শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

বর্তমানে সারা পৃথিবীজুড়ে ওজন বৃদ্ধি বা মেদ বৃদ্ধি এক ভয়ঙ্কর সমস্যা। আয়ুর্বেদে এই সমস্যাকে মেদ রোগ বা স্হৌল্য রোগ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এখন পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় ৩৯ শতাংশ মানুষ এই রোগে ভুগছেন এবং শতকরা ১৯ জন আবার ওবেজ বা অতিস্হূল হয়ে নানান শারীরিক সমস্যায় জেরবার। ২০২১ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে, পুরুষের চেয়ে মহিলারা আবার শতকরা এক ভাগ বেশি এই সমস্যার শিকার। কম বয়সি শিশু, উঠতি বয়সের বালক-বালিকারা প্রায় প্রতি পাঁচজনে একজন এই রোগীদের দলে ঢুকে পড়েছে। এই মেদ রোগকে শারীরিক পোষন সংক্রান্ত এবং বিপাকীয় ক্রিয়ার বিকার জনিত এক গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যা বলেও চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা মনে করছেন।

এখন ওভার ওয়েট এবং ওবেজ অবস্থাকে ‘বডি মাস ইনডেক্স’ (বিএমআই) পরিমাপের মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়। বিএমআই-এর ফর্মুলাটি হল—মানুষের দৈর্ঘ্যের (মিটার ইউনিট) বর্গফল দিয়ে ওই মানুষের ওজন (কিলোগ্রাম ইউনিট) ভাগ করতে হবে। অর্থাৎ কিলোগ্রাম ÷ মিটার × মিটার। সেক্ষেত্রে একজন মানুষের সাধারণ বিএমআই ১৮.৫ থেকে ২৪.৯ পর্যন্ত থাকা উচিত। কিন্তু ওই বিএমআই যদি ২৫ থেকে ৩০ এর মধ্যে থাকে তাহলে তিনি ওভার ওয়েট এবং ওই বিএমআই যদি ২৯.৯ এর বেশি হয়ে যায়, তবে তাকে ওবেজ রোগী বলা হবে।

আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান এই রোগ থেকে যে সমস্ত শারীরিক সমস্যা হতে পারে তার দীর্ঘ তালিকা প্রকাশ করে চলেছে। মানুষকে সচেতন করারও চেষ্টা করছে। এগুলি হল — হার্টের রোগ, হাই ব্লাড প্রেশার বা উচ্চ রক্তচাপ, মস্তিষ্কের রোগ, শ্বাসের রোগ, পেটের রোগ, ফ্যাটি লিভার, অস্থিসন্ধির রোগ, থাইরয়েড ইত্যাদি অন্তঃস্রাবী গ্রন্থীর রোগ, সুগার, কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইড, ইউরিক অ্যাসিড ইত্যাদি বাড়ার রোগ, চর্ম রোগ এমনকি স্ট্রোক ইত্যাদি ভয়ঙ্কর রোগ। দুঃখের বিষয় এই সমস্যার তেমন কোনও ফলপ্রদ চিকিৎসা এখনও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান দিতে পারছে না।

দেখা যাক আয়ুর্বেদ চিকিৎসা বিজ্ঞান এই ব্যাপারে কী ভেবেছে এবং এর প্রতিকারের কী বিধানই বা বাতলেছে। মহর্ষি চড়ক আট রকম অতিনিন্দিত পুরুষের উল্লেখ করেছেন। যেমন অতিদীর্ঘ, অতি হ্রস্ব, অতি লোমা, অলোমা, অতি কৃষ্ণ, অতি গৌর, অতি স্থূল ও অতি কৃশ। অর্থাৎ খুব লম্বা বা বেঁটে, প্রচুর গায়ে চুলযুক্ত লোক অথবা একদম চুল না থাকা লোক, অতি কুচকুচে কালো লোক বা অত্যধিক ফর্সা লোক, অতি মোটা বা স্থূল লোক এবং অতি পাতলা বা লিকলিকে কৃশ লোক। এরা প্রত্যেকেই নিন্দিত। অর্থাৎ শরীরিক দিক থেকে সুস্থ নয়। এদের মধ্যে অত্যধিক মোটা বা যাকে আমরা এতক্ষণ অতি স্থূল হিসেবে অভিহিত করলাম, তারা অতি নিন্দিত বা সবচেয়ে বেশি শারীরিকভাবে অসুস্থ বলে মহর্ষি চরক বিবৃত করেছেন।
 

