশ্রমে ছিলেন ঢাকার নবাবের শাহবাগ বাগানের কর্মচারী শ্রীযুক্ত রমণীমোহন চক্রবর্তীর পত্নী৷ পরে তিনিও সাধক হিসেবে বাবা ভোলানাথ নামে পরিচিত হন৷
হাইকোর্ট থেকে শুরু করে এখনকার রমনা পার্ক, মিন্টো রোড, শাহবাগ, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, কার্জন হলসহ গোটা অঞ্চলটিকে একদা রমনা বলা হত৷ সুরাবর্দি উদ্যান স্বাধীনতার আগে রেসকোর্স ময়দান নামেই পরিচিত ছিল৷ রমনার দক্ষিণ দিকে প্রায় ৩০০ বিঘা জমি নিয়ে গড়ে উঠেছিল রেসকোর্স ময়দান৷ সুরাবর্দি উদ্যানের মোটামুটি মাঝখানে অনেকটা জায়গা জুড়ে ছিল শ্রীশ্রীরমনা কালীমন্দির ও শ্রীশ্রী মা আনন্দময়ী আশ্রম৷ রমনা কালীমন্দিরের নামানুসারেই এই অঞ্চলের নামকরণ করা হয় রমনা৷
তন্ত্রশাস্ত্রে মা কালীর নানাপ্রকারের মূর্তিভেদ বর্ণনা করা হয়েছে৷ তার মধ্যে রমনা কালী অন্যতম৷ জনশ্রুতি, যেখানে রমনা কালীপুজো হত সেখানে কয়েকশো বছর আগে আদি শংকরাচার্যের দশনামী সন্ন্যাসীদের অন্যতম গিরি সম্প্রদায়ের একটি বড় মঠ ছিল৷ সুরাবর্দি উদ্যানের ভেতরে কাকচক্ষু জলের এক পুষ্করিণীর উত্তর প্রান্তে ছিল ঐতিহাসিক রমনা কালীবাড়ি৷ ঐতিহাসিকদের মতে, শংকরাচার্যের অনুগামী দশনামী সম্প্রদায়ের মন্দিরটিই কালক্রমে রমনা কালীমন্দির হিসেবে খ্যাতিলাভ করে৷
জনশ্রুতি, প্রায় সাড়ে ৫০০ বছর আগে বদ্রীনাথের যোশীমঠ থেকে গোপালগিরি নামে এক উচ্চমার্গের সন্ন্যাসী প্রথমে ঢাকায় এসে সাধন-ভজনের জন্য উপযুক্ত একটি আখড়া গড়ে তোলেন৷ মূল রমনা কালীমন্দিরটি প্রায় ৩০০ বছরেরও আগে নির্মাণ করেন আর এক বড় সাধু হরিচরণ গিরি৷ তবে মন্দিরটির প্রধান সংস্কারকার্য ভাওয়ালের ভক্তিমতী ও দানশীলা রানি বিলাসমণি দেবীর আমলেই হয়৷ —চলবে
সৌজন্যে দীপ প্রকাশন
ভদ্রকালিকা দেবীর কণ্ঠে মুণ্ডমালা৷ লাল জবা ফুলের মালা৷ তিনি লালবস্ত্র পরিহিতা৷ বাংলাদেশে যত কালীমূর্তি আমি দর্শন করেছি, প্রতিটি প্রতিমাই দামি বস্ত্রে আবীতা৷ দিগম্বরী নন৷ এপার আর ওপার বাংলার কালীমূর্তিগুলির মধ্যে এই পার্থক্যটুকু দর্শনার্থীদের চোখে পড়বেই৷ ভদ্রকালীর একপাশে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও মা সারদামণির ফোটো৷
ভদ্রকালীর সামনে পিতলের মাঝারি মাপের একটি ঘট৷ তার গায়ে সিঁদুরে আঁকা মঙ্গলচিহ্ন৷ ঘটের ওপর স্থাপিত আস্ত একটি ঝুনো নারকেল৷ তাতে একটুকরো শালু৷ তার ওপর লাল জবা ও গাঁদাফুল৷ ভদ্রকালীমূর্তির সামনে দু’দণ্ড দাঁড়ালেই মনে এক আশ্চর্য অনুভূতি জাগে৷ বিক্ষিপ্ত চিত্ত ভক্তিভাবে ভরে ওঠে৷
