রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।

পরদিন সকালেই বদ্দারহাট থেকে সি এন জি চেপে নোয়াপাড়া মিনিট চল্লিশেক৷ এই বদ্দারহাটে মিনি বাংলাদেশে টাওয়ার৷ ওপর থেকে পুরো চিটাগাং শহর ছবির মতো লাগে৷ একদম ওপরে ঘূর্ণায়মান চিনা রেস্তরাঁ৷ বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও জিনিসের মডেল রয়েছে এখানে৷ নোয়াপাড়া যেতে হলে হালদা নদীর ব্রিজ পেরতে হয়৷ এই নদী গিয়ে কর্ণফুলির সঙ্গে মিশেছে৷ রুই মাছ হালদা নদীতে এসে ডিম ছাড়ে৷
স্বল্প পরিসরে সূর্য সেন এবং প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, প্রাতঃস্মরণীয় এই দুই বিপ্লবীর জন্মভিটার বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়৷ সূর্য সেনের বাড়িতে এখন হেলথ সেন্টার হয়েছে৷ ধুঁকে ধুঁকে চলছে৷ আর ১৯৯৫ সালে ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা ট্রাস্ট’ তৈরি হওয়ার পর তাঁর পৈতৃক বাড়ি ধলঘাটে একটা সরকারি প্রাইমারি ও কিন্ডারগার্টেন সুকল হয়েছে৷ তাঁর নামে একটা নাট্যমঞ্চও রয়েছে৷ ধলঘাট হিন্দুপ্রধান গ্রাম৷ ট্রাস্টের সভাপতি শ্রীযুক্ত পঙ্কজ চক্রবর্তী৷ তবে সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার হল, সূর্য সেনের গ্রামের (সূর্য সেন পল্লি) অনেকেই জানেন না এই মহান বিপ্লবীর অবদান কী!

কর্ণফুলি নদীর এক পাড়ে পোটিয়া, অন্য পাড়ে রাউজান৷ এই রাউজানেরই একটি অংশ নোয়াপাড়া ইউনিয়ন৷ কয়েক একর জায়গা নিয়ে মাস্টারদার পৈতৃক বাড়ি৷ তাঁদের জমিদার পরিবার৷ পরে এই বাড়িতে সূর্য সেনের এক কাকা মোহিত সেন থাকতেন৷

সূর্য সেনের স্ত্রী পুষ্পলতা সেন ছিলেন দত্ত বংশের মেয়ে৷ বাড়ি পোটিয়া উপজেলায়৷ হ্যাঁ, সাত পাক ঘুরেই সূর্য সেন এবং পুষ্পলতার বিবাহ হয়৷ সিঁদুর দানের পরই নববধূর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিয়ের আসর ছেড়ে চলে যান মাস্টারদা৷

তাঁকে ধরতে আসা এক ইংরেজ পুলিশ অফিসার গুলির লড়াইয়ে মারা যান৷ মাস্টারদা পালাতে পেরেছিলেন৷ কিন্তু তাঁর নামে চারদিকে হুলিয়া জারি হয়৷ শেষপর্যন্ত তিনি পোটিয়ার ধলঘাট গ্রামে ধরা পড়েন৷ মাস্টারদারই এক মামা পয়সার লোভে ইশারায় ভাগ্নেকে ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয়৷ অবশ্য পাপের ফল হাতেনাতে পেয়েছিল ওই লোকটিও৷ বেইমানির শাস্তি মৃত্যু৷ মাস্টারদার সঙ্গীদের হাতেই মারা যায় সে৷
চট্টগ্রাম বিদ্রোহের মহানায়ক মাস্টারদা সূর্য সেনের জন্ম ২২ মার্চ, ১৮৯৪, ফাঁসি ১২ জানুয়ারি ১৯৩৪৷ স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনেই মাস্টারদার ফাঁসি হয়েছিল৷ প্রীতিলতার আত্মাহুতি ২৪ সেপ্ঢেম্বর৷ একবার পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিই যে, জালালাবাদে ব্রিটিশ সৈন্যদের সঙ্গে সূর্য সেন ও তাঁর বীর সৈনিকদের তুমুল লড়াই হয়েছিল ২২ এপ্রিল৷ তার আগে তিন-তিনটে দিন ১৯, ২০ ও ২১ এপ্রিল স্বাধীন চট্টগ্রাম পেয়েছিল অখণ্ড ভারতবাসী৷ আরও একটা কথা জানিয়ে রাখি, স্বামীজির ছবি প্রীতিলতার শাড়ির সঙ্গে ‘ব্যাজ’ হিসাবে আঁটা থাকত৷ আলিপুর জেলে বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে অনেকবার দেখা করেন প্রীতিলতা৷ রামকৃষ্ণ বিশ্বাস তাঁকে বলেন, স্বামীজির ছবি দেখে বড়ই প্রীত হলাম৷
স্বামীর সঙ্গে জেলে দেখা করতে যান পুষ্পলতা দেবী৷ বিপ্লবী কল্পনা দত্ত তখন জেলে৷ বয়স কম ছিল বলে বিচারকের আদেশে পরে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান৷ মহাত্মা গান্ধী নাকি সূর্য সেনকে বলেছিলেন, তুমি ক্ষমা চাও৷ আমি তোমাকে মুক্ত করব৷

