শুক্রবার ৫ জুলাই, ২০২৪


সকালের সৈকত।

কলকাতার তরুণ প্রজন্ম বর্তমান বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চায়, বাংলাদেশকে চিনতে চায়। তাঁদের আগ্রহ আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। কলকাতা, হুগলি, শান্তিনিকেতন যেখানে গিয়েছি, তরুণরা জানতে চেয়েছেন বাংলাদেশে কক্সবাজার যেতে হলে ঢাকা থেকে কোন ট্রেন ধরতে হবে? অনলাইনে পাওয়া ঝিনুকের আদলে গড়া কক্সবাজার রেলওয়ে স্টেশনের ছবি দেখিয়ে বলেছে, অসাধারণ সুন্দর রেলওয়ে স্টেশন।

ট্রেনের তথ্য অনলাইনে না পেয়ে অনেকে হতাশা ব্যক্ত করেছে। সংক্ষেপে বলতে হয়েছে, শীঘ্রই ট্রেন পরিষেবা চালু হবে, মাত্র রেললাইন বসেছে। ভারতের মতো আমাদের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা অত শক্তিশালী নয়। আমাদের বাস পরিষেবা উন্নতমানের। আমার জবাবে, তরুণেরা সন্তুষ্ট হয়েছেন কি না জানি না। তবে তাঁদের আগ্রহ আর আলাপে একটা আলাদা উচ্ছ্বাস লক্ষ করেছি। বাংলাদেশের পর্যটন নগরী কক্সবাজারের নাম হয়তো কলকাতায় সবাই জানেন। কিন্তু জানেন না যে, এখানে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক বালুকাময় সমুদ্র সৈকত, যা প্রায় ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। কক্সবাজার পৃথিবীর দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সৈকত, দৈর্ঘ্যে ১২০ কিলোমিটার। ব্রাজিলের ২১২ কিলোমিটার দীর্ঘ কাসিনো সমুদ্র সৈকত বিশ্বের প্রথম এবং অস্ট্রেলিয়ার ১৫১ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত বর্তমানে পৃথিবীর দ্বিতীয় দীর্ঘতম সৈকত।

ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াতে পারেন।

তবে তার বেশ কিছু অংশ মানুষের সৃষ্ট বা কৃত্রিম। সেই হিসেবে কক্সবাজার তৃতীয়। কাদামুক্ত সম্পূর্ণ বালুকাময় দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সৈকত শুধু কক্সবাজারেই রয়েছে। তাই কক্সবাজার পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয়। কোথাও কৃত্রিমতা নেই, কাদা নেই, রূপোলি ঢেউয়ের দেশ কক্সবাজার। সমুদ্র পাহাড় পরিবেষ্টিত কক্সবাজারের নৈসর্গিক সৌন্দর্য অবলোকন করতে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ভ্রমণ পিপাসুরা এখানে ভিড় করে। সমুদ্রের সুবিশাল ঢেউ, মন চঞ্চল করা সৈকত, সাগরের জলে জলকেলি, সবুজ ঝাউবীথি, দৃষ্টিনন্দন হোটেল মোটেল, রঙ্গিন ছাতার নীচে বিশ্রামের ছোট ছোট চৌকি, বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছের রেসিপি, আকর্ষণীয় সব খানা-পিনার সুব্যবস্থা পর্যটককে উতলা করে তোলে।

প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের শৈল্পিক সব আয়োজনে ভ্রমণ পিপাসুরা মুগ্ধ হয়। লাবণী বিচ, সুগন্ধা বিচ, কলাতলী বিচ ছাড়াও কক্সবাজার শহরের সঙ্গেই রয়েছে হিমছড়ি সৈকত, একটু দক্ষিণে প্রায় ১০-১২ কিলোমিটার জুড়ে ইনানি প্রবাল বা পাথুরে সৈকত। সুদৃশ্য মেরিন ড্রাইভ রোড ধরে সহজেই ইনানি প্রবাল গঠিত সৈকতে যাওয়ার সুব্যবস্থার কারণে পর্যটনের জন্য এই সৈকত খুব আকর্ষণীয়।
সেন্টমার্টিন দ্বীপের মতো এখানেও প্রবাল পাথরের দেখা মেলে। চমৎকার ছিমছাম নিরিবিলি সমুদ্র সৈকত ইনানি খুব সুন্দর। এখানে দাঁড়িয়ে বা পাথরের উপর বসে পর্যটকেরা সাগর দেখে। সূর্য উদয় ও সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য এখানে আনন্দ চিত্তে উপভোগ করা যায়। ইচ্ছে হলে অদূরে দ্বীপ সেন্টমার্টিনেও ঘুরে আসা যায়, বিভিন্ন ট্যুর প্রোগ্রাম সবসময় তৈরি থাকে, আছে জাহাজের সুব্যবস্থা।