মন্দিরের প্রধান পূজারি শুকদেব চক্রবর্তীর সঙ্গে কথাবার্তা হল৷ বললেন, ‘প্রায় ৬০০ বছরের প্রাচীন জাগ্রত মন্দির৷ দুর্গাপুজোর সময় লক্ষ লোকের সমাগম এখানে৷ আর তখনই বোঝা যায় বাংলাদেশে হিন্দু আছে কি না৷ মুসলমানরাও মানত করেন রমনা কালীমন্দিরে৷ একদিন দশটা মুরগি ও একজোড়া কবুতর নিয়ে মন্দিরে এলেন এক মুসলমান ভদ্রমহিলা৷ তাঁর মানত পূরণ হয়েছে৷ চিররুগ্ণ স্বামী ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠেছে৷ মাতা ভদ্রকালীকে মুরগি ও কবুতর নিবেদন করতে চান৷ নিবেদনের পর মুরগি ও কবুতর ছেড়ে দেওয়া হল৷’
মাসকয়েক আগে কলকাতায় বাংলাদেশের ‘যায় যায় দিন’ পত্রিকার সাংবাদিক কিশোরকুমার সরকারের মুখে শুনলাম, মূল রমনা কালীমন্দির আবার নতুনভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে৷
শুকদেববাবুকে নিয়ে রমনা কালীমন্দিরের পূজারির সংখ্যা ৩৷ গত ২০০১ সাল থেকে এই মন্দিরে পুজোর দায়িত্ব পালন করছেন শুকদেববাবু৷ বললেন, ‘১৯৭১ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ৩০ বছর কোনও মন্দিরই ছিল না এখানে৷ তাহলে বুঝতে পারছেন আমাদের মনের অবস্থা কী হতে পারে! দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সাল থেকেই শুরু হয় রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন৷ সেইসঙ্গে এখানে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পুজো-অর্চনার চেষ্টা হয়েছে৷ দুঃখের ব্যাপার কী জানেন, পূজারি ও ভক্তরা যখনই মন্দির পুনঃপ্রতিষ্ঠার পাশাপাশি এখানে পুজো করার চেষ্টা করেছেন, তখনই বিভিন্ন সরকার নানাভাবে বাধাদান করেছে৷
এমনকী হিন্দু সমাজের বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করে জেলে পর্যন্ত পাঠানো হয়েছে৷ অনেককে ভোগ করতে হয়েছে পুলিশের নির্যাতন৷ টানা আন্দোলন ও সংগ্রামের পর অবশেষে ২০০০ সালে প্রথম রমনায় দুর্গাপুজো হয় ঘটপুজোর মধ্য দিয়ে৷ ২০০২ সালে রমনায় দুর্গাপুজো হয় মহা ধুমধামে৷ পুজোর প্রস্তুতি হিসেবে মন্দির প্রাঙ্গণে তৈরি হয় বিরাট প্যান্ডেল ও গেট৷ খালেদা জিয়ার সরকার নিরাপত্তাসহ আর্থিক সাহায্যও করেন পুজো কমিটিকে৷ এরপর ২০০৬ সালে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার আমলেই রমনা কালীমন্দির আবার নতুন করে প্রতিষ্ঠা হল৷ প্রতিমা তৈরি করে দুর্গাপুজোও হয়৷ সবই শেষপর্যন্ত কোনওরকমে হল, কিন্তু ১৯৭১-এ বর্বর পাকিস্তানি সেনাদের ধ্বংসযজ্ঞের কথা ভাবলে এখনও বুক কেঁপে ওঠে৷ পোড়া মন্দিরটা শুধু ধ্বংসের চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়েছিল৷ এমনকী ওই সেনাদের হামলা থেকে মসজিদ ও গির্জাও রক্ষা পায়নি৷’