কিন্তু বিপ্লবের আগুন আজন্ম যাঁর রক্তে, সেই অকুতোভয় মানুষ মাস্টারদা গান্ধীজির এই প্রস্তাব বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন৷

মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের যথার্থ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ‘সূর্য সেন’-এর নামাঙ্কিত এই হেলথ সেন্টার৷ কিন্তু সরকারি গেজেটে হাসপাতালের নাম নেই৷ অথচ সরকার সূর্য সেনের ভিটার দখল নিয়েছে৷ ২০০৩-২০০৪ সালে এই হাসপাতালের শুরু৷ শুধু আউটডোর৷ সকাল সাড়ে ৮টা থেকে দুপর আড়াইটা পর্যন্ত আউটডোর খোলা৷ এমবিবিএস একজন মহিলা মেডিকেল অফিসার সপ্তাহে কয়েকদিন এখানে আসেন৷ তাঁর তিন-চারজন সহকারী আছেন৷ মা ও শিশু মিলিয়ে প্রতিদিন গড়ে ২০ জনের চিকিৎসা হয়৷ পেশেন্টদের বিনামূল্যে ওসুধপত্র দেওয়া হয়৷ আবুল ফজলের কাছ থেকেই এই হেলথ সেন্টারের খবরাখবর পেলাম৷

ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলে ভারী ভালো লাগল৷ অফিস ঘরের দেওয়ালে টাঙানো সূর্য সেনের ফোটোর দিকে তাকিয়ে বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘মাস্টারদাকে আমি ভীষণ শ্রদ্ধা করি৷ তিনিই প্রথম গোটা দুনিয়া কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো সশস্ত্র আন্দোলন করেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে৷ প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চট্টগ্রামকে স্বাধীন করে রেখেছিলেন৷ তাঁর মতো বাঘের বাচ্চা কই? হ্যাঁ, ছিলেন বটে আর একজন৷ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু৷ ওই মানুষটারেও শুধু আমি নয়, সকলেই শ্রদ্ধা করেন৷’

তাঁর কাছেই শুনলাম, এই হাসপাতালে ১০টা বেড আছে৷ অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটার আছে৷ কিন্তু না বেড, না অপারেশন থিয়েটার, কিছুই চালু হয়নি৷ ‘সূর্য সেনের জন্মভিটার অনেকখানি দখল করে আছে কয়েকজন হিন্দু- মুসলমান৷ এ তো অন্যায়! সকলে মিলে একসঙ্গে আন্দোলন করলে যদি এই জবরদখল থেকে মাস্টারদার ভিটাকে মুক্ত করা যায়’—বললেন আবুল ফজল৷

তিনি দুঃখ করে বললেন, ‘সরকার চায় এই হাসপাতালের নাম গেজেটে উঠুক৷ কিন্তু নানা বাধা৷ এক সময়ের এক ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক নেতা কী বলেছে একবার শুনলেই আমার মাথা গরম হয়ে যায়৷ এ কথা বলা কিংবা শোনাও যে মহাপাপ৷ সে বলেছিল, সূর্য সেন বিপ্লবী ছিলেন না, তিনি একজন সন্ত্রাসবাদী৷ হাসি পায়! এই অভিযোগ যে করছে সে-ই তো পাক্কা সন্ত্রাসবাদী৷
আরও পড়ুন:

পর্ব-৪৬: জালালাবাদ পাহাড়ে মাস্টারদার নেতৃত্বে বিপ্লবীদের সংগ্রামের ইতিহাস আজও স্বর্ণাক্ষরে লেখা মানুষের হৃদয়ে

