শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

আগের প্রতিবেদনে শরীরের পোষণ সংক্রান্ত বা বিপাকীয় ক্রিয়ার ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে মেদ-বৃদ্ধির কী কী প্রতিকার বা ওজন কমানোর উপায় আলোচনা করেছি। এই প্রতিবেদনে ঠিক তেমনই ভাবে পোষণ সংক্রান্ত বা বিপাকীয় ক্রিয়ার ত্রুটিজনিত কৃশতা যেখানে ক্রমশ ওজন কমে যাওয়া বা হাড় লিকলিকে জীর্ণ, শীর্ণ হয়ে যাওয়ার ঘটনা চলতে থাকে, সেই সমস্যার সমাধানের উপায় আয়ুর্বেদীয় চিন্তাধারায় খুঁজতে চলেছি।

আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে যদি শরীরের ওজন তার স্বাভাবিক অবস্থা থেকে ২০ শতাংশ কমে যায় তবে তাকে ইমাসিয়েশন বলে। এই অবস্থার রকম ফেরে যদি হাড় ঝিরঝিরে লিকলিকে অবস্থায় রোগী ক্রমশ উপনীত হয় তবে তাকে ক্যাচেক্সিয়া বলে। কখনও কখনও মেরাসমাস, আন্ডার ওয়েট, স্কেলিটাল, গাউন্ট ইত্যাদি নামকরণ ও শুনতে পাওয়া যায়। এই অবস্থায় সাধারণত শরীরের মাংসপেশী শুকিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ত্বকের নিচে থাকা চর্বির মাত্রা একেবারে কমে যায়। বুকের খাঁচা বাইরে থেকে দেখা যায়। শরীর হাড় সর্বস্ব ও চক্ষু কোটরাগত হয়ে যায়।
১৯৯০ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে প্রায় ২.৫ শতাংশ মানুষ এই হাড় লিকলিকে শীর্ণ অবস্থার শিকার হচ্ছিলেন। সেই সংখ্যা আবার ২০১৭ সালের সমীক্ষায় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩.৭ শতাংশ। পুরুষদের থেকে মহিলাদের ক্ষেত্রে এই শীর্ণদেহী হয়ে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। আধুনিক বিজ্ঞানের মতে, পোষণতন্ত্রের ত্রুটিবিচ্যুতি, খাদ্য খাবারের গুণগত মানের হানি, যক্ষ্মা রোগ, অন্তঃস্রাবি গ্রন্থির বিকার বা হরমোনের বৈষম্য, ক্যানসার, ডায়ারিয়া,আভ্যন্তর মার্গের ক্ষত থেকে পুঁজ ইত্যাদি তৈরির মতো রোগ, থাইরয়েডের রোগ, খাদ্যনালির রোগ, পাকস্থলীর মুখ সরু হয়ে যাওয়ার জন্য খাদ্য গ্রহণের অসুবিধা জন্য রোগ, ক্রিমি ইত্যাদির অত্যাধিক সংক্রমণ, অনিদ্রা, উপবাস বা অনাহার, এডস ইত্যাদি রোগ এই শীর্ণতাকে নিয়ে আসে। কিন্তু মজার কথা, বহু ক্ষেত্রেই এই সমস্ত রোগ চিকিৎসিত হওয়ার পরে ও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের দেওয়া ঔষধাদির মাধ্যমে ঐ শীর্ণতাকে দূর করা যাচ্ছে না। তাই দেখা যাক আয়ুর্বেদশাস্ত্র কীভাবে এই শীর্ণতাকে রোধ করতে বাতলেছে তার বিধান।

আয়ুর্বেদে যে ৮ রকমের নিন্দিত পুরুষের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে অতিকৃশ ও এক প্রকারের নিন্দিত পুরুষ অর্থাৎ এরা শারীরিকভাবে সুস্থ নয়, যে রোগের কারণে ব্যক্তির নিতম্ব বা পাছা, পেট, গলা অত্যন্ত ক্ষীণ বা শুকনো হয়ে যায়, শরীরের শিরাগুলি বাইরে থেকে স্পষ্ট দেখা যায়, অস্থিসন্ধিগুলি মোটা মোটা লাগে, হাত-পা সরু হয়ে যায়, সেই রোগ অতিকৃশ বলে পরিচিত হয়।
আরও পড়ুন:

বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ: ওজন বেড়েই চলেছে? এই সব আয়ুর্বেদীয় বিধি বিধানগুলি মেনে চললে ওজন থাকবে নিয়ন্ত্রণে

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১০: সাবিত্রী দেবীর ভাবনায়—রাজা, স্বপ্ন ও দেব দেউল

 

রোগের নিদান

এই রোগের আহারগত, বিহারগত, মানসিক ও অন্যান্য কারণগুলি আয়ুর্বেদে উল্লেখ রয়েছে।
 

আহারগত কারণ

রুক্ষ বা শুকনো ও শক্ত খাবার বেশি খাওয়া, উপবাস ইত্যাদি বেশি দেওয়া, খাবারের পরিমাণ কম নেওয়া, বাত বর্ধক যেমন বেশি ঝাল, তেতো ও শুকনো তেল বর্জিত খাবার খাওয়া, কষা স্বাদের খাবার বেশি নেওয়া, হজম কারক নয় এমন খাবার খাওয়া।
 

বিহারগত কারণ

মলমূত্রাদির স্বাভাবিক বেগকে প্রায়ই চেপে রাখা, ঠিকমতো ঘুম না দেওয়া, রাত জাগা, প্রত্যহ মৈথুন করা, প্রচুর পরিমাণে ব্যায়াম বা পরিশ্রম করা, অতি বেশি পড়াশোনা করা, তৃষ্ণা থাকা সত্ত্বেও জলপান না করা, বেশি গরম জলে স্নান করা, বেশি চঞ্চল বা অস্হির হওয়া, বার্ধক্য, প্রায়শ নানান রকম রোগে ভোগা।
 

মানসিক কারণ

বেশি চিন্তা, ভয়, শোক, ত্রাস, বেশি উদ্বেগ ইত্যাদিতে ভোগা।
 

অন্যান্য কারণ

বিভিন্ন রকমের রোগ, বংশানুক্রমিক কোন রোগ, জন্মের সঙ্গে চলে আসা অর্থাৎ সহজাত রোগ।
 

উৎপত্তির ক্রম বা সম্প্রাপ্তি

উপরে আলোচিত নিদান বা কারণগুলির সংস্পর্শে কোনও ব্যক্তি যদি বেশি আসে, তাহলে রস ধাতুর উৎপত্তি অতি অল্প হয়। তার ফলে অন্যান্য রক্ত, মাংস, মেদ, অস্তি, মজ্জা ও শুক্র ইত্যাদি ধাতু ঠিকমতো পোষিত হতে পারে না। ফলে ওই ব্যক্তি ক্রমশ কৃশ বা শীর্ণ হতে থাকেন।

কয়েকটি রোগকে মাথায় রাখার কথা বিশেষভাবে বলা যেতে পারে। যেগুলি এই রোগের সঙ্গে সাযুজ্য রাখে, যেমন: কুপোষণ জন্য কার্শ্য রোগ, শোথ বা ফুলে যাওয়া রোগ, রাজযক্ষ্মা, অন্তঃস্রাবী গ্রন্থির বিকার, নিম্ন রক্তচাপ, জীর্ণ জ্বর বা অনেক দিন ধরে জ্বরে ভোগা, বাতব্যাধি ইত্যাদি।

আরও পড়ুন:

চলো যাই ঘুরে আসি: উৎসব-মুখর মথুরা: জন্মাষ্টমী উপলক্ষে ব্রজভূমি দর্শন /১

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৩: সুন্দরবনের গ্রামরক্ষক দেবতা আটেশ্বর

 

এই রোগের কিছু বিশেষ উপদ্রব

প্লীহা বৃদ্ধি, কাশ, ক্ষয় রোগ, শ্বাস, টিউমার, অর্শ, উদর রোগ বা পাচনতন্ত্রের বিকার, গ্রহণী দোষ ইত্যাদি।
 

চিকিৎসা সিদ্ধান্ত

প্রথমেই রোগের কারণ বা নিদান যা আগে বলা হয়েছে সেগুলিকে পরিবর্জন বা বাদ দিতে হবে। আবশ্যক হলে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে মৃদু সংশোধন, বিশেষ করে মৃদু বিরেচন দেওয়া যেতে পারে।
 