পূজারি মধুসূদন অধিকারী বয়সে নবীন৷ শুকদেববাবু আমার সঙ্গে কথা বলছেন দেখে মধুসূদন অধিকারীই দর্শনার্থীদের পুজো করাচ্ছিলেন৷ রোদ মাথায় করে মা ভদ্রকালীর পুজো দিতে এসেছেন গৃহবধূ সবিতা সরকার৷ মন্দির থেকে কয়েক কিমি দূরে বাড়ি তাঁর৷ আস্ত তরমুজ ও জবাফুল দিয়ে পুজো দিলেন৷ প্রায়ই এসে পুজো দেন সবিতাদেবী৷ বললেন, ‘ঢাকেশ্বরী দেবীর মতো রমনার কালীমন্দিরও খুব জাগ্রত৷ আমাদের দেশের বাঙালি হিন্দুদের কাছে দুটো মন্দিরেরই বিরাট আকর্ষণ৷ রমনা কালীমন্দিরে কয়েকদিন আসতে না পারলেই হাঁফিয়ে উঠি৷’
ভদ্রমহিলা তাঁর নাম-গোত্র বলার পর কয়েক মিনিটের পুজো৷ ভদ্রকালীমূর্তিকে সাষ্টাঙ্গে প্রণামের পর মায়ের শ্রীচরণের সামনে রাখা আস্ত একটা সিঁদুরের কৌটো চেয়ে নেন সবিতাদেবী৷ তারপর এক চিলতে সিঁদুর নিয়ে সিঁথি স্পর্শ করলেন৷ শাঁখা-পলায় ছোঁয়ালেন৷
লক্ষ করলাম, সেই মুহূর্তে পরম তৃপ্তিতে ভরে উঠেছে তাঁর মুখখানি৷ যখন শুনলেন যে, আমি কলকাতা থেকে এসেছি; সঙ্গে সঙ্গে বেশ উৎসাহের সঙ্গে তাঁর কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর ও তারাপীঠ দর্শনের কথা বললেন৷ তবে তাঁর কথাবার্তায় মনে হল, কালীঘাটের পাণ্ডাদের অহেতুক জ্বালাতন ভদ্রমহিলার ভালো লাগেনি৷
আর এক ভদ্রমহিলা অনন্যা সাহা এসেছেন ময়মনসিংহ থেকে৷ তিনি ফিজিওথেরাপিস্ট৷ সঙ্গে তাঁর স্বামী প্রদীপবাবু৷ ভদ্রলোক পেশায় চিকিৎসক৷ দু’জনেই রমনা কালীর ভক্ত৷ অনন্যা বললেন, ‘ঢাকায় এলেই মা ভদ্রকালীকে পুজো দিতে চলে আসি৷ মা-কে আমরা দু’জনেই ভীষণ মানি৷’
করজোড়ে চোখ বুজে প্রার্থনা করছিলেন স্বামী-স্ত্রী৷ মায়ের ললাটে পরানোর জন্য একটা সোনার টিপ সঙ্গে এনেছেন অনন্যা৷ সেটা প্রধান পূজারির হাতে দিয়ে বললেন, ‘মা-কে সোনার টিপ পরানোর ইচ্ছা ছিল৷ আপনি সুবিধামতো মা-কে সেটা পরিয়ে দেবেন৷’
প্রতিদিন সকাল ৭টায় মন্দির খোলে৷ নানারকমের ফলমূল ও ফুল দিয়ে মায়ের পুজো৷ প্রতিদিন বড় করেই সন্ধ্যারতি৷ মৃদঙ্গ, খোল-করতাল সহযোগে কীর্তন৷ অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় শ্রীশ্রীভদ্রকালীমাতার বিশেষ পুজো ও ভোগ৷ প্রতি অমাবস্যায় কম করেও এক হাজারের কাছাকাছি মানুষ মন্দিরে আসেন৷ বাসন্তীপুজো হয় বেশ ধুমধাম করে৷ দীপান্বিতা কালীপুজোয় মন্দির প্রাঙ্গণে তিল ধারণের জায়গা থাকে না৷
অন্যান্য উৎসবের মধ্যে রয়েছে গণেশপুজো, লক্ষ্মীপুজো, সরস্বতীপুজো, জন্মাষ্টমী, রাধাষ্টমী, ঝুলনযাত্রা, দোলপূর্ণিমা প্রভৃতি৷ মন্দিরটি দেখাশোনার জন্য একটি কার্যনির্বাহী কমিটি আছে৷ সভাপতি পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত ডি.আই.জি সত্যরঞ্জন বারুই, সাধারণ সম্পাদক দয়াময় বিশ্বাস৷ ২০০৮ সালে এই নতুন কমিটি তৈরি হয়৷
সাড়ে ৭ বিঘা জমির ওপর রমনা কালীমন্দিরের একপাশ জুড়ে আরও দেব-দেবীর সুন্দর কয়েকটি মন্দির রয়েছে৷ সময় হাতে নিয়ে এই মন্দিরগুলো ঘুরে-ফিরে দেখা অন্যরকম অভিজ্ঞতা বইকি!