জ্যোতির্লিঙ্গ যাত্রাপথে, পর্ব-১: চলার পথে খানিক ভণিতা

এই নেতার নাম সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরি৷ নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থের জন্য পাঁকে পর্যন্ত নামতে পারে এরা৷ এই তো আমাদের রাজনীতি! মন্ত্রী ও সচিবরাও এই হাসপাতালে এসেছেন৷ কিন্তু ঢাকায় গেলে সব ভুলে যান৷ সূর্য সেনের সঙ্গী শ্রদ্ধেয় বিনোদবিহারী চৌধুরি ও আওয়ামি লিগের নেতা আবদুল্লা আল হারুন এই দুজনের আন্তরিক চেষ্টায় এই হাসপাতাল তৈরি হয়৷ আয়ুব খানের আমলে মাস্টারদার পৈতৃক ভিটা ‘এনিমি প্রপার্টি হিসাবে ঘোষিত হয়৷ হাসপাতাল হওয়ার পর তবুও এই অঞ্চলে সূর্য সেনের নাম লোকজনের মুখে শোনা যায়৷ দেশবরেণ্য বিপ্লবীদের অবদানের কথা আমরা ভুলে যাই কী করে!’

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী৷ বিচারে তার ফাঁসির আদেশ হয়েছে৷ এই লোকটিই শ্রীকুণ্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যা মন্দিরের অধ্যক্ষ নূতনচন্দ্র সিংহকে গুলি করে হত্যা করে৷ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরি আরও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত৷ রাউজান উপজেলার একটা অংশ গহিরায় কুণ্ডেশ্বরী সুকল ও কলেজ৷ নূতনবাবুর ছেলে প্রফুল্লরঞ্জন সিংহের চেষ্টায় ‘কুণ্ডেশ্বরী আয়ুর্বেদিক ঔষধালয়’ বাংলাদেশে এখন এক পরিচিত নাম৷ প্রায় সারা বাংলাদেশেই এই ঔষধালয়ের শাখা ছড়িয়ে আছে৷ নূতনচন্দ্র সিংহই এই প্রতিষ্ঠানটি নিজের হাতে গড়ে তোলেন৷ এখানে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষরা কাজ করেন৷

হাসপাতাল ও এর চারপাশ ঘুরে দেখছিলাম৷ একটা জিনিস দেখে খুব খারাপ লাগল৷ হাসপাতালের ভেতরে ঢোকার সময় সিঁড়ি দিয়ে উঠেই সূর্য সেনের একটি বড় ফোটো চোখে পড়লেও, তাঁর কোনো আবক্ষমূর্তি কোথাও দেখলাম না৷ শুধু একটা পাথরের বেদি বসানো হয়েছে৷ ২০০০ সালে আওয়ামি লিগের তৎকালীন পরিবেশ ও বনমন্ত্রী সাজেদা চৌধুরি এই বেদিটি স্থাপন করেন৷ বেদির গায়ে খোদাই করা কয়েকটি কথা—‘ভারতীয় জাতীয় প্রজাতান্ত্রিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক বীর বিপ্লবী সূর্য সেন স্মরণে৷’

মাস্টারদা সূর্য সেন।

অবশ্য সূর্য সেনের নামাঙ্কিত একটি ছোট মঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছে৷ তাতে তাঁর জন্মদিন ও ফাঁসির দিনটির উল্লেখ রয়েছে৷

আবুল ফজলের বাড়ি রাঙ্গুনিয়ায়৷ এই উপজেলার গণ জাগরণ মঞ্চের আহ্বায়ক তিনি৷ ভদ্রলোক এক মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত৷ আবুল ফজল বললেন, ‘ইসলাম ধর্মের প্রধান কথাই হল : প্রতিবেশীর ‘হক’ অর্থাৎ অধিকার আগে৷ হিন্দুরা আমাদের প্রতিবেশী৷ তাদের প্রতি আমার সম্প্রদায়ের সহিষ্ণুতা দেখানো সবথেকে আগে প্রয়োজন৷ কারণ, মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশে আমরা সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী৷ শেখ হাসিনা দেশের শাসনক্ষমতায় না এলে বহু হিন্দু মারা যেত৷ অ-সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন মুসলমানরাও মারা পড়ত৷ আমি এমন ঘটনার কথাও জানি অসম্মানের হাত থেকে বাঁচতে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে হিন্দু মা নদীতে ঝাঁপ দিয়েছেন৷’
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-১: অমৃতের সন্ধানে…

সোনার বাংলার চিঠি, পর্ব-৭: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান ও মিত্র বাহিনীর বাংলাদেশ ত্যাগ

লোকনাথ বাবার ওপর একটা ডকুমেন্টারি ছবিতে আপাদমস্তক অ-সাম্প্রদায়িক অত্যন্ত ভালো মনের এই মানুষটি অভিনয় করেন৷ ২০১১ সালে ছবিটা তৈরি হয়েছিল৷ চরিত্রটি লোকনাথ বাবার এক পার্ষদের৷ লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে ভীষণ মানেন আবুল ফজল৷

