শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


নাটমন্দির থেকে শ্রীশ্রীঢাকেশ্বরী মন্দিরের গর্ভগৃহ।

সাহিত্য, সংস্কৃতি, রুচি, ঐতিহ্যবোধ—এপার বাংলা এবং ওপার বাংলার বৈচিত্রময় পারস্পরিক সম্পর্ক অটুট। বৈচিত্রময় ওপার বাংলায় অসংখ্য মসজিদ এবং মাজারের পাশাপাশি কিন্তু ইতিহাসপ্রসিদ্ধ কিছু ঐতিহ্যবাহী মন্দির এবং দেবী সতীর একান্ন পীঠের অন্যতম কয়েকটি পীঠও পড়ছে এখানকার কিছু অঞ্চলে। এই তীর্থক্ষেত্রগুলিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মধ্যেকার পারস্পরিক ধর্মীয় বিশ্বাসের আদানপ্রদানগত সম্পর্কের বৈচিত্রময় কাহিনিই এবার উঠে আসবে পরিব্রাজক লেখক ও সাংবাদিক সুমন গুপ্ত-র কলমে। তার ধারাবাহিক ‘বাংলাদেশের জাগ্রত মন্দিরে মন্দিরে’র মধ্য দিয়ে।

পর্ব-২

এদিকে সন্ধ্যা প্রায় নেমে এসেছে৷ পড়শি দেশ হলেও সময়ের হিসেবে বাংলাদেশে ঘড়ির কাঁটা আধঘণ্টা এগিয়ে৷ উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁয় পেট্রাপোল-বেনাপোল সীমান্ত পেরিয়ে যশোরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে যখন ঢুকেছিলাম, আমার হাতঘড়ির সময়ও আধঘণ্টা এগিয়ে রেখেছিলাম৷ এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সময় সন্ধ্যা সোয়া ৬টা৷ ঠিক পৌনে এক ঘণ্টা পরে সন্ধ্যা ৭টায় ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সন্ধ্যারতি শুরু হবে৷

নাটমন্দিরে ঢাকের সুমধুর বোল, কাঁসর-ঘণ্টার পবিত্র ধ্বনি মন্দির প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে ক্রমশ চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়বে৷ মাথায় ঘোমটা, কপালে সিঁদুর, হাতে শাঁখা-পলা পরা ধর্মপ্রাণ হিন্দু মহিলাদের শঙ্খ ও উলুধ্বনিতে চারপাশে তখন এক ভক্তিময় পরিবেশ রচিত হয়৷ গর্ভগৃহে পূজারির হাতের পঞ্চপ্রদীপের প্রকম্পিত আলো ও অন্যান্য উপকরণের সাহায্যে ঢাকেশ্বরী দেবীর সন্ধ্যারতি একসময় সু-সম্পন্ন হবে৷ সত্যি কথা বলতে কী, গত কয়েকদিন ধরে এই মন্দিরের সন্ধ্যারতির এক নিটোল ছবি আমাকে যেন পুরোপুরি আবিষ্ট করে রেখেছে৷

আরতি শুরু হতে তখনও কিছুটা সময় বাকি৷ গর্ভদেউলের বারান্দায় ঝাড়বাতির গায়ে নিয়ন আলো এসে ঠিকরে পড়ায় চিকচিক করছে৷ মার্চের শেষাশেষি, ঢাকায় বেশ গরম পড়েছে৷ ঝাড়বাতির খানিকটা তফাতে সাঁইসাঁই করে একটা সিলিং ফ্যান ঘুরছে৷ একটা দেওয়ালঘড়িও আছে৷ ১২টি গোলাকৃতি স্তম্ভের ওপর লম্বা-চওড়া নাটমন্দিরের সিলিঙের উচ্চতা যথেষ্টই৷ অনেকগুলো সিলিং ফ্যান ঝুলছে৷
নাটমন্দিরের প্রবেশদ্বারে সিলিং থেকে একটা বড় পিতলের ঘণ্টা ঝুলছে৷ গর্ভদেউলে আসা-যাওয়ার পথে অনেক দর্শনার্থীই ঘণ্টাটি বাজান৷ বড় বড় সবুজ দামি টাইলসে ঢাকা নাটমন্দিরের মেঝে, এক জায়গায় সামান্য উঁচু হয়ে দক্ষিণ বরাবর চলে গিয়েছে৷