পাশের উপজেলা রামুতে রয়েছে প্রাচীন বৌদ্ধ পল্লী ও সুপ্রাচীন ঐতিহাসিক বৌদ্ধ বিহার। সেখানে একশত ফুট দীর্ঘ সিংহশয্যায় গৌতম বুদ্ধের মুর্তি রয়েছে। চেরাংঘাটা বড় কেয়াং, রাইখেনদের কেয়াং, লামারপাড়া প্রাচীন কেয়াং, মেরুংলোয়া কেন্দ্রীয় সীমা বিহার ও রাংকুট বনাশ্রম বৌদ্ধ বিহার। রাংকুট বাংলাদেশে অন্যতম বৌদ্ধ বিহার, যা মৌর্য বংশের তৃতীয় সম্রাট অশোকের সময়ের বলে ধারণা করা হয়। এখানে আছে প্রাচীন ঐতিহ্যের স্মৃতি চিহ্ন এবং পাশে রাম সীতার বনবাসের পূর্ণ্য স্মৃতি বিজড়িত কিছু মন্দির।
আরও পড়ুন:

সোনার বাংলার চিঠি, পর্ব-১: প্রায় ৭০ একর পাহাড়ী বনভূমির মন্দিরে মহালয়াতেই দেবীপক্ষের সূচনা হয়

সঠিক ত্বকের যত্নে যেমন রোদ এড়াতে হবে, তেমনি আবার রোদ লাগাতেও হবে

বাংলাদেশের জাগ্রত মন্দিরে মন্দিরে, পর্ব ৩১: বন্ধুসুন্দর সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘ক্ষীরোদা, তুই সরযূর জন্য দুঃখ করিসনে, তোর গর্ভে জন্ম নিয়ে সে শাপমুক্ত হয়েছে…

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৩৮: পাণ্ডবেরা চললেন তীর্থে

ইনানি সৈকতে পর্যটক সমাগম।

কক্সবাজার বাংলাদেশের বৃহত্তম সামুদ্রিক মৎস্য বন্দর ও শুকনো মাছ শুঁটকির জন্য বিখ্যাত। শুঁটকি মাছ অনেকের প্রিয় খাদ্য। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তার চাহিদা আছে। কক্সবাজারের আদি নাম হচ্ছে পালংকি। এক সময় প্যানোয়া নামেও ডাকা হতো। প্যানোয়া মানে হলুদ ফুল। অতীতে এই এলাকায় প্রচুর হলুদ ফুল ঝলমল করতো। ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স এর নামে ব্রিটিশ আমলে ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে একটি বাজার স্থাপন হয়েছিল। সেই থেকে অন্যসব পরিচিতি ক্রমে মুছে গিয়ে হয়েছে এই কক্সবাজার।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স তৎকালীন গভর্নর ওয়ারেন্ট হোস্টিং কর্তৃক এই পালংকির শাসক নিযুক্ত হন। ক্যাপ্টেন কক্স আরকান শরনার্থী এবং স্থানীয় রাখাইনদের মধ্যে বিদ্যমান পুরাতন সংঘাত নিরসনে কাজ করেন এবং সফল হন। তার এই অবদানকে স্মরণ করে প্রতিষ্ঠিত হয় কক্স সাহেবের বাজার।

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতকে লেখক।

মুঘল আমলে কক্সবাজার আরকান রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল। নবম শতাব্দীতে হরিকেলের রাজার দ্বারা শাসিত চট্টগ্রামসহ কক্সবাজার ৯৩০ খ্রিস্টাব্দে আরাকানের রাজার অধীনে যায়। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে মুঘলেরা দখলে নেন। মুঘল সম্রাট শাহ সুজা পাহাড়ী রাস্তা ধরে আরাকান যাওয়ার পথে কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এখানে একটি ক্যাম্প স্থাপনের আদেশ দেন। মুঘলদের পরে আরাকান ও কিছুদিন পুর্তগীজরা এই এলাকা শাসন করেছে। পরে ব্রিটিশ আমলে এই এলাকা পর্যটনের জন্য পরিচিতি লাভ করে। ১৮৫৪ সালে কক্সবাজার থানা প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে মহকুমা। এখন কক্সবাজার জেলা। পাশের টেকনাফ, উখিয়া ও মহেশখালি উপজেলায় রয়েছে বিভিন্ন বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান। মহেশখালি বিখ্যাত আদিনাথ শিব মন্দির হিন্দু সম্প্রদায়ের পবিত্র তীর্থ। এই মন্দিরে প্রচুর পূর্ণ্যাথীর সমাগম হয়।

অসাধারণ সুন্দর রেলওয়ে স্টেশন।

কথিত আছে রাক্ষস রাজা রাবণ হিমালয়ের কৈলাশ থেকে শিবলিঙ্গ লঙ্কায় নিতে গিয়ে এখানে বিশ্রাম করেন। পরে এই শিবলিঙ্গ মাটি থেকে তুলতে রারণ ব্যর্থ হন। সেই থেকে এই আদিনাথ শিব মন্দির, যা হিন্দুদের অন্যতম তীর্থ ভূমি। সব তীর্থ পরিভ্রমণের পর যদি আদিনাথে না আসে, তা হলে কোন পূণ্য হবে না বলে হিন্দুরা বিশ্বাস করেন। সমুদ্র পৃষ্ঠের উপর এই মহেশখালি দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনোমুগ্ধকর। টেকনাফে রয়েছে কুমারী মাথুনের মৃত্যুকূপ। যা চিরন্তন প্রেমের স্মৃতি চিহ্ন। উখিয়ায় রয়েছে প্রাচীন বৌদ্ধ সভ্যতার স্মৃতি বৌদ্ধ কেয়াং ও জাদি।

