মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪


রাজধানী ঢাকায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সম্মুখভাগ।

বাংলাদেশে শিশু-কিশোর ও তরুণ বই পড়ুয়াদের প্রিয় প্রতিষ্ঠানের নাম ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র’। সে এক আচার্য আলোর পৃথিবী, বইয়ের জন্য ভালোবাসা। বই পড়েও যে কত পুরস্কার পাওয়া যায়! সেই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান কত বিশাল আয়োজনের হতে পারে! সেখানে দেশের শ্রদ্ধেয় বরেণ্য জনেরা উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠানকে ঝলমলে করে তুলতে পারেন, তা কেমন হতে পারে! বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অনুষ্ঠান না দেখলে অনুমান করা সহজ হবে না।

পুরস্কার প্রাপ্তদের সঙ্গে অতিথিবৃন্দ।

একবার ভাবুন তো, বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় দেশ ভিত্তিক উৎকর্ষ কার্যক্রমের আওতায় প্রায় ২০ হাজার স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় ২৫ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই পড়ছে। সেখানে চিরায়ত শিশুসাহিত্যের সঙ্গে বিশ্বের বিখ্যাত সব লেখকের বইয়ের অনুবাদ, বয়স ও শ্রেণি অনুযায়ী সাজানো হয়েছে। আছে সব ধর্মের বইও। ছোটরা যেন শুরু থেকে আনন্দের সঙ্গে বই পড়তে চায়, তারা যেন বই বিমুখ হয়ে না পড়ে সে জন্য কেন্দ্রের খুব সতর্ক ভাবে কাজ করছে। ছাত্র-ছাত্রীরা সারা বছরে বা ২২ সপ্তাহে ১৬টি বই পড়ে। প্রতিটি বই পড়ে একটি খাতায় পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখতে হয়। সেরা পাঠপ্রতিক্রিয়া পুরস্কার পায়। পড়া বইগুলো নিয়ে বছর শেষে একটি উন্মুক্ত মূল্যায়ণ বা পরীক্ষা হয়। এখানে প্রশ্নের উত্তরের উপর ভিত্তি করে যারা ৭টি বই পড়েছে তাদের জন্য ‘স্বাগত পুরস্কার’, ১০টি বই হলে ‘শুভেচ্ছা পুরস্কার’ আর ১৩টি বইয়ে অভিনন্দন পুরস্কার দেওয়া হয়। পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয় মূল্যবান ও আকর্ষণীয় সব বই। সঙ্গে থাকে আরও কত আয়োজন।
হাজার কচি কাঁচার কলকাকলীতে মুখরিত বর্ণাঢ্য সাজে সজ্জিত পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান দেখতও অভিভাবক-সহ স্কুলের শিখক-শিক্ষিকারা আসেন। তাঁদের জন্যও থাকে বই পুরস্কার। একশো দুশো টাকা নয়, তাঁদেরও দেওয়া হয় হাজার টাকার বই পুরস্কার। তাহলে বই পড়তে কে না উৎসাহিত হবে? তাই দিন দিন বই পড়ুয়াদের সংখ্যা বাড়ছে বাড়ছে।

এ-তো গেল দেশ ভিত্তিক মানসিক উৎকর্ষ কার্যক্রমের কথা। আরও কত প্রকারের যে কার্যক্রম আছে, তার সঙ্গে জড়িয়ে আরও কত লোকজন বই পড়ছে তার হিসেব কেন্দ্রের কাছে নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু তার পরিসংখ্যান লিখে আপনাদের বিরক্তির কারণ হতে চাই না। আমি শুধু আনন্দ সংবাদটুকু আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই। অন্যান্য কর্মসূচির সঙ্গে দেশের যুব সমাজ থেকে বয়োবৃদ্ধ পর্যন্ত বিভিন্ন পেশার লোকজন আনন্দের সঙ্গে বই পড়ছেন। কেন্দ্রের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করছেন। এখানে প্রতিজন পড়ুয়া নিজেকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের একজন সম্মানিত সদস্য ভাবতে পছন্দ করেন। গর্ববোধ করেন, ভালোবাসেন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রকে নিজের ভাবছেন। এটা কি সহজ কথা!

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়িদ।

‘আলোকিত মানুষ চাই’ শ্লোগান সামনে রেখে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র বইপড়া কর্মসূচিগুলোকে বিভিন্ন নামে, বিভিন্ন কর্মতৎপরতায় আলাদা আলাদা পরিচয়ে পরিচালনা করছে। তার সঙ্গে যুক্ত আছে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি। সরকারি ও বেসরকারি যৌথ ব্যবস্থাপনায় এমন কর্মসূচি বিশ্বে খুব বেশি দেশে নেই। বইপড়ার অভ্যাসকে উৎসাহিত করার জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রালয় বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতায় করছে। বই পড়তে ইচ্ছে হলে সব বই তো কিনে পড়ার আর্থিক সার্মথ্য সবার থাকে না। সামর্থ্য থাকলেও পছন্দের বইটি চট করে হাতে পাওয়াও সহজ নয়। তাই মানুষ গণগ্রন্থাগার বা লাইব্রেরিতে যায়।
আরও পড়ুন:

