চট্টগ্রামে সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও ড. অনুপম সেনের সঙ্গে লেখক।
শিরোনাম হতে পারতো, পশ্চিমবঙ্গে বাংলাভাষা অবহেলিত বা মর্যাদা হারাচ্ছে। কিন্তু লিখতে হল, পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। যে মাতৃভাষা রক্ষার জন্য বাঙালির বীর সন্তানেরা রাজপথে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে, শহিদ হয়ে বিশ্বের দরবারে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ প্রতিষ্ঠা করেছে, তাঁরা আজ মাতৃভাষায় কথা বলতে অনিহাবোধ করছেন বা হীনমন্যতায় ভুগছেন।
“মোদের গৌরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা…”
এই গর্ব, আশা কি পশ্চিমবঙ্গে দিন দিন ফিকে হয়ে যাচ্ছে? পশ্চিমবঙ্গে প্রায় সংখ্যাক বাঙালির মুখে বাংলা ভাষা নেই। অন্য চার/ ছয়টি ভাষার সঙ্গে কোনওমতে কথ্যভাষা হিসেবে ঠিকে থাকার লড়াই করছে ‘আ মরি বাংলা ভাষা’, যা দেখে বাঙালি হিসেবে আমাদের মর্মে লাগে। মনে দুঃখ জাগে, অপমানিত বোধ করি। কারণ, আমরা অনেক ত্যাগ, রক্ত, ঘামে, সংগ্রামে এই ভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছি। বাংলাভাষা আমাদের কাছে মাতৃদুগ্ধসম আবেগ ও অনুভূতির নাম।
“মোদের গৌরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা…”
এই গর্ব, আশা কি পশ্চিমবঙ্গে দিন দিন ফিকে হয়ে যাচ্ছে? পশ্চিমবঙ্গে প্রায় সংখ্যাক বাঙালির মুখে বাংলা ভাষা নেই। অন্য চার/ ছয়টি ভাষার সঙ্গে কোনওমতে কথ্যভাষা হিসেবে ঠিকে থাকার লড়াই করছে ‘আ মরি বাংলা ভাষা’, যা দেখে বাঙালি হিসেবে আমাদের মর্মে লাগে। মনে দুঃখ জাগে, অপমানিত বোধ করি। কারণ, আমরা অনেক ত্যাগ, রক্ত, ঘামে, সংগ্রামে এই ভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছি। বাংলাভাষা আমাদের কাছে মাতৃদুগ্ধসম আবেগ ও অনুভূতির নাম।
চিকিৎসা ও ভ্রমণের সুবাদে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে থাকার সুযোগে খোঁজ খবর করে জেনেছি, পশ্চিমবঙ্গের স্কুলগুলোতে বাংলা ছাড়াও হিন্দি, ওড়িয়া, তামিল, গুজরাতি, তেলেগু, গুরুমুখী, ইংরেজি-সহ মোট ১১টি ভাষায় পড়ানো হয়। পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ীভাবে বসবাস করলেও অন্য ভাষার শিক্ষার্থীদের বাংলা পড়তে হয় না। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া অন্যান্য অনেক রাজ্যে এরকম নেই। শুধু ত্রিপুরা, অসম, ওড়িশা, বিহার ও ঝাড়খণ্ড রাজ্যে কিছু বাংলা পড়ানো হয়। এছাড়া প্রায় সব রাজ্যে অবস্থানরত বাঙালির ছেলে-মেয়েরা বাংলায় পড়ার সুযোগ পাচ্ছে না। তাই, তাঁরা বাংলা ভাষা শিখতে পারছে না, বাংলায় কথা বলছে না। ফলে জাতিগতভাবে বাঙালি হয়েও বাংলা ভাষাচর্চা থেকে বঞ্চিত। তাঁরা হিন্দি বা অন্য ভাষাভাষী হিসেবে গড়ে উঠছেন।
খোদ কলকাতায় বাংলা বলার লোক প্রতিদিন উল্লেখযোগ্য হারে কমছে। একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে দোকানি থেকে শুরু করে গণপরিবহন-সহ সরকারি বেসরকারি অফিসের কর্মচারীরা বাঙালি হয়েও বাংলায় কথা বলতে দ্বিধা বোধ করছেন। উঠতি তরুণ প্রজন্ম বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলছেন। বাংলাটা তাঁদের কাছে কোনও মর্যাদার ভাষা নয়। পশ্চিমবঙ্গের সব স্কুলে বাংলাকে বাধ্যতামূলক করার সরকারি নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ অভিভাবক মনে করেন বাংলাটা না জানলেও ক্ষতি নেই। অভিভাবকদের এই অবজ্ঞার কারণে তরুণদের অধিকাংশই মাতৃভাষা সম্পর্কে অনাগ্রহী হচ্ছে। তাঁরা বাড়িতে কথ্যভাষা হিসেবে বাংলা বললেও, বাংলা পড়তে পারে না। তাঁরা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, শক্তি, সুভাষ, শঙ্খ, বা আজকের শ্যামলকান্তি দাশ, শ্রীজাত, জয় গোস্বামীকে পড়তে পারে না। তারা বাঙালি সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন।
