সোমবার ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ঢাকার রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন থেকে নারায়ণগঞ্জ বেশি দূরের পথ নয়৷ মোটামুটি এক্সপ্রেস ধরনের একটা বাসে চাপলে আর যানজট না থাকলে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে নারায়ণগঞ্জে পৌঁছনো যায়৷

আমার নারায়ণগঞ্জে যাওয়ার পিছনে কয়েকটা কারণ ছিল৷ প্রথমত, সেখানে ব্রহ্মপুত্র নদে লাঙ্গলবন্দ উৎসব প্রসিদ্ধ৷ এই উৎসবের আয়োজন কীভাবে হয় তা দেখার ইচ্ছা আমার৷ দ্বিতীয়ত, লাঙ্গলবন্দ থেকে সোজা যাব বারদী ধামে, শ্রীশ্রীলোকনাথ বাবার সমাধি মন্দিরে৷ সেখান থেকে আমার পৈতৃক ভিটা দুপ্তারা গ্রাম৷ তারপর নারায়ণগঞ্জ থেকে আবার বাস ধরে ঢাকায় ফেরা৷

কমলাপুর স্টেশন থেকে ট্রেনেও নারায়ণগঞ্জ যাওয়া যায়৷ রামকৃষ্ণ মিশনের এক সন্ন্যাসী আমাকে বললেন, ‘বাসে না গিয়ে আপনি বরং ট্রেনেই যান৷ জার্নিটা তুলনামূলকভাবে আরামদায়ক হবে৷’

ঢাকা রামকৃষ্ণ মিশনেই নির্মলেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার আলাপ৷ নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর গ্রামে নির্মলেন্দুর বাড়ি৷ বছর পঁয়ত্রিশের বিবাহিত এই যুবক সরল সোজা৷ হাসিখুশি৷ গানের গলাও বেশ ভালো৷ পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে ঢাকার এক টিভি চ্যানেলে গান রেকর্ডিং করার জন্য নির্মলেন্দু কয়েকদিন এখানে থাকবে৷

গল্পগুজবের ফাঁকে ফাঁকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, শ্যামল মিত্রের গান যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে আমাকে শোনাচ্ছিল নির্মলেন্দু৷ এই যুবক একসময় কৃষ্ণনগরে থাকত৷ ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ থেকে এক কাপড়ে ভারতে পালিয়ে এসেছিল৷
নির্মলেন্দু বলল, ‘সে যে কী ভয়ানক অবস্থা তখন! বাবা একা দেশের বাড়িতে ছিলেন৷ বাড়ির আসবাবপত্র লুঠ হল৷ প্রতিবাদ করার মতো ক্ষমতা তাঁর ছিল না৷ বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে আনন্দ করতে করতে চলে গেল লুটেরার দল৷ কোনোক্রমে বাবার প্রাণরক্ষা হল৷ এমন কয়েকজনকে জানি যারা সারারাত কচুরিপানা ভর্তি পুকুরের জলে ডুবে প্রাণ বাঁচিয়েছিল৷ কত লোক যে প্রাণ বাঁচাতে দিনের পর দিন অর্ধাহারে ও অনাহারে থেকেছে৷ সব যেন গল্পের মতো! বাংলাদেশ হওয়ার কয়েক বছর পর হিলি সীমান্ত দিয়ে দেশে ফিরে যাই৷’
বারদী ধাম দেখার ইচ্ছা নির্মলেন্দুর৷ যখন শুনল, আমি সেখানে যাচ্ছি সে-ও সঙ্গী হতে চাইল৷ ভাবলাম, ভালোই হল৷ গল্পগুজব করে সময় কেটে যাবে৷ পথশ্রমও মালুম হবে না৷

তবে শুরুতেই জোর ধাক্কা! রামকৃষ্ণ মিশন থেকে একটা রিকশয় কমলাপুর স্টেশন মিনিট দশ-পনেরো৷ ৩০ টাকা রিকশভাড়া দিয়ে স্টেশনে এসে শুনলাম, সকাল সাড়ে দশটার ট্রেন একটু আগেই চলে গিয়েছে৷ পরের ট্রেন দুপুর সাড়ে ১২টায়৷ অবশ্য তখনও টিকিট কাটিনি৷ নারায়ণগঞ্জ পূজা কমিটির সভাপতি বড় গারমেন্টস ব্যবসায়ী শ্রীযুক্ত শংকর সাহা নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে আমাদের জন্য বেলা ১২টা পর্যন্ত করবেন৷ তিনি ‘লাঙ্গলবন্দ উৎসব কমিটি’-র সভাপতি৷ শংকরবাবুর সঙ্গে ফোনে বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি কাজল দেবনাথই আমার যোগাযোগ করিয়ে দেন৷