সোনার বাংলার চিঠি, পর্ব-৪: পাঠক, লেখক ও শুভাকাক্ষীদের অনুপ্রেরণায় দেশের সর্বত্র পৌঁছে যাচ্ছে বইয়ের জাহাজ বাতিঘর সম্রাজ্যের দীপ্তি

ফিল্ম রিভিউ: ‘হাওয়া’য় ভেসে গেল বাঙালি

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১০: কান্না-হাসির দোল দোলানো ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ [২০/০২/১৯৫৩]

যোগা-প্রাণায়াম: বাহু ও পিঠে বেশ ফ্যাট জমছে? ছিপছিপে থাকতে নিয়মিত যোগাভ্যাস করুন

যদি গোটা লাইব্রেরিটা আপনার কাছে চলে আসে তবে কেমন আনন্দ হবে? সারা দেশে সবচেয়ে বেশি সাড়া ফেলেছে এই গোটা লাইব্রেরি পাঠকের কাছে চলে যাওয়ার বিষয়টি। ভ্রাম্যমাণ বা মোবাইল লাইব্রেরির ছোট, মাঝারি, বড় বিশাল সব বাস রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন উপজেলায় বই পড়ুয়াদের দোরগোড়ায় বই পৌঁছে দিচ্ছে। বই পড়ুয়ারা সামান্য খরচে সদস্য হয়ে বাড়িতে নিয়ে বই পড়ছেন। সহজে সেবা পেয়ে সবাই আনন্দের সঙ্গে পছন্দের বই বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন, অর্ডার করছেন। কিনছেন। এ সব নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, র্যা লি, পাঠচক্র ইত্যাদিতে মেতে আছে। এই কর্মসূচির মাধ্যমে হাজার তরুণের কর্মসংস্থান হয়েছে। আর কত তরুণ শুধু ভালোবাসার টানে স্বেচ্ছায় বই পড়ার কর্মসূচির কাজ করছে। তার হিসাব বা পরিসংখ্যান অনেক বড়। একটা জাতিকে জাগিয়ে দিতে একটা প্রজন্মকে বইমুখী, সাহিত্য সংস্কৃতিমুখী করতে বা বোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ধারাবাহিক কাজ করছে।

চট্টগ্রামের পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে তৎকালীন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন এবং অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়িদ-সহ অন্য অতিথিদের সঙ্গে লেখক।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়িদ স্যার বলেন, ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র বাংলাদেশে শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়। এটি দেশব্যাপি একটি আন্দোলন। আলোকিত চিত্তের একটি বিনীত নিশ্চয়তা, মানব বিজ্ঞানে সামগ্রিক চর্চা এবং অনুশীলনের পাশাপাশি হৃদয়ের উৎকর্ষ ও জীবনের বহু বিচিত্র কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে উচ্চতর শক্তি ও মনুষ্যত্বে বিকশিত হবারএক স্বপ্রাণ পৃথিবী।

কেন্দ্রের লাইব্রেরি।

৭ ডিসেম্বর’ ১৯৭৮। মাত্র ১৫ জনের ছোট্ট পাঠচক্র। প্রতি সপ্তাহে একটি নির্ধারিত বই বাড়িতে নিয়ে পড়ে সপ্তাহে এক নির্দিষ্ট দিনে মিলিত হতেন এক তপ্ত মুখর অন্তরঙ্গ আলোচনায়। বইগুলোর ভিতর লেখকের যে আত্মার আলো জ্বলছে তার সঙ্গে নিজেদের বহুমুখী বোধের আলো মিশিয়ে তাঁরা জেগে উঠবেন উচ্চতর মানবিক সমৃদ্ধির দিকে। এই ছিল স্বপ্ন বা প্রত্যাশা।

পাঁচ বৎসর পর এই পাঠচক্রের আশাতীত সাফল্য দেখে দেশের প্রতিটি স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় পাঠচক্র করবেন, এই স্বপ্ন দেখেন অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়িদ। তিনি চিন্তা করলেন, বই পড়ার পাশাপাশি নানামুখী সাংস্কৃতিক কর্মসূচির ভিতর দিয়ে তাদের উৎকর্ষ ও পরিশীলিত মেধা ও হৃদয়ের উচ্চতর বিকাশ অবশ্যই সম্ভব।
আরও পড়ুন:

নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব -২৩: প্রায় সাত মাস ধরে ‘ম্যাকবেথ’ নাটকের রিহার্সাল চলেছিল

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৪২: মহাসমুদ্রের জলপান করলেন অগস্ত্যমুনি

দশভুজ: দেবীপক্ষের প্রাককালে তিনিই তো দুর্গা…

ফল কালারের রূপ-মাধুরী, পর্ব-৬: গাড়ির সান রুফ খুলে চালিয়ে দিলাম ‘সুহানা সফর হ্যায় ইয়ে মৌসম হাসি, হামে ডর হ্যায় কে…’

