বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি চৌকিতে হামলা চালাচ্ছে ভারতীয় বাহিনী।

সম্প্রতি ত্রিপুরার আগরতলা, ধর্মনগর, উনকোটি, কৈলাসহর, শিলিগুড়ি, দার্জিলিং ও ডুয়ার্স ভ্রমণের সময় ভারতীয় তরুণদের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন নিয়ে কথা হয়। বাংলাদেশের জনগণ ভারতের অবদানকে কি স্বীকার করে? অনেক বাংলাদেশি ভারত বিরোধি মনোভাব পোষণ করে? ভারতের সৈন্যরা বাংলাদেশ ত্যাগ না করলে কী হতো? এসব জিজ্ঞাসার উত্তরে বার বার বলতে হয়েছে, আমরা ভারতের অবদানকে কখনও অস্বীকার করি না।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী সরাসরি অংশগ্রহণ করে যুদ্ধের শেষের দিকে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রতিবেশি রাষ্ট্র হিসেবে ভারতে ভূমিকা অবিস্মরণীয়। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ সেই গণহত্যার কালরাতের পর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় নয় মাস ভারতের জনগণ, সরকার ও সেনাবাহিনী বিভিন্নভাবে স্বাধীনতাকামী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। প্রায় এককোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে, আর্থিক, রাজনৈতিক ও মানসিক সহযোগীতা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে পরিশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিত্রবাহিনী হিসেবে বুক মিলিয়ে যুদ্ধ করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে সহযোগীতা করেছে। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, বিহার, অসম ও মেঘালয়ের জনগণ অকুণ্ঠ চিত্তে অসহায় শরণার্থীদেরকে সর্বাঙ্গিন সহযোগীতা করেছে। সে এক অনবদ্য ইতিহাস।
এককথায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তথা ভারত সরকার এবং ভারতীয় সৈন্যদের কিংবদন্তিসম সাহায্য সহযোগীতা ও আত্মত্যাগের সফল পরিণতি আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। কিছু ইতিহাসবক্তা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের সামরিক কৌশলগত স্বার্থের কারণে ভারত দ্রুত বাংলাদেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল। তার সঙ্গে ভারতের জন্য এককোটি শরণার্থী শুধু অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক নয় এবং এটা ভারতের নিরাপত্তা ও অখণ্ডতার জন্য বিরাট হুমকি ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য ভারতের এতটা ত্যাগ ও ভালোবাসা বিশ্বের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা।
আরও পড়ুন:

সোনার বাংলার চিঠি, পর্ব-৬: মুক্তিযুদ্ধের বিজয়— বীর বাঙালির অহংকার

বাংলাদেশের জাগ্রত মন্দিরে মন্দিরে, পর্ব-৪৬: জালালাবাদ পাহাড়ে মাস্টারদার নেতৃত্বে বিপ্লবীদের সংগ্রামের ইতিহাস আজও স্বর্ণাক্ষরে লেখা মানুষের হৃদয়ে

চলো যাই ঘুরে আসি: পাহাড়ের উপর ছবির মতো সুন্দর শ্রবণবেলাগোলা— চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের এক অজানা অধ্যায়

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১: চায়ের দোকান থেকে বিশ্বজয়

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মিত্র বাহিনীর ভূমিকা রাখতে ভারতকে হারাতে হয়েছিল বহু অফিসার ও সৈন্যকে। ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের মেজর জেনারেল জেএফআর জ্যাকব এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বেসামরিকভাবে ভারত ১৯৭১ এর এপ্রিল মাস থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে যায়। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে তা ০৩ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পূর্ব ও পশ্চিম রণাঙ্গনে শহিদ ভারতীয় সৈন্যের সংখ্যা ৩,৬৩০ জন। নিখোঁজ ২২৬ জন। আহত ৯৮৫৬জন। যাদের রক্ত এই স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে মিশে আছে। বাংলাদেশের জন্য যারা অকাতরে জীবন দিয়ে গেল তাদেরকে আমরা স্বশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করি।

বঙ্গবন্ধুকে বিদায়ী কুচকাওয়াজ ও গার্ড অব অনার প্রদান।

বিগত ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে নিহত ভারতীয় সৈন্যদের সম্মাননা প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। নিহত ভারতীয় সৈন্যদের স্মরণে ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে একটি স্থিতি সৌধ নির্মাণ করা হবে এবং সেখানে প্রতিটি ভারতীয় সৈনিকের নাম লেখা থাকবে। বাংলাদেশ সরকার ও জনগন কখনও স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদানের কথা ভোলেনি, ভুলবেও না। মুষ্ঠিমেয় স্বাধীনতা বিরোধীরা চিরদিন ভারতের বিরোধীতা করেছে। এখনও করছে। তারা ভৌগোলিক বাস্তবতা ও বাংলাদেশের মানচিত্রের প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কে ধারণা রাখে না বা অন্ধ মন-মানসিকতায় আক্রান্ত পাকিস্তানপন্থি রাজাকার আলবদর।
আরও পড়ুন:

ডায়াবিটিস বাসা বেঁধেছে শরীরে? কী কী লক্ষণ দেখলেই রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে? জেনে নিন খুঁটিনাটি

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৬: ছোটদের, একান্তই ছোটদের ‘ভাই-বোন সমিতি’

জিলিপি খেতে ভালোবাসেন? তাহলে আর দেরি কেন? ঝটপট বানিয়ে ফেলুন গরম গরম আনারসের জিলিপি

