বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

মূত্রের সংক্রমণ এবং তার জন্য প্রস্রাবে জ্বালা, ব্যথা, ঘনঘন অল্প অল্প মূত্র খুব কষ্টে নির্গমন, লাল-হলুদ ইত্যাদি বর্ণের প্রস্রাব ত্যাগ এই সমস্ত কষ্ট প্রায়শই দেখা যায়। সাধারণত ডাক্তারবাবুরা এই ধরনের কষ্টে প্রস্রাবের সংক্রমণকে দায়ী করেন। একে ইউরিনারি ট্র্যাক্ ইনফেক্শন বলে তাঁরা অভিহিত করেন। কিডনি বা বৃক্ক, ইউরেটার বা গবিনী, ইউরিনারি ব্লাডার বা মূত্রথলি, ইউরেথ্রা বা মুত্রপ্রসেক নালী যদি জীবাণুর সংক্রমণের জন্য প্রদাহান্বিত বা ইনফ্লেমড হয় তাহলেই তা ইউটিআই বা ইউরিনারি ট্র্যাক ইনফেকশন। যখন মূত্রবাহী নালীর উপরিভাগ অর্থাৎ কিডনি এবং কিডনি থেকে ইউরিনারি ব্লাডার পর্যন্ত সংযোগকারী নালী বা ইউরেটার আক্রান্ত হয় তখন ‘আপার ইউরিনারি ট্র্যাক ইনফেকশন’ বলা হয়। আর যখন ইউরিনারি ব্লাডার বা মূত্রথলি থেকে ইউরেথ্রা বা মূত্র প্রসেক নালীর নিম্নমুখ পর্যন্ত অংশ আক্রান্ত হয়, তখন তাকে ‘লোয়ার ইউরিনারি ট্র্যাক ইনফেকশন’ বলা হয়।

সাধারণত ই-কোলাই বা ইসকেরেসিয়া কোলাই নামে এক জীবাণুর সংক্রমণ থেকে এই ধরনের রোগ উৎপন্ন হয়। তাই আধুনিক বিজ্ঞানে মূত্রের কালচার এবং সেনসিটিভিটি পরীক্ষা করিয়ে ব্যাকটেরিয়াকে মারার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। কিন্তু অ্যাকিউট ইউটিআই-তে এই ধরনের চিকিৎসায় রোগী আরাম পেলেও ক্রনিক ইউটিআই অর্থাৎ যেখানে বারবার জীবাণু সংক্রমণের ঘটনা ঘটতে থাকে সেখানে ভালো ফল পাওয়া যায় না বা ‘নন স্পেসিফিক্’ বা অনির্দিষ্ট কারণ জন্য ইউটিআই সেখানে কিছুই ফলপ্রদ হয় না।

এই ইউটিআই সারা ভারতের নিরিখে এক বৃহৎ সমস্যার বিষয়। কারণ, দেশের জনসংখ্যার প্রায় সাড়ে ৩৩ শতাংশ মানুষ কোনও না কোনও সময় এই সমস্যায় ভোগেন। এর মধ্যে মহিলারা প্রায় ৬৭ শতাংশ এবং পুরুষ প্রায় ৩৩ শতাংশ। অর্থাৎ পুরুষদের অপেক্ষা মহিলাদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় দ্বিগুণ।
এ হেন সমস্যায় প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্র কীভাবে তার প্রতিকার করে আসছে এবং কী ব্যাখ্যা দিয়েছে তা একবার দেখে নেওয়া যাক। আয়ুর্বেদ সাধারণত মূত্র ত্যাগের কষ্টকে দুটি ভাষায় প্রকাশ করেছে। প্রথমটি মূত্রকৃচ্ছ্র, আর দ্বিতীয়টি মুত্রাঘাত। মূত্রকৃচ্ছ্র নামক সমস্যাটির লক্ষণ ইউরিনারি ট্র্যাক ইনফেকশনের সমতুল্য। আর মুত্রাঘাত মূলত মূত্র ত্যাগে অবরোধ বা বাধাকে সূচিত করে। এর অনেক কারণ বা প্রকার ভেদ রয়েছে। এই লেখায় মূত্রকৃচ্ছ্র ই প্রতিপাদ্য বিষয়। তাই দেখা যাক এই রোগের কারণ বা নিদান কী?
 