খোদ কলকাতায় বাংলা বলার লোক প্রতিদিন উল্লেখযোগ্য হারে কমছে। একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে দোকানি থেকে শুরু করে গণপরিবহন-সহ সরকারি বেসরকারি অফিসের কর্মচারীরা বাঙালি হয়েও বাংলায় কথা বলতে দ্বিধা বোধ করছেন। উঠতি তরুণ প্রজন্ম বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলছেন। বাংলাটা তাঁদের কাছে কোনও মর্যাদার ভাষা নয়। পশ্চিমবঙ্গের সব স্কুলে বাংলাকে বাধ্যতামূলক করার সরকারি নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ অভিভাবক মনে করেন বাংলাটা না জানলেও ক্ষতি নেই। অভিভাবকদের এই অবজ্ঞার কারণে তরুণদের অধিকাংশই মাতৃভাষা সম্পর্কে অনাগ্রহী হচ্ছে। তাঁরা বাড়িতে কথ্যভাষা হিসেবে বাংলা বললেও, বাংলা পড়তে পারে না। তাঁরা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, শক্তি, সুভাষ, শঙ্খ, বা আজকের শ্যামলকান্তি দাশ, শ্রীজাত, জয় গোস্বামীকে পড়তে পারে না। তারা বাঙালি সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন।
আরও পড়ুন:
সোনার বাংলার চিঠি, পর্ব-১১: ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস: পাকিস্তানের প্রতি ঘৃণা জানানোর ভাষাহারা একটি দিন
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬: রামচন্দ্রের আবির্ভাব ও বসুন্ধরাকন্যা সীতার অনুষঙ্গ
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৮: রবীন্দ্রনাথ সাঁতার কাটতেন, সাঁতার শেখাতেন
আমরা যাঁরা বাংলাদেশে থেকে কলকাতায় আসি, আমাদের ভাষা শুনে টেক্সিচালক থেকে শুরু করে যে কোনও পশ্চিমবঙ্গবাসী বুঝতে পারেন, আমরা বাংলাদেশের বাঙালি। তাঁদের একাংশ আমাদের সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলতে চান। যখন প্রশ্ন করি,’ আপনি তো বাঙালি, বাংলা না বলে অন্য ভাষা বলছেন কেন?’ তাঁরা বলেন, ‘অভ্যাস হয়ে গিয়েছে’। চারপাশে একটু দৃষ্টি রাখলেই টের পাই, বাংলা এখানে কেমন রক্তশূন্য হয়ে যাচ্ছে। কলকাতা থেকে বিমানে বা ট্রেনে করে দিল্লি বা চেন্নাইয়ের দিকে যাই। পাশের সিটের সহযাত্রী বাঙালি হয়েও বাংলায় কথা না বলে ইংরেজি বা হিন্দি বলতে চান। নিজের পরিচয় দিয়ে যখন বাংলা বলার জন্য অনুরোধ করি তখন তাঁদের দৃষ্টি বদলে যায়। আমরা হতাশা ব্যক্ত করলে তাঁরা আধুনিকতা ও বিশ্বায়নে প্রতিযোগীতার দিকে আঙুল নির্দেশ করেন।
আরও পড়ুন:
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫০: ‘ফিশ পাস’ পুরোদমে চালু হলে ইলিশের প্রজনন বাধাহীনভাবে সম্ভবপর হবে
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯: নুনিয়া
বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১১: ফুটবলের ব্ল্যাক প্যান্থার: লেভ ইয়াসিন
ইউনেস্কোর মতে, বাংলা হচ্ছে পৃথিবীর মধুরতম ভাষা। ভাষার গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইট এথনোলগের ২০২০ সালের ২২তম সংস্করণের পরিসংখ্যান আমাদের জানাচ্ছে, পৃথিবীজুড়ে মোট বাংলাভাষী লোকসংখ্যা প্রায় ২৬ কোটি ৫০ লাখের (ভাষা-গবেষকদের ধারণা এটা প্রায় ২৮ কোটি হবে) কিছু বেশি। ক্রমিক বিচারে এর অবস্থান সারা বিশ্বের ভাষাগুলোর মধ্যে পঞ্চম। এই সংখ্যার মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় ১৮ কোটি বাদে বাকি ১০ কোটি পশ্চিমবঙ্গ-সহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা প্রায় ১১ কোটি। ত্রিপুরা, অসম, ওড়িশা-সহ সারা বিশ্বে ধরুন প্রায় ৪ কোটি লোক বাংলায় কথা বলে। অবশিষ্ট ৭ কোটি লোক পশ্চিমবঙ্গের। এই হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ বাংলাভাষী নয়। এই সংখ্যাটি দিন দিন বাড়ছে।
আরও পড়ুন:
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৪: গরম পড়েছে, যত পারুন ঠান্ডা খান! কী হচ্ছে এর ফলে?