এখন কী করি? সাড়ে ১২টার ট্রেন ধরার কোনো মানে হয় না৷ নারায়ণগঞ্জ পৌঁছতে দুপুর দেড়টা-দুটো৷ ততক্ষণে শংকরবাবু লাঙ্গলবন্দে পৌঁছে যাবেন৷ সেই মুহূর্তে মনে হল, শংকরবাবুর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করাই সবথেকে ভালো৷
আরও পড়ুন:

বাংলাদেশের জাগ্রত মন্দিরে মন্দিরে, পর্ব-৪৯: করতোয়া নদীর তীরে শালবাড়ি গ্রাম সতীর একান্নপীঠের অন্যতম পীঠ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫২: বইয়ের সব কপি কবির নির্দেশে বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৮: হৃদয়মন্দিরে মন শুদ্ধ করে দেবতা প্রতিষ্ঠা করলে তবেই তো দেবতার পুজো হবে

তাঁকে মোবাইলে সঙ্গে সঙ্গে পেয়েও গেলাম৷ বললেন, ‘কোনও সমস্যা নাই৷ গুলিস্তানে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের কাছ থিকাই নারায়ণগঞ্জের বাস ছাড়ে৷ তাতেই চইলা আসেন৷ আপনার জইন্য অপেক্ষা করুম৷’
শংকর সাহার কথায় খানিকটা আশ্বস্ত হলাম৷ নির্মলেন্দুকে বললাম, ‘কমলাপুর স্টেশনে আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করা নয়৷ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা রিকশ ধরে গুলিস্তানের বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছতে হবে৷’
নির্মলেন্দু বলল, ‘সেই ভালো৷ নারায়ণগঞ্জে আমাদের তাড়াতাড়ি পৌঁছনো নিয়ে কথা৷’

কমলাপুর স্টেশন থেকে গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ড ৪০ টাকা রিকশভাড়া৷ রিকশ দৌড়লও বেশ জোরে৷ এরপর ‘বন্ধন’ বাস ধরে নারায়ণগঞ্জে পৌঁছলাম ঘণ্টাখানেকের মধ্যে৷ শহরে ঢোকার মুখেই প্রচণ্ড যানজট৷ এখানেও রিকশর সংখ্যা কম নয়৷ বেলা ১২টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে৷ ফাইভ স্টার ক্লাব৷ মেম্বারশিপ পেতে মোটা টাকা খরচ হয়৷ নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের পরিবেশ অনেকটা কলকাতার বড় কোনো প্রাইভেট ক্লাবের মতো৷

শংকরবাবু ফোনে জানতে চাইলেন—আমি নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে পৌঁছেছি কি না? পথে কোনো অসুবিধা হয়েছে কি না? বললেন, ‘দাদা, আপনি কয়েক মিনিট অপেক্ষা করেন৷ আমি আসতাছি৷’ উর্দিপরা বেয়ারা এসে দু’কাপ চা দিয়ে গেল৷ সঙ্গে বাড়তি পাওনা লম্বা ‘স্যালুট’৷ সব সাহেবি আদব-কায়দা!

সময়মতোই এলেন শংকর সাহা৷ দোহারা চেহারা৷ মুখে হাসি৷ পঞ্চাশের কোঠায় বয়স৷ সঙ্গে জনাকয়েক সঙ্গী-সাথি৷ আলাপ-পরিচয়ের পর্ব শেষ হল৷ শংকরবাবুর ছেলে কলকাতার কলেজে পড়াশুনো করছে৷ সল্টলেকে একটা বাড়ি ভাড়া করে থাকে৷