রোগের কারণ বা নিদান

অতি ব্যায়াম, তীক্ষ্ণ বা কড়া ওষুধ খাওয়া, মদ্যপান, অতি ঝাল-টক-নোনতা খাবার, মশালাদার বা কড়াপাক খাবার বা পানীয়, বেশি জলজ প্রাণীর মাংস খাওয়া, নিয়ম না মেনে খাওয়া, আগের খাবার হজম না হওয়ার আগেই খেয়ে নেওয়া, আঘাত ইত্যাদি কারণে বায়ু, পিত্ত ও কফ— এই তিন দোষ বা বিশেষ করে বায়ু যখন প্রকুপিত হয় এবং মূত্রবহ স্রোতে (কিডনি থেকে মূত্র প্রসেকদ্বার পর্যন্ত) অবস্থান করে, তখন ওই সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে প্রদাহান্বিত করে। ফলে কষ্টে মূত্র নির্গত হয়, তাই এই ধরনের ‘কৃচ্ছ্রতা’ থেকেই এই রোগের নাম মূত্রকৃচ্ছ্র বলে আখ্যায়িত হয়।
 

রোগের প্রকারভেদ

আয়ুর্বেদ সাধারণত ৮ রকমের মূত্রকৃচ্ছ্র র উল্লেখ করেছে। বাতজ মূত্রকৃচ্ছ্র, পিত্তজ মূত্রকৃচ্ছ্র, কফজ মূত্রকৃচ্ছ্র, সান্নিপাতজ মূত্রকৃচ্ছ্র, অভিম্বাতজ মূত্রকৃচ্ছ্র, শকৃতজ মূত্রকৃচ্ছ্র, অশ্মরীজ মূত্রকৃচ্ছ্র এবং শর্করাজ মূত্রকৃচ্ছ্র।

আরও পড়ুন:

বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ: হার্টের অসুস্থতায় বুকের ব্যথায় ভুগছেন? আয়ুর্বেদ মতে কীভাবে মোকাবিলা করবেন? রইল সমাধান

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১: সুন্দরবনের শেকড়ের খোঁজে

 

রোগের লক্ষণ

বাতজ মূত্রকৃচ্ছ্র যেমন বারবার ব্যথার সঙ্গে মূত্রত্যাগ, কম কম মুত্র নির্গমন, তলপেটে ব্যথা, অণ্ডকোষ বা মূত্রবাহী অঙ্গে ব্যথাকে নির্দেশ করে, তেমনি পৈত্তিক মূত্রকৃচ্ছ্র জ্বালা, দাহ, বারবার প্রস্রাব, হলুদ-লাল-পীত বর্ণের গরম প্রস্রাব দেখা যায়।

কফজ মূত্রকৃচ্ছ্র এর ক্ষেত্রে তলপেটে ভারীবোধ, গুরুতা, পিচ্ছিল স্নিগ্ধ প্রস্রাব ত্যাগ, সান্নিপাতিক মূত্রকৃচ্ছ্র তে সারা দেহে জ্বালা, জ্বরবোধ, শীত-শীত ভাব, তলপেটে ব্যথা, বার বার প্রস্রাব ইত্যাদি লক্ষণ বিশেষভাবে দেখা যায়। আবার আঘাতের কারণে হওয়া অতিঘাতজ মূত্রকৃচ্ছ্র তে তলপেটে বা মুত্র থলির প্রদেশে প্রচণ্ড ব্যথা, ফোলা, জ্বর বোধ ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়।

অশ্মরীজ মূত্রকৃচ্ছ্র সাধারণত মূত্রবাহী স্রোতে অর্থাৎ বৃক্ক থেকে মূত্রপ্রসেক দ্বার পর্যন্ত যেকোনও স্থানে যদি পাথর জমে থাকে, সেক্ষেত্রে প্রস্রাব ত্যাগে ব্যথা বেদনার সঙ্গে বুকে ব্যথা, পেটে ব্যথা, তলপেটে চাপও ব্যথা, হাত-পা কাঁপা ইত্যাদি লক্ষণ প্রকটিত হয়। মলের বেগ ধারণ জন্য মূত্রত্যাগে বাধা থেকে উৎপন্ন শকৃতজ মূত্রকৃচ্ছ্র তে ও বুক, পেট, তলপেট ও অন্যান্য স্থানে প্রবল চাপ এবং ব্যথা, কম্পন, শিথিলতা ইত্যাদি লক্ষণের আবির্ভাব হয়।

অশ্মরীজ মূত্রকৃচ্ছ্র সাধারণতঃ শুক্রবেগ ধারনের কারণে হয়। তাই কোনও কোনও আচার্য্য একে শুক্রজ মূত্রকৃচ্ছ্র বলে অভিহিত করেছেন। এই ক্ষেত্রে তলপেটে ও লিঙ্গে ব্যথা, বেদনা, মূত্র ত্যাগে কষ্ট ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়।

আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৬০: গ্রাম বাংলায় আমুর কার্প মাছের বীজ উৎপাদন করে ভালো রোজগার করা সম্ভব

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৫০: আমার সোনার হরিণ চাই—সীতার চাওয়া কি সত্যি হবে?