প্রচণ্ড গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ার ভয়? মেনে চলুন ডাক্তারবাবুর এইসব পরামর্শ
হেলদি ডায়েট: দ্রুত রোগা হতে চান? ভরসা রাখুন সুপারফুড ডালিয়াতে
ভাষা হচ্ছে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক বাহক। ভাষার চর্চা না থাকলে সাংস্কৃতির চর্চা দিনে দিনে ক্ষীণ হয়ে আসে। জাতিসত্তার গায়ে আঘাত লাগে। কলকাতায় বাংলা ভাষার এই দুরাবস্থা দেখে প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ‘ভাষা শহিদ স্মারক সমিতি’ গঠন করা হয়েছিল। তারা বাংলা ভাষার প্রসার ও সরকারি কাজে বাংলার ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে জনসচেতনতা মূলক কাজ করেছেন। তিনি বলতেন, ‘এত হাজার হাজার বই প্রকাশ হচ্ছে, প্রজন্ম যদি বাংলা পড়তে না জানে, বা বাংলা বলতে না পারে, তবে এই আয়োজন একদিন বৃথা হয়ে যাবে।’
আরও পড়ুন:
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৬: পঞ্চম-সভার তিন রত্ন বাসু-মনোহারী-মারুতি
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩১: মরুভূমির উপল পারে বনতলের ‘হ্রদ’
দশভুজা, ‘পুরুষ মানুষের কাজে হাত দিলে এমনই হবে, মহিলাদের এসব সাজে না’
একটা ভাষা বেঁচে থাকে এবং সমৃদ্ধ হয় বিভিন্ন ভাষা থেকে শব্দ গ্রহণ করে। বাংলা ভাষায় প্রচুর বিদেশি শব্দ রয়েছে, যা ক্রমাগত চর্চা ও ব্যবহারের প্রক্ষিতে আর বিদেশি শব্দ বলে গন্য হয় না। কলকাতায় অধিকাংশ বাঙালি হিন্দি ও ইংরেজিতে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। বা হিন্দি ইংরেজি মিশ্রিত বাংলা বলেন। মোট কথা বাংলা বলতে হীনমন্যতায় ভোগেন। তাঁদের ব্যবহৃত ভাষার বাক্যে বাংলা শব্দ সংখ্যা কম। আরও একটা জিনিস লক্ষ্যণীয়, সরকারি বিভিন্ন ঘোষণা ও পরিপত্রে যে বাংলা ব্যবহার করা হয়, তা একবিংশ শতাব্দীর বাংলা ভাষা নয়। সেই উনিশ শতকের কাছাকাছি বাংলা ভাষা। এবিষয়টি বিশিষ্ট ভাষাবিদ ড. পবিত্র সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে, তিনি বিষয়টি স্বীকার করে নেন। তিনি বলেন, ‘বিশ্বায়নের যুগে বড় শহরগুলোতে এরকম হতে পারে। তবে আমরা বাঙালির ভাষা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে যেন আরও ঘনিষ্ঠ হতে পারি তার জন্য পহেলা বৈশাখ ও একুশ ফেব্রুয়ারি বড় আয়োজন করে থাকি।’
ড. পবিত্র সরকারের সঙ্গে লেখক। ডানদিক থেকে দ্বিতীয়।
আমরা যাঁরা মনে প্রাণে বাংলাভাষার প্রসার ও মর্যাদা রক্ষা করতে ভালোবাসি, আমরা চাই বাঙালির গর্বের শহর কলকাতা তার পূর্বের ঐতিহ্যে ফিরে আসুক। কলকাতা-সহ সারা পশ্চিমবঙ্গে বাংলাভাষার প্রসার হোক। বাংলা মর্যাদা হারালে আমাদের বুকে লাগে। কারণ আমরা রক্ত ও জীবন দিয়ে মাতৃভাষার মান রক্ষা করেছি। ভাষার লড়াই করতে গিয়ে ভাষাভিত্তিক বাংলাদেশ অর্জন করেছি। ‘আমরা বিজয়ী বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা ভাষার জন্য আমাদের আছে বুক ভরা ভালোবাসা।’
* প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
* প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
* সোনার বাংলার চিঠি (Letter from Sonar Bangla, Sonar Banglar Chithi, Bangladesh) : অরুণ শীল (Arun Shil) কবি ও সাহিত্যিক। তিনি প্রধানত শিশু-কিশোর সাহিত্যের লেখক। শুরুতে গণমুখী ছড়া লিখে তুখোড় ছড়াকার হিসেবে পরিচিতি পেলেও মায়াবী, কোমল এবং স্বপ্নময় কিশোর কবিতা লিখে খ্যাতিমান হয়েছেন। ছড়া, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ নিয়ে এ পর্যন্ত তাঁর ২২টি বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রবন্ধ, ফিচার লিখেও তিনি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। পেয়েছেন বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সম্মাননা ও পুরস্কার।