তাঁর কাছে শুনলাম—বাংলাদেশের অনেক হিন্দু ছেলে-মেয়েই কলকাতা ও ভারতের অন্যান্য শহরে লেখাপড়া করে৷ কেউ কেউ আবার মার্কিন মুলুকে যাওয়ার জন্যও পা বাড়িয়ে আছে৷ তবে যাঁদের আর্থিক সঙ্গতি রয়েছে তাঁরাই ছেলে-মেয়েদের বাইরে পাঠাতে পারেন৷

শংকরবাবু জমিয়ে গল্প করতে পারেন৷ নারায়ণগঞ্জ থেকে খানিকটা এগোনোর পর শীতলক্ষা নদীর সেতু পেরিয়ে মহাতীর্থ লাঙ্গলবন্দের দিকে আমাদের প্রাইভেট কার ছুটছে৷ শীতলক্ষার সেতু পেরিয়ে আরও কিছুদূর যাওয়ার পর রাস্তার বাঁদিকে বারদী ধামের পথ৷ এদিকেই দুপ্তারায় যাওয়া যায়৷
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৩: সুন্দরবনের সুন্দর মাছ

ওষুধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াতেও ফুলতে পারে পা, জেনে নিন কী করণীয়

স্বাদে-গন্ধে: একঘেয়ে কাতলা? স্বাদবদল করুন ‘কমলা কাতলা’ রেসিপিতে! রইল সহজ রেসিপি

শংকরবাবুর মুখে ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা শুনছিলাম৷ শীতলক্ষা নদীর জল হিন্দুদের রক্তে লাল হয়ে যায়৷ শুধু শীতলক্ষা নয়, ব্রহ্মপুত্রেও বহু হিন্দু নর-নারীর পচা-গলা লাশ পাওয়া গিয়েছিল৷ শংকরবাবু তখন নেহাতই বালক৷ কপালের জোরে বেঁচে যান৷ আদমজি জুটমিলের বিহারী মুসলমানরাই দাঙ্গার মূল পান্ডা ছিল৷ শংকরবাবুর মতে, সেই সময় বাঙালি মুসলমানরা কিন্তু তুলনামূলকভাবে অসাম্প্রদায়িক ছিলেন৷

শংকরবাবু আক্ষেপের সুরে বললেন, ‘৬৪ সালের ওই বীভৎস দাঙ্গা যে সরকারের প্রত্যক্ষ মদতেই হইছিল তাতে কোনো সন্দেহ নাই৷ এক ঘণ্টার জইন্য কারফিউ শিথিল করা হইছিল, তখনই বিহারীরা হিন্দুদের ছুরি-ভোজালি আর রাম দা লইয়া অ্যাটাক করে৷ শত শত হিন্দু মারা পড়ে৷ পাঁচ-সাতজন ছোট পোলা-মাইয়া বিহারী মুসলমানদের তাড়া খাইয়া প্রাণ বাঁচানোর লাইগা দৌড়াইতেছিল৷ তখনই আমার বাবা তাদের জোর কইরা ঠেইল্যা ঘরে ঢুকাইয়া দরজায় ডাঁসা লাগাইয়া দেন৷ ওই পোলা-মাইয়াগুলার প্রাণ বাঁচে৷ বিহারীরা ফিরা যায়৷’
শংকরবাবু বললেন, ‘আগে রাষ্ট্রশক্তি সাম্প্রদায়িক ছিল৷ মানুষ তবুও হয়তো কিছুটা অসাম্প্রদায়িক ছিল৷ আর এখন রাষ্ট্রশক্তি সহায়ক, কিন্তু মানুষ সাম্প্রদায়িক হইছে৷

নির্মলেন্দু বলল, ‘নওগাঁ-র মৈনমের রায়টে অনেক হিন্দু মারা যায়৷ ওখানেও বিহারী মুসলমানরা রায়ট্ লাগায়৷ এমনকী শান্তাহারে ট্রেন থামিয়ে বিহারীরা হিন্দুদের কচুকাটা করে৷ হিন্দু মেয়েদের জোর করে ধরে নিয়ে যায়৷ এই বীভৎসতার কোনো ক্ষমা নাই৷ বিহারীদের হাত থেকে নির্মল চৌধুরি নামে একজন পালাতে পেরেছিল৷ তখন তার বয়স চোদ্দ-পনেরো৷ ক্লাস এইটে পড়ে৷ সে এক সন্ধ্যায় কপালের জোরে এক দরদী মুসলমানের বাড়িতে আশ্রয় পায়৷ মৃত্যুভয়ে ভীত নির্মল চৌধুরিকে নিজেদের জীবনের পরোয়া না করে বাঁচিয়েছিলেন ওই মুসলমান দম্পতি৷ টানা কয়েকদিন ধানসেদ্ধর চাড়িতে লুকিয়ে থাকতে হয় তাকে৷ খালি হাত-পায়ে বাংলাদেশ ছাড়তে হল৷ ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়৷ অনেক কষ্টে বড় হয়েছেন৷ উনি কৃষ্ণনগরের কাছে বেথুয়াডহরিতে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ সেবা সমিতির অফিসে অ্যাকাউন্টেন্টের চাকরি করতেন৷’
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৪: মন তোর শক্তিই ‘মন্ত্রশক্তি’