রমনা কালীবাড়ি এমনই এক তীর্থক্ষেত্র যাকে ঘিরে ঘটনার ঘনঘটা৷ যেন রুদ্ধশ্বাস কোনও উপন্যাসের উপাদানে ভরপুর৷ প্রাচীন ইতিহাসের পাশাপাশি কিছু অলৌকিক ঘটনাও মিশে রয়েছে এই কালীবাড়ির সঙ্গে৷ মিশে আছে শ্রীশ্রীমা আনন্দময়ী আশ্রমের এক বৈচিত্র্যপূর্ণ ইতিহাস৷
ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে যে মা আনন্দময়ীর আশ্রম সব গড়ে উঠেছিল, তাঁর আদি আশ্রম ছিল রমনায়৷ তখন তিনি ছিলেন শাহবাগের ‘মা’ নামে পরিচিত৷ ঐশ্বরিক ক্ষমতাসম্পন্ন এক স্নেহময়ী মাতা, মানুষের দুঃখ-বেদনায় যাঁর প্রাণ কেঁদে ওঠে৷ শ্রীশ্রীমা আনন্দময়ী পূর্বাশ্রমে ছিলেন ঢাকার নবাবের শাহবাগ বাগানের কর্মচারী শ্রীযুক্ত রমণীমোহন চক্রবর্তীর পত্নী৷ পরে তিনিও সাধক হিসেবে বাবা ভোলানাথ নামে পরিচিত হন৷
হাইকোর্ট থেকে শুরু করে এখনকার রমনা পার্ক, মিন্টো রোড, শাহবাগ, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, কার্জন হলসহ গোটা অঞ্চলটিকে একদা রমনা বলা হত৷ সুরাবর্দি উদ্যান স্বাধীনতার আগে রেসকোর্স ময়দান নামেই পরিচিত ছিল৷ রমনার দক্ষিণ দিকে প্রায় ৩০০ বিঘা জমি নিয়ে গড়ে উঠেছিল রেসকোর্স ময়দান৷ সুরাবর্দি উদ্যানের মোটামুটি মাঝখানে অনেকটা জায়গা জুড়ে ছিল শ্রীশ্রীরমনা কালীমন্দির ও শ্রীশ্রী মা আনন্দময়ী আশ্রম৷ রমনা কালীমন্দিরের নামানুসারেই এই অঞ্চলের নামকরণ করা হয় রমনা৷
তন্ত্রশাস্ত্রে মা কালীর নানাপ্রকারের মূর্তিভেদ বর্ণনা করা হয়েছে৷ তার মধ্যে রমনা কালী অন্যতম৷ জনশ্রুতি, যেখানে রমনা কালীপুজো হত সেখানে কয়েকশো বছর আগে আদি শংকরাচার্যের দশনামী সন্ন্যাসীদের অন্যতম গিরি সম্প্রদায়ের একটি বড় মঠ ছিল৷ সুরাবর্দি উদ্যানের ভেতরে কাকচক্ষু জলের এক পুষ্করিণীর উত্তর প্রান্তে ছিল ঐতিহাসিক রমনা কালীবাড়ি৷ ঐতিহাসিকদের মতে, শংকরাচার্যের অনুগামী দশনামী সম্প্রদায়ের মন্দিরটিই কালক্রমে রমনা কালীমন্দির হিসেবে খ্যাতিলাভ করে৷
জনশ্রুতি, প্রায় সাড়ে ৫০০ বছর আগে বদ্রীনাথের যোশীমঠ থেকে গোপালগিরি নামে এক উচ্চমার্গের সন্ন্যাসী প্রথমে ঢাকায় এসে সাধন-ভজনের জন্য উপযুক্ত একটি আখড়া গড়ে তোলেন৷ মূল রমনা কালীমন্দিরটি প্রায় ৩০০ বছরেরও আগে নির্মাণ করেন আর এক বড় সাধু হরিচরণ গিরি৷ তবে মন্দিরটির প্রধান সংস্কারকার্য ভাওয়ালের ভক্তিমতী ও দানশীলা রানি বিলাসমণি দেবীর আমলেই হয়৷ —চলবে
সৌজন্যে দীপ প্রকাশন