শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার। এখানেই বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনের ফাঁসি হয়।

চট্টগ্রাম এক ঐতিহাসিক শহর৷ পরাধীন ভারতে এই জেলা থেকে ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা গর্জে উঠেছিলেন৷ বিপ্লবীদের অসীম সাহসিকতা ব্রিটিশ শাসনের ভিত নাড়িয়ে দেয়৷ মাস্টারদা সূর্য সেনের কথা কে না জানে৷ চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, পুলিশ লাইনসে ভারতের স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন, জালালাবাদ পাহাড়ে মাস্টারদার নেতৃত্বে একদল বিপ্লবীর মরণপণ সংগ্রামের ইতিহাস আজও সোনার অক্ষরে লেখা কোটি কোটি মানুষের মনে৷

বীরকন্যা শহিদ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে আজও আমরা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করি৷ তাঁর পাহাড়তলির ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ ও সায়ানাইড ক্যাপসুল খেয়ে মৃত্যুবরণের কথা ভাবলে আজও বাঙালি হিসাবে অসীম আত্মশ্লাঘা অনুভব করি৷ সেই জায়গাগুলো আমাকে ঘুরিয়ে দেখালেন তাপসবাবু৷ যেখানে অগ্ণিকন্যা প্রীতিলতা আত্মাহুতি দেন, গাছ-গাছালিতে ঘেরা ওই জায়গায় দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে মাথা নত করে স্মরণ করলাম তাঁর আত্মত্যাগের সেই গৌরবময় মুহূর্তকে৷
প্রীতিলতা বলেছিলেন, ‘মেয়েরা যে এখনও পিছিয়ে আছে তার কারণ, তাদের পিছনে রাখা হয়েছে৷ নারীরা এখন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে তারা আর পিছিয়ে থাকবে না এবং সংগ্রাম যতই কঠিন ও বিপদসঙ্কুল হোক না কেন, ভাইদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তারাও সক্রিয় অংশগ্রহণ করবে৷ আমি আন্তরিকভাবে আশা করি আমার বোনেরা আর নিজেদের দুর্বল ভাববেন না৷ এই আশা নিয়ে আমি আজ আত্মদানে অগ্রসর হলাম৷’ (গ্রন্থসূত্র: পংকজ চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা’)৷

প্রীতিলতার আত্মোৎসর্গের কথা শুনে মাস্টারদা বলেছিলেন, ‘স্নিগ্দ সুষমায় ভরা একটি পবিত্র ফুল তার পরিপূর্ণ সৌন্দর্য ঘিরে এই দীন পূজারীর কাছে এসেছিল মায়ের চরণে অর্ঘ্য হওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা নিয়ে৷ পূজারীকে কত বড়ই সে মনে করেছিল, কত বড় শ্রদ্ধার আসন তাকে দিয়েছিল মায়ের কাছে উৎসর্গীকৃত হওয়ার জন্য৷ পূজারী ফুলটিকে অতি সমাদরে গ্রহণ করেছে৷ তার নিষ্কলঙ্ক শুভ্রতায়, সৌরভে মুগ্দ হয়েছে৷ মায়ের চরণে তাকে অঞ্জলি দিয়ে তার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করেছে৷

সে আজ মায়ের কাছে চলে গেছে, মা তাকে কত যত্নে কত আদরে বুকে তুলে নিয়েছেন৷ পূজারী আজ ভগবানের নিকট মনোবাক্যে প্রার্থনা করছে সে যেন আজ ফুলের সঙ্গে তার পরিচয়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে ফুলের মহত্ত্বটুকু নষ্ট করে না ফেলে৷’
আরও পড়ুন:

আজকের আলোচনা মাধ্যমিক ইংরেজি পরীক্ষার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে — PHRASAL VERB

কিম্ভূতকাণ্ড, পর্ব-৫: জ্বলন্ত দুটো চোখ, শরীর ভাসছে অন্ধকারে, ঠোঁটের দু’পাশে রক্তাক্ত বড় দুটো দাঁত…

মায়ের কাছে লেখা প্রীতিলতার শেষ চিঠিটি এখানে উল্লেখ করলাম৷ তাঁর ডাকনাম ছিল রানী৷ ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের আগের দিন মাকে উদ্দেশ্য করে তিনি মর্মস্পর্শী ভাষায় অজ্ঞাতবাস থেকে লিখেছিলেন—
‘মাগো তুমি আমায় ডাকছিলে? আমার যেন মনে হল তুমি আমার শিয়রে বসে কেবলই আমার নাম ধরে ডাকছ আর তোমার অশ্রুজলে আমার বক্ষ ভেসে যাচ্ছে৷
মা, সত্যই কি তুমি এত কাঁদছ? আমি তোমার ডাকে সাড়া দিতে পারলাম না—তুমি আমায় ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে চলে গেলে৷

স্বপ্নে একবার তোমায় দেখতে চেয়েছিলাম, তুমি তোমার বড় আদরের মেয়ের আবদার রক্ষা করতে এসেছিলে৷ কিন্তু মা, আমি তোমার সঙ্গে একটি কথাও বললাম না৷ মা, তুমি আমায় ক্ষমা কর৷ তোমায় বড় ব্যথা দিয়ে গেলাম৷ তোমাকে এতটুকু ব্যথা দিতেও তো চিরদিন আমার বুকে বেজেছে৷ তোমাকে দুঃখ দেওয়া আমার ইচ্ছা নয়৷ আমি স্বদেশ-জননীর চোখের জল মুছাবার জন্য বুকের রক্ত দিতে এসেছি৷ তুমি আমায় আশীর্বাদ কর, নইলে আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে না৷
আরও পড়ুন:

জিভে জল আনা এমন ফুলকপির পরোটাতেই জমে যাক শীতের পাত!

