ছবি: সংগৃহীত।
কলকাতার তরুণ বন্ধুরা মনে করেন যে, পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। না হলে চিকিৎসার জন্য এত মানুষ বাংলাদেশ থেকে আসেন কেন? এটা সত্য যে, এখনও চিকিৎসা ও শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সামান্য পিছিয়ে আছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এত এগিয়ে আছে যে, যা পশ্চিমবঙ্গের জন্য ঈর্ষণীয়। যেমন, মাছে ভাতে বাঙালির বাংলাদেশ মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে এখন বিশ্বে তৃতীয়। হাঁস মুরগির ডিম ও মাংস উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পুর্ণ। মাংস ও দুধ উৎপাদনে সামান্য ঘাটতি পূরণ করে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করতে চলেছে। কোরবানির ঈদের সময় আগের মতো ভারতীয় গরুর উপর নির্ভর করতে হয় না। গরু মোটাতাজা করণে ক্ষুদ্রঋণ প্রদান-সহ খামারিদের উৎসাহ ও আর্থিক সহায়তা বৃদ্ধির ফলে দেশি গরু দিয়েই কোরবানির ৭৫ শতাংশ চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়েছে।
সব্জি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ। আম, আনারস, পেয়ারা, কাঁঠালের মতো ফল উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। মোটা ধান উৎপাদনেও আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। আলুর অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে আমরা বাইরে রপ্তানি করতে পারি। আমাদের একসময় ছিল বৈদেশিক ঋণ বা অনুদানের মাধ্যমে খাদ্য সাহায্য লাগতো। এখন প্রতিবছর আমাদের মাত্র ৪০ থেকে ৫০ লক্ষ টন গম আমদানি করতে হয়। বিশেষ ধরনের চাল এখন আমরা রপ্তানি করে থাকি। খাদ্য সাহায্যে এখন আমাদের বৈদেশিক ঋণ বা অনুদান ১ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।
আরও পড়ুন:
সোনার বাংলার চিঠি, পর্ব-১৩: পয়লা বৈশাখের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’— অসম্প্রদায়িক চেতনার বিশ্ব ঐতিহ্য
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৯: ‘মেরা কুছ সামান…’ গানে সুর দেওয়ার প্রস্তাবে গুলজারকে পত্রপাঠ বিদায় জানান পঞ্চম
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯: কৌরবদের জন্ম এবং কুরুপাণ্ডবদের ছেলেবেলার শত্রুতা
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫৩: বায়োফ্লক পদ্ধতিতে সফলভাবে মাছচাষ করছে ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা ও তামিলনাড়ু
কলকাতার তরুণ বন্ধুরা জানে না যে, মাথাপিছু জিডিপির দিক থেকে বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগণ পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ জনগণকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মাথা পিছু জিডিপি ভারতের গড় মাথাপিছু জিডিপির সমান হলেও ওখানকার মাথা পিছু জিডিপি অনেক কম। কলকাতা, শিলিগুড়ি, চন্দনগর, বর্ধমান, দুর্গাপুর, আসানসোল-সহ বিভিন্ন অঞ্চলঘুরে দেখা গিয়েছে শহর কেন্দ্রিক জীবনযাত্রার মান উন্নত হলেও গ্রামীণ জনপদ বহু পিছিয়ে আছে।
ছবি: সংগৃহীত।
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার মান তুলনা করলে দেখা যায়, কৃষি উন্নয়ন ও প্রবাসী রেমিট্যান্সের কারণে বাংলাদেশের গ্রামের মানুষ জীবনযাত্রার মানে এগিয়ে আছে। বাংলাদেশ থেকে প্রায় দেড় কোটি অভিবাসী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত রয়েছেন। তার মধ্যে ৯০ শতাংশ গ্রামের মানুষজন। তাদের পাঠানো ক্রমবর্দ্ধমান রেমিট্যান্সের অর্থ প্রবাহ বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগণের জীবনে স্বচ্ছলতা এনেছে, যা পশ্চিমবঙ্গে তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। বিভিন্নভাবে পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি অনেক বেশি গতিশীল ও সচ্ছল হয়ে উঠেছে, যা অভাবনীয়।
গ্রামীণ মানুষের জীবনযাত্রার মানের আর একটি দিক হল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন ও গ্রামীণ নারীদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে গ্রামীণ মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থান, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সেনিটেশন, কিশোরীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি এবং হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বিধবা ভাতা, বয়স্কভাতা, খাদ্য সহায়তা দিয়ে এসব মানুষকে আত্মবিশ্বাসী হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে।
গ্রামীণ মানুষের জীবনযাত্রার মানের আর একটি দিক হল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন ও গ্রামীণ নারীদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে গ্রামীণ মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থান, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সেনিটেশন, কিশোরীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি এবং হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বিধবা ভাতা, বয়স্কভাতা, খাদ্য সহায়তা দিয়ে এসব মানুষকে আত্মবিশ্বাসী হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে।
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩: যার কাছে টাকা-পয়সা থাকে এ জগতে সেই হল পণ্ডিত
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১২: সকালবেলার আগন্তুক