বৃংহনীয় বা পোষন কারক চিকিৎসা

বিশেষ করে ধাতু-বর্ধক, বলবর্ধক ও শুক্রবর্ধক ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। শরীরকে তর্পিত করার জন্য তেল, জল, ঘি ইত্যাদির প্রয়োগ করা দরকার। লঘু অথচ পুষ্টি কারক বা সন্তর্পণীয় আহারাদি যা সহজ পাচ্য হবে, তা প্রয়োগ করতে হবে। যথাবিহিত বিশ্রাম ও মানসিক শান্তির বিধান করতে হবে।
 

সংশোধন চিকিৎসা

অনুবাসন বস্তি, মাত্রা বস্তি, বৃংহন নস্য ইত্যাদি প্রয়োগ, বিশেষ করে বাহ্য ও আভ্যন্তর স্নেহন যেমন অশ্বগন্ধাদি তেল, ব্রাহ্মী তেল, বলা ঘৃত, মহা নারায়ণ তেল, ত্রিফলাদি ঘৃত ইত্যাদির প্রয়োগ করতে হবে।
 

সংশমন চিকিৎসা

অশ্বগন্ধা চূর্ণ, শতাবরী চূর্ণ, আমলকী চূর্ণ, পিপুল চূর্ণ ইত্যাদির যেকোনও একটি অবস্থা অনুসারে ৩ থেকে ৬ গ্রাম গরম জল-সহ দেওয়া যাবে।
 

আসব বা অরিষ্ট

অশ্বগন্ধারিষ্ট, বলারিষ্ট, দ্রাক্ষাসব, সারস্বতারিষ্ট এদের যেকোনও একটি ২০ থেকে ৪০ মিলিলিটার সমপরিমাণ জল-সহ প্রত্যহ খাবারের পর দেওয়া যায়।
 

ঘৃত বা তৈল

অশ্বগন্ধা তৈল, মহানায়ারাণ তৈল, বলা ঘৃত, অশ্বগন্ধা ঘৃত, ত্রিফলাদি ঘৃত ১০ থেকে ২০ মিলিগ্রাম হালকা গরম জল-সহ দেওয়া যায়।
 

অবলেহ বা পাক

চ্যবনপ্রাশ, ব্রহ্ম রসায়ন, আমলকী অবলেহ, হরিতকি অবলেহ ইত্যাদি ১০ থেকে ২০ গ্রাম প্রত্যহ ঈষদুষ্ণ দুগ্ধ-সহ দেওয়া যায়।
 

বটি

চন্দ্রপ্রভা বটি, অগ্নিতুন্ডিবটি ২৫০ মিলিগ্রাম থেকে ৫০০ মিলিগ্রাম দিনে দু’ বার দেওয়া যায়।
 

রসৌষধি

ক্ষুধাসাগর রস, বিজয় রস, প্রবাল পঞ্চামৃত, প্রবাল ভস্ম, স্বর্ণ ভস্ম, রৌপ্য ভস্ম ইত্যাদি অবস্থা অনুসারে ১২৫ মিলিগ্রাম থেকে ২৫০ মিলিগ্রাম মধু-সহ দেওয়া যেতে পারে।
 

শরীরচর্চা

যোগব্যায়াম, ধ্যান ও প্রাণায়াম ইত্যাদিও উপকারী। শবাসন, সুখাসন, বজ্রাসন ইত্যাদি করা যেতে পারে।

আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৬: গলা সাধলেই লতাকণ্ঠী?

দশভুজা: জীবনে যা কিছু করেছি, প্রত্যয়ের সঙ্গে করেছি: কানন দেবী/২

 

পথ্য

দুগ্ধ ,ঘৃত, বিদারী কন্দ, শতাবরী, অশ্বগন্ধা, বলা, পিপুল, নতুন চালের ভাত, নতুন মদ্য, মাংসের স্যুপ, ইক্ষু রস, গম, শালি চাল, মিষ্টি খাবার, স্নিগ্ধ খাবার, গুড় দিয়ে তৈরি খাবার, ঘুম, আনন্দজনক পরিবেশ, মানসিক বিশ্রাম।
 

অপথ্য

ঝাল-তেতো ও কষা স্বাদের খাবার, শুকনো খাবার, যব, মসুর, চানা কলাই, উপবাস, মৈথুন, অত্যধিক শ্রম, ভয়, শোক, ত্রাস ইত্যাদি।

* বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ (Ayurveda) : ডাঃ প্রদ্যোৎ বিকাশ কর মহাপাত্র (Dr. Pradyot Bikash Kar Mahapatra), অধ্যাপক ও চিকিৎসক, ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্রাজুয়েট আয়ুর্বেদিক এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ।

Skip to content