বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


কলকাতার তরুণ প্রজন্মের লেখকদের কাছে বাংলাদেশের বইমেলা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি নিয়ে আলাদা একটা আবেগ অনুভূতি লক্ষ্য করেছি। তারা বেশিরভাগ ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ভ্রমণ করতে চায়। প্রথমত ভ্রমণের জন্য খুবই উপযুক্ত সময়। দ্বিতীয়ত, এই মাস জুড়ে সারাদেশের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও বইমেলা নিয়ে তাদের কৌতূহল রয়েছে।
ফেব্রুয়ারি মাস আমাদের ভাষার মাস। ফেব্রুয়ারি মাসের সঙ্গে আমাদের আবেগ জড়িয়ে আছে। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় জীবন দানকারী শহিদ ও ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত মহান একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বে স্বীকৃতি পেয়েছে। কলকাতায় যদিও সাড়ম্বরে তা উদযাপিত হয়। কিন্তু আবেগ অনুভূতি অন্য আট দশটি দিবসের মতো। তারা শুনে অবাক হয় যে, এই পুরো মাস জুড়ে সারা বাংলাদেশে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আমরা সবাই মেতে থাকি। দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলায় আয়োজিত হয় বইমেলা। কত রকম সাজে বিন্যাসে নামে নতুন বই শোভা পায়, তার বিষয় বৈচিত্র্যের সঠিক পরিসংখ্যান করা সম্ভব হয় না।
সারাদেশে এই বইমেলা ১৯৫২ এর একুশের জাগরণকে ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছে। একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনার সঙ্গে বই মেলার গভীর সংযোগের ফলে বাঙালি জাতিস্বত্বার জাগরণ ও চিন্তার উৎকর্ষের প্রতিফলনের সুফল আমরা ভোগ করছি। এই একুশের চেতনা থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম বেগবান হয়েছে। আমরা একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছি।
আরও পড়ুন:

সোনার বাংলার চিঠি, পর্ব-৮: বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভারতীয় কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবিদের ভূমিকা আমরা ভুলবো না

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩৩: শোকস্তব্ধ অযোধ্যানগরী কি আপন করে নিল ভরতকে?

‘বাঙালি জাতিস্বত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক’ বাংলা আকাদেমির তত্বাবধানে মাসব্যাপি উৎযাপিত হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’, যা ব্যাপকভাবে একুশে বইমেলা নামে খ্যাতি লাভ করেছে। বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষি লেখকদের কাছে যা মিলন মেলা, প্রাণের মেলা ও সৃষ্টি সুখের উল্লাসের মেলা হিসেবে গন্য। এই মেলার আকারগত বিশালত্ব তো আছেই। তার সঙ্গে একটা জাতির আবেগ ও চেতনা জড়িয়ে একটা বুদ্ধিভিত্তিক মানস সম্পদে পরিণত হয়েছে। কলকাতা বইমেলা আমি দেখেছি। ওটা উৎসব হিসেবে এখনও এত আবেগের জায়গায় যেতে পারেনি। এক মাস ব্যাপি আর কোথাও বইমেলা হয় না। সময় বিবেচনায় এইটি পৃথিবীর দীর্ঘস্থায়ী বইমেলা। এই মেলা নিয়ে মানুষের আগ্রহ বেশি। সারা দেশের লেখক পাঠক এই বইমেলায় আসেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ এখানে অংশগ্রহণ করেন। ফ্রাঙ্কফুট, লন্ডন, প্যারিস, নিউইয়র্ক এবং কলকাতা বইমেলার সঙ্গে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র তুলনা হয় না। এটা বাঙালির চিন্তা চেতনা ও মনিষার প্রাণের মেলা, যা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জল। বাংলা ভাষী লেখকের জন্য এটি স্বপ্নের মেলা।
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলোর মধ্যে এই গ্রন্থমেলা অন্যতম। প্রতি বছর পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে এই মেলা বাংলা আকাদেমির বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণে ও বর্ধমান হাউজ ঘিরে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ বাংলা আকাদেমির মুখোমুখি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। তবে বাংলা আকাদেমি প্রাঙ্গণেও মেলার একটি অংশ আয়োজন করা হয়।
আরও পড়ুন:

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৫৩: পিতার অভিশাপ—জন্ম হল অষ্টাবক্র বালকের

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫০: লুকোনো বই পড়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ বাক্সের চাবি চুরি করেছিলেন