বাসস্ট্যান্ড থেকে রিকশয় সূর্য সেনের পৈতৃক ভিটায় এসেছি৷ রিকশচালক ব্রজলাল দাস রিকশয় বসে না থেকে আমাদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে সব দেখছিল৷ ব্রজলালের সবকিছু জানার আগ্রহ দেখে ভালো লাগছিল৷ হাসপাতালের পূর্বদিকে বসবাসকারী গ্রামবাসীর মধ্যে হিন্দুদের সংখ্যাই বেশি৷ সূর্য সেন পল্লির হিন্দুদের পদবি ধর, দত্ত, দাস, সেন এরকম৷ করবী ধর, লিজা ধর এবং তপতী দত্ত গৃহবধূ৷ ওঁরা ছেলে-মেয়েদের নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন চিকিৎসার জন্য৷ সূর্য সেনের কথা তুলতেই করবীরা আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন৷

ব্রজলাল খবরাখবর রাখে৷ এখানে আসার সময় রাস্তায় দুটো ভাঙা মন্দির দেখেছিলাম৷ দুটো মন্দিরকেই বটগাছের ঝুরি আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে৷ দুটো মন্দিরেরই টিনের দরজা৷ ব্রজলালই বলেছিল, একটা শিবমন্দির আর একটা কালীমন্দির৷ প্রতিদিন দুটো মন্দিরেই সংক্ষেপে পুজো হয়৷
ব্রজলালের বাড়ি ছিল নোয়াখালির দক্ষিণ হাতিয়ায়৷ মেঘনা নদীর বন্যায় বাড়ি ধ্বংস হয়৷ তারপর সে সপরিবারে নোয়াপাড়ায় চলে এসেছে৷ রিকশ চালিয়ে সংসার চালানো৷ ওর মুখেই শুনেছিলাম, একসময় নোয়াপাড়ার জমিদার ছিলেন মোক্ষদারঞ্জন রায়৷ জন্ম ১৮৮১ সালে৷ মারা যান ১৯৬৬-তে৷ নোয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়, বালিকা বিদ্যালয়সহ অনেক কীর্তি তাঁর৷ মোক্ষদারঞ্জন রায়ের একটি স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে গ্রামে৷ এই গ্রামে ২০ শতাংশ হিন্দু৷

গ্রামের উঁচু-নিচু রাস্তা৷ ব্রজলাল আস্তে আস্তে রিকশ চালাচ্ছিল৷ নানা গল্প শোনাচ্ছিল আমাদের৷ গল্প শুনতে শুনতে এভাবেই পথশ্রমের ক্লান্তি বোধহয় কিছুটা দূর হয়৷ নোয়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডে বড় রাস্তার ওপর ‘ভারতেশ্বরী প্লাজা’, ঝাঁ চকচকে বহুতল৷ নানা অফিস ও দোকান এখানে৷ মোক্ষদারঞ্জন রায়ের পরিবার ‘ভারতেশ্বরী প্লাজা’-র মালিক৷ এই ধর্মপ্রাণ জমিদারের আমলে গ্রামের দুটো মন্দিরেই ধুমধাম করে পুজো হত৷

নোয়াপাড়া বাজারে ২০১৩ সালে মাস্টারদা সূর্য সেনের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে একটি তোরণ তৈরি করা হয় স্থানীয় এম পি এ বি এন করিম চৌধুরির উদ্যোগে৷ অবশ্য কেউ বলে না দিলে ওইরকম ঘিঞ্জি এলাকায় তোরণটি যে রয়েছে, তা ঠাহরও হবে না৷
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১: নারী কি আলাদা? তাঁরা পুরুষদের সঙ্গে বসতে ভয় পান? তাহলে কি এত আয়োজন শুধু তাঁদের ভয় দেখাতে…

স্বাদে-গন্ধে: একঘেয়ে চিকেন কারি আর ভালো লাগছে না? বাড়িতেই রেস্তোরাঁর মতো বানিয়ে ফেলুন মুর্গ মালাই হান্ডি

আবুল ফজলের কথাগুলো আমার মনে ভিড় করে আসছিল৷ কানে বাজছিল৷ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন,‘স্বাধীনতার আসল অর্থই ভুলে গ্যাছি৷ যাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিল, তারা এখন পথে পথে ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছে৷ বিপক্ষে যারা ছিল তারা প্রতিষ্ঠিত৷ এই স্বাধীনতা আর এরকম সংখ্যালঘু নিপীড়ন আমরা চাইনি৷ চিটাগাং-এর সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তবুও ভালো আছে৷ উত্তরবঙ্গে (বাংলাদেশের উত্তর দিকে) গিয়ে দেখুন, সংখ্যালঘুদের অবস্থা একদম ভালো না৷’