ফল কালারের রূপ-মাধুরী, পর্ব-১০: আশ মিটিয়ে দেখে ছিলাম অপূর্ব সেই রূপ…আর প্রকৃতিও সেদিন সবটুকু মেলে ধরেছিল আমার সামনে

একটিবার তোমাকে দেখে যেতে পারলাম না৷ সেজন্য আমার হৃদয়কে তুমি ভুল বুঝো না৷ আমার অভাব তোমাকে যে পাগল করে তুলেছে তা আমি জানি৷

মাগো, আমি শুনেছি, তুমি ঘরের দরজায় বসে সবাইকে ডেকে ডেকে বলছ—ওগো, তোমরা দেখে যাও, আমার রানী-শূন্য রাজ্য দেখে যাও৷

তোমার সেই ছবি আমার চোখের উপর দিনরাত ভাসছে৷ তোমার এই কথাগুলি আমার হৃদয়ের প্রতি তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে কান্নার সুর বাজায়৷

মাগো তুমি এমন করে আর কেঁদো না৷ আমি যে সত্যের জন্য, স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে এসেছি৷ দেশ যে পরাধীন৷ দেশবাসী যে বিদেশীর অত্যাচারে জর্জরিত, দেশমাতৃকা যে শৃঙ্খল ভারে অবনতা, লাঞ্ছিতা, উৎপীড়িতা৷

তুমি কি সবই নীরবে সহ্য করবে মা? একটি সন্তানকে কি তুমি মুক্তির জন্য উৎসর্গ করতে পারবে না? তুমি কি কেবলই কাঁদবে৷
আরও পড়ুন:

বাংলাদেশের জাগ্রত মন্দিরে মন্দিরে, পর্ব-৪৫: শিবরাত্রিতে লক্ষাধিক মানুষ ভিড় জমান, আসেন সোমনাথ মন্দিরের সাধু-সন্ন্যাসীরা, চলে মেলা, ধর্মসভাও

যে জীবন মানেনি বাধা…

আর কেঁদো না মা৷ তুমি আর চোখের জল ফেলো না৷ যাবার আগে আর একবার তুমি আমার স্বপ্ণে দেখা দিও৷ আমি তোমার কাছে জানু পেতে ক্ষমা চাইব৷ আমি যে তোমার মনে বড়ই ব্যথা দিয়ে এসেছি মা৷

তোমার সঙ্গে আমি যে দুর্ব্যবহার করে এসেছি, সেকথা নিশ্চয়ই আজ আমার বুকে শেলের মত বিঁধে৷ ইচ্ছা হয় তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে আসি৷ তুমি আমায় আদর করে বুকে টেনে নিতে চেয়েছ, আমি তোমার হাত ছিনিয়ে চলে এসেছি, খাবারের থালা নিয়ে আমাকে কত সাধাসাধিই না করেছ, আমি পিছনে ফিরে চলে গেছি৷
মা আর পারছি না৷ ক্ষমা চাওয়া ভিন্ন আর আমার উপায় নেই৷ আমি তোমাকে দুদিন ধরে সমানে কাঁদিয়েছি, তোমার কাতর ক্রন্দন আমাকে এতটুকু টলাতে পারেনি৷

কি আশ্চর্য মা৷ তোমার রানী এত নিষ্ঠুর হতে পারল কি করে?
ক্ষমা কর মা৷ তুমি আমায় ক্ষমা কর৷’

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার এখন বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর তথ্যদপ্তর৷ চট্টগ্রাম জেলেও গিয়েছিলাম, যেখানে মাস্টারদার ফাঁসি হয়েছিল৷

তাপসবাবু বললেন, ‘আপনি যখন আরও দু-চারদিন এখানে থাকছেন, রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া গ্রামে মাস্টারদার জন্মস্থান পারলে একবার দেখে আসবেন৷ চট্টগ্রাম শহর থেকে ৩০ কিমি দূরে৷ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের পৈতৃক বাড়ি এই জেলারই ধলঘাট গ্রামে (উপজেলা-পোটিয়া)৷’

তাঁর কাছেই শুনলাম, উত্তর ২৪ পরগনার বারাসাত স্টেডিয়ামের মূল প্রবেশ পথের দু-পাশে বিপ্লবী সূর্য সেন এবং প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের আবক্ষ মূর্তি বসানো হয়েছে৷ ওই অনুষ্ঠানে তাপসবাবু উপস্থিত ছিলেন৷ এমনকী গোবরডাঙায় হরিপদ দে নামে এক সমাজসেবী প্রীতিলতার নামে সুকল, কলেজ তৈরি করে দিয়েছেন৷ প্রীতিলতার জন্মশতবর্ষ পালিত হয় ২০১১ সালের ৫ মে৷

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
সৌজন্যে দীপ প্রকাশন
* বাংলাদেশের জাগ্রত মন্দিরে মন্দিরে (Bangladesher Jagrata Mondire Mondire) : সুমন গুপ্ত (Suman Gupta), বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক।

Skip to content