এই মেলার ইতিহাস স্বাধীন বাংলাদেশের বয়সী। যতদূর জানা যায়, ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণে বটতলায় এক টুকরো কাপড় বিছিয়ে কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। এই বইগুলো ছিল চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমান মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশী শরণার্থী লেখকদের লেখা বই। বইগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রথম অবদান।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি একাই বইমেলা চালিয়ে যান। ১৯৭৬ সালে অন্যরা অণুপ্রাণিত হোন। ১৯৭৮ সালে বাংলা আকাদেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকি বাংলা আকাদেমিকে মেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। ১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। এই সংস্থাটিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৮৩ সালে কাজী মনজুরে মওলা বাংলা আকাদেমির মহাপরিচালক হিসেবে বাংলা আকাদেমিতে প্রথম “অমর একুশে গ্রন্থমেলা”র আয়োজন সম্পন্ন করেন। কিন্তু স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষা ভবনের সামনে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে ট্রাক তুলে দিলে দু’জন ছাত্র নিহত হয়। ওই মর্মান্তিক ঘটনার পর সেই বছর আর বইমেলা করা সম্ভব হয়নি। ১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে বর্তমানের অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়। সেই ৩২টি বইয়ের ক্ষুদ্র মেলা কালানুক্রমে বাঙালির সবচেয়ে স্বনামধন্য বইমেলায় পরিণত হয়েছে।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪১: মৎস্যজীবীদের মীন সংগ্রহে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিলে প্রচুর অপচয় কমবে, রক্ষা পাবে মাছের জীব বৈচিত্র্যও

বিচিত্রের বৈচিত্র্য, জীবন খাতার প্রতি পাতায় যতই লেখো হিসাব নিকাশ/২

বাংলা আকাদেমি চত্বরে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ২০১৪ সাল থেকে বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এই উদ্যানের সাথে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষন ও পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ২০১৪ সালে ২৯৯ জন অংশগ্রহণকারী প্রকাশকের মধ্যে ২৩২ জনকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্টল বরাদ্দ করা হয়, ২০০২ সালে মেলায় ২৪০ জন এবং ২০২২ সালে সর্বোচ্চ ৪২৫ জন প্রকাশক অংশগ্রহণ করেছিল। এবার ২০২৩ এর বইমেলায় ৫৭৩টি প্রতিষ্ঠানকে ৭০৪টি (প্যাভিলিয়ন বাদে) স্টল বরাদ্দ দিয়েছে। এছাড়া লিটল ম্যাগাজিন ইত্যাদির স্টল তো আছেই। প্রতি বছর বাড়ছে মেলার ব্যাপ্তি ও বইয়ের সংখ্যা। বাংলাদেশে প্রকাশনা শিল্প আজ একটা শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়েছে। এখানে এখন বিশিষ্ট শিল্পপতিরা লগ্নি করছেন। এটা এই বইমেলার জন্য সম্ভব হয়েছে।
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৫: আমরা জাতির পিতাকে পেলেও, মাতাকে পেলাম না— কেন?

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫: সত্যিই কি মায়ের দয়ায় পক্স হয়?

বইমেলাকে ঘিরে স্টল তৈরির স্থাপত্য শৈলী এক দেখার মতো বিষয়। এখানে বাঙালিয়ানা ফুটিয়ে তুলতে সবাই বদ্ধপরিকর। বিভিন্ন রকম মনকাড়া ডিজাইন, রঙের বাহার, ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তোলার মুন্সিয়ানা লক্ষ্মণীয়। বাংলা অক্ষর এখানে অনেক পবিত্র একটি মহার্ঘ। মেলায় আগতদের মনের ভেতর এক অসাধারণ অনুভূতি আনে সুদৃশ্য স্টল ও প্যাভিলিয়নগুলো। সবদিকে তারুণ্যের জোয়ার ও নতুনত্বের সুঘ্রাণে মুখরিত পরিবেশ বিরাজ করে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে বাংলাদেশে চিন্তার সক্ষমতা প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে এই বই মেলা। বাঙালি লেখক পৃথিবীর যেই প্রান্তেই থাকুক না কেন, তার বইটি তিনি এখানে প্রেরণ করতে চান। বাঙালি লেখকদের সৃষ্টিশীলতা ও মনের খোলাজানালা এই বই মেলা। পরিচয় ও সামাজিক সংযোগের স্থল এই বইমেলা নিয়ে বাংলাদেশে মানুষের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। এই বই মেলার মাধ্যমে একুশের চেতনা ছড়িয়ে যাচ্ছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
* সোনার বাংলার চিঠি (Letter from Sonar Bangla, Sonar Banglar Chithi, Bangladesh) : অরুণ শীল (Arun Shil) কবি ও সাহিত্যিক। তিনি প্রধানত শিশু-কিশোর সাহিত্যের লেখক। শুরুতে গণমুখী ছড়া লিখে তুখোড় ছড়াকার হিসেবে পরিচিতি পেলেও মায়াবী, কোমল এবং স্বপ্নময় কিশোর কবিতা লিখে খ্যাতিমান হয়েছেন। ছড়া, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ নিয়ে এ পর্যন্ত তাঁর ২২টি বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রবন্ধ, ফিচার লিখেও তিনি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। পেয়েছেন বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সম্মাননা ও পুরস্কার।

Skip to content