বাংলাদেশের নারীদের প্রায় ৪০ শতাংশ বাড়ির বাইরে অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে ক্রিয়াশীল। শত কুসংস্কার, কুশিক্ষা ও ধর্মান্ধতা পেরিয়ে নারীরা বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করছে। নারীর কর্মসংস্থানে সরকার বিশেষ নজর দিয়েছে। দেশের দ্রুত বিকাশমান পোশাক শিল্পে ৪০ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এই পোশাক শ্রমিকদের ৬০ শতাংশ হচ্ছে গ্রামীণ নারী, যারা গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছে। এই পোশাক শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের আয়ের বড় অংশ গ্রামে থাকা মা-বাবা, ভাই, বোন, সন্তানের ভরণপোষণের জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়, যা গ্রামের প্রান্তিক জনগণকে দারিদ্র ও ক্ষুধা থেকে মুক্তি দিয়েছে, পরিবারে স্বচ্ছলতা এনেছে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের দ্রুত উন্নতিতে গ্রামীন জনগোষ্ঠীর আর্থিক অবস্থার অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে।
ছবি: সংগৃহীত।
আগে মনে করা হতো, কৃষিখাতের অগ্রগতি বাংলাদেশের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে বেশি। কিন্তু এখন বাংলাদেশের কৃষি খাতেও সমৃদ্ধির ছোঁয়া লেগেছে। এখন ১৮ কোটির বেশি মানুষের খাদ্য জোগান দিয়েও খাদ্য উদ্ধৃত হচ্ছে। উচ্চ ফলনশীল প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার, সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, ভর্তুকি প্রদান, কৃষিঋণ প্রদান পদ্ধতির সহজিকরণ, সার, বীজ ও কীটনাশকের সহজলভ্যতা ইত্যাদির ফলে কৃষিখাতে ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হয়েছে, যা উল্লেখযোগ্য হারে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে কৃষি পন্য দ্রুত বিপণনের ব্যবস্থা হয়েছে, স্বল্প সময়ে ভোক্তার কাছে তরতাজা ফলমূল শাকসবজি মাছ পৌঁছে যাচ্ছে। পচনশীল কৃষিপন্য সংরক্ষণে হিমাগারের ব্যবস্থা হয়েছে, ফলে কৃষক ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে। গ্রামে অনলাইনে লেনদেনের সহজ হয়েছে। ই-লেনদেন-সহ নগদ প্রবাহ বৃদ্ধির প্রক্ষিতে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে।
আরও পড়ুন:
দশভুজা: জীবনে যা কিছু করেছি, প্রত্যয়ের সঙ্গে করেছি: কানন দেবী/২
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬১: চাষাবাদ নিয়েও রবীন্দ্রনাথ ভেবেছেন
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৩: হৃদয়পুরের লক্ষ্যপূরণ ‘কঙ্কাবতীর ঘাট’
প্রবাসী রেমিট্যান্স, নারীর কর্মসংস্থান থেকে অর্জিত অর্থ ও কৃষিখাতের সুফলের প্রেক্ষিতে গ্রামীন অর্থনীতিতে বড়সড় সমৃদ্ধির জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বাড়িঘর পাকা হয়েছে। বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা হয়েছে। সরকারি স্বাস্থ্য কর্মীদের তৎপরতা বৃদ্ধির ফলে মানুষ স্বাস্থ্য সচেতন হয়েছে। জন্মহার নিয়ন্ত্রণ ও শিশুমৃত্যুর হার কমেছে, গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে। ছেলেমেয়েরা ভালো স্কুল কলেজে পড়ছে। সর্বোপরি গ্রামের মানুষের কর্ম সক্ষমতা ও কর্মচঞ্চলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ এসেছে, ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার ফলে টেলিভিশন, রেফ্রিজেটর, টিভি ও মোবাইলের ব্যবহার বেড়েছে। রাস্তাঘাটের উন্নয়নের প্রক্ষিতে পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে, মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতাও বেড়েছে। এসবের সুফল হিসেবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে উত্তীর্ণ হয়েছে। ২০২১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ঘোষণা করেছে যে, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার সব শর্ত পূরণ করেছে। ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংকের ‘নিম্ম আয়ের দেশ’ ক্যাটাগরি থেকে বাংলাদেশ ‘নিম্নমধ্যবিত্ত আয়ের দেশ’ ক্যাটাগরিতে উত্তীর্ণ হয়েছে।
ছবি: সংগৃহীত।
যদিও পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ মানুষ বাংলাদেশের তুলনায় অনেক শিক্ষিত ও অগ্রসর মানসিকতার কিন্তু অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী না হওয়ার কারণে তারা বাংলাদেশের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়নের মূলভিত্তি হচ্ছে গ্রামের উন্নয়ন। নগরীর পাশাপাশি গ্রামীণ জীবনযাপনে তেমন বেশি ফারাক নেই। এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি হবে। তখন তীর্থ দর্শন ও ভ্রমণ ছাড়া শুধু চিকিৎসার জন্য কলকাতা বা ভারতে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। —চলবে
* প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
* প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
* সোনার বাংলার চিঠি (Letter from Sonar Bangla, Sonar Banglar Chithi, Bangladesh) : অরুণ শীল (Arun Shil) কবি ও সাহিত্যিক। তিনি প্রধানত শিশু-কিশোর সাহিত্যের লেখক। শুরুতে গণমুখী ছড়া লিখে তুখোড় ছড়াকার হিসেবে পরিচিতি পেলেও মায়াবী, কোমল এবং স্বপ্নময় কিশোর কবিতা লিখে খ্যাতিমান হয়েছেন। ছড়া, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ নিয়ে এ পর্যন্ত তাঁর ২২টি বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রবন্ধ, ফিচার লিখেও তিনি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। পেয়েছেন বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সম্মাননা ও পুরস্কার।