১৯৭৮ সালে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আয়োজনে ১৫ জনের ছোট্ট পাঠচক্রটি শুরু হয়ে আজ সারদেশে এর সদস্য সংখ্যা প্রায় ৩০ লক্ষ। এর কর্মকাণ্ড ও অবস্থান এখন বিপুল। এখন দেশের সাংস্কৃতিবান কার্যকর, ঋদ্ধ মানুষ-যাঁরা অনুসন্ধিৎসু, সৌন্দর্যপ্রবণ, সত্যান্বেষী, যাঁরা জ্ঞানার্থী, সক্রিয় সৃজনশীল ও মানবকল্যাণে সম্পৃক্ত, তাঁদের বন্ধুতায় উৎকর্ষতায় সচকিত অঙ্গণের নাম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।

সরকারি কর্মসূচির পাশাপাশি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের দেশ ভিত্তিক উৎকর্ষ কার্যক্রমের মধ্যে ১. পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কর্মসূচি, ২. ভ্রাম্যমান লাইব্রেরি, ৩. কেন্দ্র লাইব্রেরি, ৪. আলোর স্কুল, ৫. প্রকাশনা, ৬. বই বিক্রি কেন্দ্র ৭. শ্রবণ-দর্শন, ৮. সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ৯. আলোর পাঠশালা, ১০. প্রাথমিক শিক্ষকদের বইপড়া কর্মসূচি ইত্যাদি রয়েছে।

মোবাইল লাইব্রেরি।

এই বিশাল কর্মকাণ্ডের মূল মানুষটি হচ্ছেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়িদ। একজন বহুমুখী ব্যক্তিত্ব। সারা দেশে তার খ্যাতি কিংবদন্তি তুল্য। প্রায় ৩০ বছর তিনি অধ্যাপনা করেছেন। ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় অধ্যাপক। অধ্যাপনার পাশাপাশি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা, টেলিভিশনে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছেন কৃতিত্বের সঙ্গে। একসময় উপস্থাপক হিসেবে তিনি ভিষণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। প্রচুর সম্পাদনা-সহ প্রায় শতাধিক বইয়ের রচয়িতা। আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা, খ্যাতি, যশ, অর্থ, পদ, পদবির লোভ-লালসা ছেড়ে নিজের সমস্ত আর্থিক মানসিক শক্তিকে একত্রিত করে গড়ে তুলেছেন সম্পন্ন মানুষ গড়ার প্রতিষ্ঠান এই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতায় আজ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সুরম্য ভবনটি দেশের আলোকিত মানুষের পদচারণায় মুখরিত শিল্প-সাহিত্যের অনন্য একটি পীঠস্থান হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ২৩: ‘বেদনায় ভরে গিয়েছে পেয়ালা…’

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪০: রবীন্দ্রনাথকে দারোয়ান ভেবে দৌড়ে পালিয়েছিল চোর

হারিয়ে যাওয়া পদ: গরমে পাতে থাকুক স্বাস্থ্যকর চিংড়ি দিয়ে শিমদানার ডাল

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-২৮: অনুপুষ্টিতে ভরপুর পুঁটিমাছ ছোটদের দৃষ্টিশক্তির বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়িদ স্যার বলেন, আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিসে যুবকদের আঠারো বছরে পদার্পন উপলক্ষে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে একটি শপথ বাক্য বলতে হতো। ‘আমি সারা জীবন এমন কিছু করে যাব, যাতে জন্মের সময় যে এথেন্সকে আমি পেয়েছিলাম মৃত্যুর সময় তার চেয়ে উন্নততর এথেন্সকে পৃথিবীর বুকে রেখে যেতে পারি’। আমাদের এই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের চেষ্টাও তেমনি এক উন্নততর বাংলাদেশের জন্য।

বইয়ের জন্য ভালোবাসা কেমন হতে পারে তা বই পড়ুয়া-সহ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিটি কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকদের কর্মকাণ্ড না দেখলে অনুমান করা দুরূহ হবে। বইয়ের জন্য ভালোবাসার নাম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।
* সোনার বাংলার চিঠি (Letter from Sonar Bangla, Sonar Banglar Chithi, Bangladesh) : অরুণ শীল (Arun Shil) কবি ও সাহিত্যিক। তিনি প্রধানত শিশু-কিশোর সাহিত্যের লেখক। শুরুতে গণমুখী ছড়া লিখে তুখোড় ছড়াকার হিসেবে পরিচিতি পেলেও মায়াবী, কোমল এবং স্বপ্নময় কিশোর কবিতা লিখে খ্যাতিমান হয়েছেন। ছড়া, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ নিয়ে এ পর্যন্ত তাঁর ২২টি বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রবন্ধ, ফিচার লিখেও তিনি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। পেয়েছেন বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সম্মাননা ও পুরস্কার।

Skip to content