স্বদেশবাসীর উদ্দেশ্যে কারান্তরাল থেকে সূর্য সেনের শেষ বাণী এখানে তুলে দিলাম৷ এটি ইংরেজি থেকে ভাবান্তর করা৷ (গ্রন্থসূত্র : ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা৷’)

‘আমার বিদায় আশিস হল—একতা ও আদর্শ৷ ফাঁসির রজ্জু আমার জন্যে প্রস্তুত হয়ে ঝুলছে মাথার উপর৷ মরণ আমার দরজায় এসে কড়া নাড়ছে৷ চিত্ত আমার আনন্দের দিকে ধাবিত হচ্ছে৷ এই তো আমার সাধনার প্রকৃষ্ট সময়৷ বন্ধু ভেবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার এই তো সময়, আমি প্রস্তুত৷ তার সাথে আমার পিছনে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলিকে বুকে উপলব্ধি করে বলছি, এই তো সময়৷

তোমাদের সকলের কত মধুর স্মৃতি আমার কাছে রয়েছে৷ আমার প্রিয় ভাই বোনেরা, বৈচিত্র্যহীন আমার একঘেয়েমি জীবন ভেঙে তোমরা এসেছিলে আমার কাছে, কত উৎসাহ আমাকে দিয়েছিলে৷ তাই এই আনন্দময়, অতি পবিত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আমি তোমাদের জন্যে কি রেখে যেতে পারলাম? মাত্র একটি জিনিস আমি রেখে যাচ্ছি, যেটা আমার একমাত্র স্বপ্ন একটা স্বাধীন স্বদেশের স্বপ্ণ৷ ক্ষণগুলি কত শুভ মুহূর্ত পরিপূর্ণ ছিল যতক্ষণ আমি এ স্বপ্ণ দেখেছিলাম৷ সারাজীবন অমিত উৎসাহ নিয়ে উন্মত্তের মতোই আমি সে স্বপ্নটির পিছনে ছুটে বেড়িয়েছি৷ আমি জানি না তার কতটুকু সফলতা আমি পেয়েছি৷ জানি না, কোথায় গিয়ে সেই শুধু মরণ আমাকে থামিয়ে রেখে যাবে৷

….আমার প্রিয় বন্ধুরা এগিয়ে চলো, জোর কদমে এগিয়ে চলো, কখনো থেমো না৷ পিছনে পড়ে যেয়ো না৷ শৃঙ্খলের দিন অবসান হচ্ছে; ওই দেখো স্বাধীনতার লাল সূর্য পূর্বাকাশে উঁকি দিচ্ছে; উঠে এসো, জাগো সবে, হাত লাগাও৷ কখনো হতাশ হয়ো না; জয় আমাদের সুনিশ্চিত, সাফল্য আমাদের দ্বারে৷ গড (খোদা) তোমাদের মঙ্গল করুন৷ ১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিলের চট্টগ্রাম বিদ্রোহের কথা কখনো তোমরা ভুলে যেয়ো না৷ জালালাবাদ, জুলদা, চন্দননগর ও ধলঘাটের যুদ্ধের কথা সবসময় স্মরণে রেখো৷ স্বদেশের স্বাধীনতার বেদিমূলে যে সকল দেশপ্রেমিক বীরেরা যা তাঁদের অপূর্ব জীবন উৎসর্গ করে গেছেন, তাঁদের নাম তোমাদের অন্তরের গোপনতম প্রদেশে স্বর্ণাক্ষরে অঙ্কিত করে রেখো৷

আমাদের প্রিয় সংগঠনের দিকে ধ্রুব থেকো যাতে তোমাদের বিভেদ না আসে—এই আমার একান্ত আবেদন তোমরা একে অন্যের প্রিয় হয়ে থেকো৷ যারা কারাগারের পাষাণে আবদ্ধ হয়ে আছো অথবা যারা বাইরে আছো তাদের সবাইকে জানাচ্ছি আমার শুভেচ্ছা, আশীর্বাদ৷ প্রিয় বন্ধুরা বিদায়৷
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’
বন্দেমাতরম
চট্টগ্রাম জেল, ১১ জানুয়ারি, ১৯৩৪ সন্ধ্যা ৭টা।
* বাংলাদেশের জাগ্রত মন্দিরে মন্দিরে (Bangladesher Jagrata Mondire Mondire) : সুমন গুপ্ত (Suman Gupta), বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক।

Skip to content