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৭: একটার পর একটা রেস্তরাঁয় ফোন করে জানতে পারলাম ৫ মাইল দূরে একটি খোলা আছে

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৮: জ্বরে ভাত খাবেন?

দীর্ঘদিন কৃষ্ণনগরে থাকার জন্য নির্মলেন্দুর উচ্চারণে বাংলাদেশি টান নেই৷ বরং মুর্শিদাবাদের কথার টান রয়েছে৷ শংকরবাবু দুঃখ করে বললেন, ‘কী আর কমু কন! হিন্দুদের সম্পত্তি দখলের সময় সব রাজনৈতিক পার্টিই সমান৷ তখন পার্টিগুলি বিবাদ ভুইলা ভাই ভাই৷ সোনারগাঁর পানাম নগরে হিন্দু জমিদারদের বিরাট সম্পত্তিও একসময় বেদখল হইছে৷ সেইখানে যখন পর্যটন নগরী হইল সরকার ঘোষণা করল—যার যার জমি তারা অরিজিন্যাল দলিল লইয়া আইলেই ক্ষতিপূরণের টাকা পাইব৷ মাত্র একজন আইছিল৷ বাকি লোক আসে নাই৷ কারণ, ওইগুলা ফলস মানে মিথ্যা দলিল৷ তাহলেই বোঝেন দাদা, কী যে অবস্থা আমাগো হিন্দুদের আজ৷ তবে নারায়ণগঞ্জের হিন্দুরা দাপটে থাকে৷ এখানে বর্তমানে ৩ লক্ষ ভোটার৷ হিন্দু ভোটারের সংখ্যা ৭০ হাজার৷’
নারায়ণগঞ্জ থেকে লাঙ্গলবন্দ মোটরগাড়িতে মোটামুটি ঘণ্টা দেড়েক৷ আমরা পৌনে দুটো নাগাদ লাঙ্গলবন্দে পৌঁছলাম৷ ওখানে স্নান উৎসব কমিটি-র কয়েকজন সদস্য উপস্থিত ছিলেন৷ শংকরবাবুকে দেখে তাঁদের মুখে হাসি ফুটল৷

শংকরবাবু আমাকে বললেন, ‘আগে চলেন খাওয়া-দাওয়া সাইরা ফেলি৷ বেলা অনেক হইল৷ ক্ষুধাও পাইছে খুব৷’ গরম গরম ভাত, মুগের ডাল, কয়েক রকমের মাছ, মুরগির মাংস, চাটনি, দই-মিষ্টি কী নেই! সবই নিজের হাতে রেঁধেছেন উৎসব কমিটিরই এক সদস্যের স্ত্রী৷ ব্রহ্মপুত্র নদের গায়েই বাড়ি৷ চৌকির ওপর বসে নদের শোভা দেখতে দেখতে দুপুরের এই ভূরিভোজের মজাই আলাদা!

শংকরবাবু ও স্নান উৎসব কমিটির অন্য পদাধিকারীরা স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনের সঙ্গে আসন্ন লাঙ্গলবন্দ উৎসবের ব্যবস্থাদি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করবেন৷ বিকেলের দিকে নির্মলেন্দু ও আমি বারদী যাব৷ অতএব তখন বেশ খানিকটা সময় আমাদের হাতে৷—শেষ
* বাংলাদেশের জাগ্রত মন্দিরে মন্দিরে (Bangladesher Jagrata Mondire Mondire) : সুমন গুপ্ত (Suman Gupta), বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক।

Skip to content