নাটমন্দিরের দক্ষিণের একদম শেষপ্রান্তে ঢাকেশ্বরী দেবীর উদ্দেশে মোমবাতি ও ধূপকাঠি জ্বালিয়ে রাখার জন্য বালি ভরা লম্বা একটা টিনের পাত্র৷ সেই মুহূর্তে দুই সহোদরা ঝর্ণা রায় ও সমাপ্তি রায় মোমবাতি ও ধূপকাঠি জ্বালিয়ে করজোড়ে ঢাকেশ্বরী দেবীকে প্রণাম করছেন৷ সঙ্গে ঝর্ণাদেবীর ছোট্ট মেয়ে৷ সে-ও একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে মায়ের দেখাদেখি করজোড়ে দাঁড়িয়ে৷ ওঁরা প্রায়ই মন্দিরে আসেন৷ আজ সন্ধ্যারতি দেখে তারপর গ্রিন রোডের বাড়িতে ফিরবেন৷ সমাপ্তি কলেজে পড়েন৷ ভারী মিষ্টি দেখতে৷ ঝর্ণাদেবীর মুখে শুনলাম, সমাপ্তি পড়াশুনোয় ভালো৷ বরাবর ভালো রেজাল্ট করে আসছেন৷ ভবিষ্যতে অধ্যাপনার ইচ্ছা তাঁর৷

নাটমন্দিরের এক কোণে বসেছিলাম৷ গর্ভদেউলে ঢোকার মুখেই যে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা লাগানো রয়েছে, সেটা এপাশ-ওপাশ ঘুরছিল৷ নাটমন্দির থেকে সরাসরি প্রাচীর দেওয়া প্রাঙ্গণের অনেকখানি দৃশ্যমান৷ দেখলাম, বোরখা পরা চারজন মুসলমান মহিলা নাটমন্দিরের দিকে হেঁটে আসছেন৷ ঢাকেশ্বরী মন্দিরের একমাত্র সেবাইত প্রবীণ ভদ্রলোক প্রদীপকুমার চক্রবর্তীর মুখে আগেই শুনেছিলাম, এই মন্দিরে প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে জাতপাত বলে কিছু নেই৷ যে কোনও ধর্মের মানুষ এখানে আসতে পারেন৷ পুজোও দিতে পারেন৷

সময় ও বাংলাদেশের অস্থির সামাজিক প্রেক্ষাপট সম্যক বিবেচনা করে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ঢাকেশ্বরী সমগ্র বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্বপ্রধান মন্দির হিসেবে আজ এক অনন্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত৷ যদিও এখনও পর্যন্ত সরকারি গেজেটে উল্লেখ নেই, তবুও বেসরকারিভাবে ঢাকেশ্বরী বাংলাদেশের ‘জাতীয় মন্দির’ হিসেবে স্বীকৃত৷ মন্দিরের সিংহদ্বারটি নওবতখানা তোরণ নামে প্রসিদ্ধ৷ এখানে গ্লো-সাইন বোর্ডে ‘জাতীয় মন্দির’ লেখা শব্দদুটো জ্বলজ্বল করছে৷ মন্দিরটি সমাজের বহু বিবর্তনের নীরব সাক্ষী৷ হিন্দু সম্প্রদায়ের ঐক্যবোধের চেতনা এই মন্দিরকে ঘিরেই আরও শক্তিশালী হয়েছে৷

বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের অন্যান্য মন্দিরের সঙ্গে ঢাকেশ্বরীর তফাত হচ্ছে, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে প্রায় চার দশক ধরে ঢাকেশ্বরীকে ঘিরে সমানাধিকার ও সমমর্যাদার দাবিতে বারবার সোচ্চার হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়৷ দুঃখের কথা যা আজও অধরা৷

মন্দির প্রাঙ্গণের দুটো দোকানে পুজোর হরেকরকম জিনিস, সিঁদুরের কৌটো ও শাঁখা-চুড়ি কিনতে ভিড় করেছেন হিন্দু মহিলারা৷ নাটমন্দিরে আসার পথে ওই চারজন মুসলমান মহিলা বেশ আগ্রহের সঙ্গে বেচাকেনা লক্ষ করে নিজেদের মধ্যে কিছু বলাবলি করছিলেন৷ ভেবেছিলাম, তাঁরা মন্দির প্রাঙ্গণ থেকেই বিদায় নেবেন৷ আমি অবাক হয়ে দেখলাম, এতটুকুও ইতস্তত না করে উত্তর-পশ্চিমের দরজা দিয়ে তারা নাটমন্দিরে ঢুকলেন৷

দেখে মনে হল, প্রত্যেকেই অবস্থাপন্ন ঘরের৷ এপাশে-ওপাশে মিনিট কয়েক ঘোরাঘুরি করলেন৷ তারপর সোজা গর্ভদেউলের সামনে গিয়ে শ্রদ্ধামিশ্রিত মন ও বিস্ময়ভরা চোখে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে ঢাকেশ্বরী মূর্তিকে দেখে নাটমন্দির থেকে বেরিয়ে গেলেন৷ সেবাইত প্রদীপবাবু আমাকে বলেছিলেন, ‘ঢাকেশ্বরী মন্দিরে এসে হিন্দুদের মতো মুসলমানরাও মানত করেন৷ মানত পূরণ হলে ঢাকেশ্বরী দেবীকে পাঁঠা, মুরগি বা কবুতর নিবেদন করেন৷ মানতের পাঁঠাবলি হয়৷ কিন্তু মুরগি ও কবুতর বলি হয় না৷ মুরগি মন্দিরের স্টাফরা নেন৷ কবুতর উড়িয়ে দেওয়া হয়৷ পক্সের সময় ঢাকেশ্বরী দেবীর চরণামৃত খান অনেক মুসলমান৷ তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, দেবীর চরণামৃত খেলে পক্সে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম৷ আবার কোনও আক্রান্ত ব্যক্তিকে উপযুক্ত চিকিৎসার পাশাপাশি এই চরণামৃতও খাওয়ানো হয়৷ ঢাকেশ্বরী দেবীর প্রতি এতটাই বিশ্বাস মুসলমান সম্প্রদায়ের৷ হিন্দুরাও তো দরগায়, মাজারে গিয়ে মানত করেন৷ আমার ধারণা বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার ব্যাপারে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের একটা বিশেষ ভূমিকা রয়েছে৷ বাংলাদেশে সবধর্ম সমন্বয়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুণ্যক্ষেত্র এই মন্দির৷’

কারও মানতের ছাগবলি যে কোনওদিন হতে পারে৷ তবে এখন নাটমন্দির থেকে হাড়িকাঠ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে৷ খোলা জায়গায় আর ছাগবলি হয় না৷ দুর্গাপুজোর সময় অষ্টমী ও নবমীতে পাঁঠাবলি হয়৷ কালীপুজোর দিনও পাঁঠাবলি হয়৷

এই দিনগুলোতে প্রথম পাঁঠাবলি মন্দিরের তরফে৷ তবে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে মনসা পুজোয় বেশি পাঁঠাবলি হয়, একশোর কাছাকাছি তো বটেই৷ প্রধানত চট্টগ্রামের লোকেরাই মনসা পুজোয় পাঁঠাবলি দেন বেশি৷ —চলবে

সৌজন্যে দীপ প্রকাশন


Skip to content