 

চিকিৎসা

দোষের আধিক্য বিচার করে চিকিৎসা করা বিধেয়। তবে সবার আগে নিদান অর্থাৎ যে কারণে মূত্রকৃচ্ছ্র হচ্ছে তা পরিহার করা কর্তব্য।
যেহেতু আয়ুর্বেদে সংশোধন চিকিৎসা অর্থাৎ শরীরস্হিত দোষকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাইরে বার করে দেওয়ার বিধান আছে। স্নেহপান (তৈল বা ঘৃত ঔষধি দ্বারা প্রস্তুত করে পান) স্বেদন (যেমন অবগাহন স্বেদ বা পরিষেক স্বেদ), বমন, বিরেচন, বস্তি প্রয়োগ ইত্যাদির বিধান আছে। এই সকল ক্রিয়া হাসপাতালে বৈদ্যের তত্ত্বাবধানে করাই বাঞ্ছনীয়। সংশমণীয় চিকিৎসা অর্থাৎ ঔষধ খাইয়ে রোগ নিরাময়ের যে ব্যবস্থা আছে সেটাই অনেক সহজ। তাই—
 

চূর্ণ হিসাবে

এলাদি চূর্ণ ৩ গ্রাম করে দিনে দু’বার হালকা গরম জলে খাওয়ানো যায়।
যবক্ষার চূর্ণ ১ গ্রাম দু’বার মধু-সহ খেতে দেওয়া হয়।
ব্যোষাদি চূর্ণ বা ত্রিকটু চূর্ণ দেড় গ্রাম দিনে দু’বার হালকা গরম জলে খাওয়ানো যায়।

 

ক্বাথ বা পাচন হিসাবে

গোক্ষুরাদি ক্বাথ পুনর্নবাদি ক্বাথ ও ধান্যাদি ক্বাথ, অমৃতাদি ক্বাথ, শতাবরাদি ক্বাথ, ত্রিকনাদি ক্বাথ, দুরালভাদি ক্বাথ, পঞ্চতৃণমূলাদি ক্বাথ এগুলোর মধ্যে যেকোনও একটি ২০ মিলি লিটার দিনে দু’ বার সমপরিমাণ জল-সহ খাওয়ানো যেতে পারে।
 

আসব বা আরিষ্ট হিসাবে

পুনর্নবাদি আসব, চন্দনা সব, মধুকাসব ইত্যাদি ঔষধের যেকোনও একটি ১৫ থেকে ২০ মিলিলিটার দিনে দু’বার সমপরিমাণ জল-সহ খাওয়ানো যেতে পারে।
 

ঘৃত ঔষধী

শতাবরী ঘৃত, শ্বদ্রংস্ট্রা ঘৃত, ত্রিকন্টকাদ্য ঘৃত ইত্যাদির মধ্যে যেকোনও একটি ১০ থেকে ২০ মিলিলিটার দিনে একবার বা দু’বার দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
 

রসৌষধী

মূত্রকৃচ্ছ্রান্তকক রস, চন্দ্রকলা রস, বঙ্গেশ্বর রস ২৫০ মিলিগ্রাম দিনে দু’ বার মধু-সহ দেওয়া যায়।
 

বটি ঔষধ

চন্দ্রপ্রভা বটি, চন্দনাদি বটি, ২৫০ থেকে ৫০০ মিলিগ্রাম দিনে দু’বার দিলে ভালো কাজ হয়।
 

লৌহ হিসাবে

চন্দনাদি লৌহ, সপ্তামৃত লৌহ ২৫০ মিলিগ্রাম থেকে ৫০০ মিলিগ্রাম দিনে দু’বার দেওয়া যায়।
 

পিষ্টি ঔষধ

মুক্তাপিষ্টি, প্রবালপিষ্টি ২৫০ মিলিগ্রাম দিনে দু’ বার মধু-সহ খুবই কার্যকরী।
 

ভস্ম ঔষধী

প্রবালভস্ম, শঙ্খ ভাস্ম ২৫০ মিগ্রা দিনে দু’বার মধু সহ দিলে ভালো কাজ করে।
 

ক্ষার ঔষধী

যবক্ষার বজ্রক্ষার ২৫০ মিলিগ্রাম দিনে দু’ বার উপকারী।
 

পর্পটি হিসাবে

শ্বেত পর্পটি ২৫০ মিলিগ্রাম দিনে দুই থেকে তিন বার খুব ভালো ফল দেয়।

আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৪: মাথায় চোট মানেই কি ইন্টারনাল হেমারেজ?

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-২: আইজেনস্টাইন, যুদ্ধজাহাজ ও মন্তাজ

 

পথ্য

পুরানো চালের ভাত, মাংস রস, মুগের ডালের স্যুপ, মিছরি, আখের রস, গরুর দুধ, পটল, শসা, তরমুজ, চিনির শরবত, খেজুর, ডাবের জল, আমলকি, বেশি জল পান।
 

অপথ্য

কড়াপাক বা মশলাদার খাবার, বেশি ঝাল-টক খাবার, মদ্যপান, ধূমপান, বেশি পরিশ্রম, রোদে ঘোরা, উনুনের পাশে থাকা ইত্যাদি।

* বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ (Ayurveda) : ডাঃ প্রদ্যোৎ বিকাশ কর মহাপাত্র (Dr. Pradyot Bikash Kar Mahapatra), অধ্যাপক ও চিকিৎসক, ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্রাজুয়েট আয়ুর্বেদিক এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ।

Skip to content