১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পনের পর স্বাধীন বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্যরা মাত্র ৯০ দিন অবস্থান করেছে। এটাও রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় ইরাকের বিরুদ্ধে কুয়েতকে সাহায্য করতে সেখানে সৈন্য পাঠায় আমেরিকা। ৩০ বছর পরও তারা কুয়েতে রয়ে গিয়েছে। তেমনি আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া-সহ বিভিন্ন দেশে ইঙ্গ-মার্কিন ও রুশ সেনারা সাহায্য করতে ঢুকে ঘাঁটি গেড়ে বছরের পর বছর থেকেছে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মিত্রবাহিনী হিসেবে যোগ দিয়ে মাত্র তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় সেনাদের বাংলাদেশ ত্যাগ করার ঘটনা ইতিহাসের এক নজিরবিহীন অধ্যায়।

বঙ্গবন্ধুকে বিদায়ী সালাম জানান মিত্রবাহিনীর বীর যোদ্ধারা।

তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের তথ্য দপ্তরের মহাপরিচালক ও বঙ্গবন্ধুর ভারত সফরের সাক্ষী এমআর আকতার মুকুলের ‘চল্লিশ থেকে একাত্তর’ ও ‘মুজিবের রক্তলাল’ গ্রন্থে এ বিষয়ে বিষদ বিবরণ রয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১এ বিজয় অর্জিত হলেও বাঙালি জাতি বিজয়ের উৎসবে প্রাণভরে মেতে উঠতে পারছিল না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনও পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। অবশেষে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে তিনি মুক্ত হন। এরপর নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডন হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন। এর আগে দিল্লিতে যাত্রা বিরতি করে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানটি।

জেনারেলের জ্যাকবের বিদায়ী সাক্ষাৎ।

ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে লন্ডন থেকে ওই বিমানে উঠেছিলেন ভারতের কুটনীতিক শংকর শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়। বিমানেই বঙ্গবন্ধু তাকে বলেন, দিল্লিতে ইন্দিরার সঙ্গে বৈঠকের আগেই তার কাছে একটি খবর পৌঁছনো দরকার। বাংলাদেশ থেকে মিত্রবাহিনী সদস্যদের ৩১ মার্চের মধ্যে ভারতে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি চুড়ান্ত করতে হবে। দিল্লির বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে নিজে উপস্থিত হয়ে অর্ভ্যথনা জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।

চুক্তি স্বাক্ষর করছেন ইন্দিরা ও বঙ্গবন্ধু।

প্রথম সাক্ষাতের বৈঠকেই বঙ্গবন্ধু তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং জানতে চান পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে বুকে বুক মিলিয়ে একত্রে যুদ্ধ করা ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশ ত্যাগ করবে কবে? বঙ্গবন্ধুর অদম্য নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধা থেকেই সেদিন ভারতীয় সৈন্যদের দ্রুত ফিরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন মিসেস ইন্দিরা গান্ধী।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ২৯: নদীর তীর, বনের পথ, শোক সামলে ছুটল রথ…

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১৮: দেখা-অদেখা চেনা-অচেনায় ‘মরণের পরে’

ইংলিশ টিংলিশ: সহজে শিখে নাও Adjective-এর Degree Change কাকে বলে

এরপর ৬ ও ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২-এ প্রধামন্ত্রী হিসাবে দুই দিনের সফরে ভারতের কলকাতায় যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কলকাতায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকে তিনি আবারও ভারতের সেনা প্রত্যাহারের প্রসঙ্গ তোলেন এবং তাদের প্রত্যাহারের নির্দিষ্ট তারিখ জানতে চান। বঙ্গবন্ধুর মতো একজন আপাদমস্তক গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী নেতার কথার গুরুত্ব অনুধাবন করতে আর সময় নেননি ইন্দিরা গান্ধী। কিছুক্ষণ ভেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকে জানান, ইয়োর এক্সেরেন্সি, ১৭ মার্চ আপনার জন্মদিন তার আগেই সর্বশেষ ভারতীয় সেনাটিও বাংলাদেশ থেকে ফিরে আসবে।

বিমান বন্দরে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানাচ্ছেন ইন্দিরা।

এরপর ১৯৭২ সালের ১২ মার্চ ভারতের সৈন্যরা বাংলাদেশ থেকে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ঢাকা স্টেডিয়ামে বঙ্গবন্ধুকে বিদায়ী কুচকাওয়াজের মাধ্যমে স্যালুট জানিয়ে ভারতে ফিরে যায় মিত্র বাহিনীর বীর সৈনিকরা। যাঁদের ত্যাগে শ্রমে ঘামে যুদ্ধে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। এটা দু’দেশের সুসম্পর্ককের ফসল। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের অসাধারণ সুন্দর অধ্যায় ভারত বাংলাদেশ সম্পর্ক। আজ হয়তো কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি আমরা। ভাইয়ে ভাইয়েও সম্পদ বন্টনের সময় পরস্পরের মুখোমুখি হয়, আবার ভ্রাতৃত্বের আলিঙ্গনে নিজেরা আবদ্ধ থাকে। ভারত বাংলাদেশ সম্পর্ক ও তদ্রূপ।

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
* সোনার বাংলার চিঠি (Letter from Sonar Bangla, Sonar Banglar Chithi, Bangladesh) : অরুণ শীল (Arun Shil) কবি ও সাহিত্যিক। তিনি প্রধানত শিশু-কিশোর সাহিত্যের লেখক। শুরুতে গণমুখী ছড়া লিখে তুখোড় ছড়াকার হিসেবে পরিচিতি পেলেও মায়াবী, কোমল এবং স্বপ্নময় কিশোর কবিতা লিখে খ্যাতিমান হয়েছেন। ছড়া, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ নিয়ে এ পর্যন্ত তাঁর ২২টি বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রবন্ধ, ফিচার লিখেও তিনি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। পেয়েছেন বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সম্মাননা ও পুরস্কার।

Skip to content