কাদামুক্ত সম্পূর্ণ বালুকাময় দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সৈকত শুধু কক্সবাজারেই রয়েছে।

মূলত, পর্যটন শিল্পকে কেন্দ্র করে এই শহর ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন সময়ে সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে নির্মিত হয়েছে অনেক হোটেল, মোটেল, রিসর্ট। বর্তমানে সৈকত ঘেষেই রয়েছে কয়েকটি পাঁচ তারকা মানের হোটেল। আছে সামুদ্রিক বিভিন্ন জিনিসের সমাহারে ঝিনুক মার্কেট এবং শৌখিন জিনিসপত্রের বার্মিজ মার্কেট নামের বিপনী বিতান। বার্মিজ মার্কেট নামে খ্যাত এই সব মার্কেটে মায়ানমার, তাইল্যান্ড ও চিনের বাহারী সব জিনিসপত্র পাওয়া যায়। পর্যটকদের জন্য এখানে বাড়তি সব অনুসঙ্গ যুক্ত হয়েছে। বিশাল ফিস অ্যাকুরিয়াম, প্যারাসেলিং, ওয়াটার বাইকিং, বিচ বাইকিং, কক্স কার্নিভাল সার্কাস শো, দরিয়ানগর ইকোপার্ক, কমিউনিটি বিল্ডিং, স্ন্যাক্স বার-সহ কত সব বিনোদনের ব্যবস্থা। বিশ্বের সবমানের বিনোদন এখানে দিন দিন সহজলভ্য হচ্ছে। কক্সবাজারে রেল চালু হলে পর্যটনের আরেক নতুন দিগন্ত সূচিত হবে। সরকার কক্সবাজার বিমান বন্দরকে আরো আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের করে গড়ে তুলছে। সাগরের বুকে বিমান অবতরণের দৃশ্যটিও অনেক আকর্ষণীয় সুন্দর।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ১৬: রাম-পরশুরাম দ্বৈরথ অযোধ্যার পথে

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৪: কবি যখন শিক্ষক

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪: ধীরে চলো ‘ওরে যাত্রী’ [০২/০২/১৯৫১]

ছোটদের যত্নে: আপনার সন্তান কি প্রায়ই কাঁদে? শিশুর কান্না থামানোর সহজ উপায় বলে দিচ্ছেন ডাক্তারবাবু

কক্সবাজারে বিভিন্ন উপজাতি বা নৃ-ত্বাত্তিক জনগোষ্ঠী বাস করে, যা কক্সবাজারকে করেছে রঙিন ও বৈচিত্র্যময়। উপজাতিদের মধ্যে রাখাইন সম্প্রদায় সংখ্যায় বেশি। তাঁদের দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন শপিং মল ও মার্কেটে পর্যটকদের ভিড় লক্ষ করা যায়। তারা খুবই দরদ দিয়ে ক্রেতাদের সন্তুষ্ট করতে চায়। তাঁদের সদাহাস্য মুখ ও মার্জিত ব্যবহারে পর্যটকেরা সন্তুষ্ট হয়। নিজস্ব সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যময় পোষাক ও জীবনধারার প্রতি তাদের অনুরাগ এবং শ্রমের ফলে তারাও পর্যটনের একটি বিরাট অনুসঙ্গ। কক্সবাজার শহরে রয়েছে তাদের ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ মন্দির। শহরের মূল মন্দিরটিতে রয়েছে দূর্লভ কিছু বুদ্ধ মুর্তি ও হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্যের চিত্রপট। এই মন্দির এবং রাখাইনদের সাংস্কৃতি পর্যটকদের আকর্ষণ করে। কক্সবাজার স্বাস্থ্যকর স্থান হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পর্যটন শিল্পে যা কিছু আয় তার মূলে রয়েছে কক্সবাজার। তাই, বহির্বিশ্বে কক্সবাজার একটি পরিচিত নাম ও তরুণদের পছন্দের পর্যটন স্পট।
* সোনার বাংলার চিঠি (Letter from Sonar Bangla, Sonar Banglar Chithi, Bangladesh) : অরুণ শীল (Arun Shil) কবি ও সাহিত্যিক। তিনি প্রধানত শিশু-কিশোর সাহিত্যের লেখক। শুরুতে গণমুখী ছড়া লিখে তুখোড় ছড়াকার হিসেবে পরিচিতি পেলেও মায়াবী, কোমল এবং স্বপ্নময় কিশোর কবিতা লিখে খ্যাতিমান হয়েছেন। ছড়া, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ নিয়ে এ পর্যন্ত তাঁর ২২টি বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রবন্ধ, ফিচার লিখেও তিনি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। পেয়েছেন বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সম্মাননা ও পুরস্কার।

Skip to content