রোগের নিদান বা কারণ

এই ক্ষেত্রে আহার গত, বিহারগত ও অন্যান্য কারণ আছে।
 

আহার গত কারণ

অতি গুরুপাক খাবার যেমন পায়েস, কড়াপাক মিষ্টি, অত্যধিক স্নিগ্ধ যেমন দই, ঘি, মাখন, শীতল পানীয়, চর্বিযুক্ত খাবার, তেলেভাজা, চকোলেট, রেওয়াজি খাসির মাংস, বড় বড় মাছ, মহিষের দুধ, পিঠে, নতুন চালের ভাত, মদ্য, গুড় জাতীয় মিষ্টি, বেশি বেশি খাবার একসঙ্গে খাওয়া, আগের খাওয়ার না হজম হওয়া সত্ত্বেও খেয়ে নেওয়া ইত্যাদি।
 

বিহারগত কারণ

পরিশ্রম না করা, শুয়ে-বসে কাল কাটানো, দুপুরে ঘুম, মৈথুন একদম না করা, একদম কম চিন্তা করা, খুব আনন্দে কাল কাটানো, খুব ঘুমোনো, গদিতে শোয়া ইত্যাদি।
 

অন্যান্য কারণ

অনেকের পিতৃপুরুষের প্রকৃতি অনুযায়ী বা বংশগত প্রকৃতি অনুযায়ী ওজন বেড়ে থাকে।

আরও পড়ুন:

যৌন সমস্যায় জেরবার? মিলনের প্রতি আসক্তি কমেছে? এর পিছনে কোন কারণ লুকিয়ে? প্রতিকার আছে আয়ুর্বেদে

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৫: টনিক খাওয়া শরীরের পক্ষে ভালো?

 

সম্প্রাপ্তি বা রোগ উৎপত্তির ক্রম

উপরিউক্ত কারণ বা সমস্ত নিদান থেকে মেদ ধাতু অত্যধিক বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে শরীরের সূক্ষ্ম স্রোত বা চ্যানেলকে অবরুদ্ধ করে, ফলে মেদের পরবর্তী ধাতু যেমন, অস্থি ধাতু, মজ্জা ধাতু বা শুক্র ধাতুর ঠিকমতো পোষণ হয় না। স্রোত অবরুদ্ধ হওয়ার কারণে বায়ু বার বার প্রকুপিত হয় এবং ওই বায়ু কোষ্ঠে প্রবেশ করে ও জঠরাগ্নিকে প্রদীপ্ত করে। ফলে আবার আহার গ্রহণ করতে ইচ্ছে হয় বা খিদে অত্যন্ত বাড়ে। এতে আহার রস বেশি বেশি উৎপন্ন হয়। যেহেতু মেদ স্রোত মার্গ অবরোধ করে রাখে, তাই শুধু মেদ ধাতুরই বাড়বাড়ন্ত হয় ও অন্য ধাতু গুলি পুষ্টি না পেয়ে ক্ষয়িত হতে থাকে। এই ধাতু ক্ষয়ের জন্য পুনরায় বায়ুর অতিপ্রকোপ ঘটে, আবার জঠরাগ্নি প্রদীপ্ত হয়, আবার ক্ষুধা বাড়ে, ও আবার আহার গ্রহণ করা চলতে থাকে এবং মেদবৃদ্ধি ও হতেই থাকে, যার ফলে অন্যান্য উপসর্গগুলিও প্রকাশ পেতে থাকে।

আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৭: সে কোন প্রভাতে হইল মোর সাধের ‘নবজন্ম’

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৭১: ছোট মাছকে অবাঞ্ছিত না ভেবে প্রতিপালন করলে বিকল্প আয়ের দিশা পাওয়া যাবে

 

রোগের লক্ষণ

অত্যধিক ক্ষুধা বৃদ্ধি, অত্যধিক তৃষ্ণা, অত্যধিক ঘাম নির্গমন, অল্প শ্রমেই কাতর ও শ্বাসকষ্ট, বেশি বেশি ঘুম পাওয়া, পরিশ্রম করতে অনিচ্ছা, জড়তা, শরীরের ভারী বোধ, শক্তিহীনতা, উৎসাহহীনতা, গায়ে গন্ধ হওয়া, কথা জড়িয়ে যাওয়া, আয়ু কমে যাওয়া।
 

চিকিৎসা

প্রথমত, যে কারণে এই রোগ হয় তা বর্জন করতে হবে। যেমন পূর্বে বলা, অতি ভোজন, গুরুপাক খাদ্য, শীতল পানীয়, চর্বিযুক্ত খাদ্য ইত্যাদি পরিহার করতে হবে।
 

সংশোধন চিকিৎসা

শরীরের দোষগুলিকে বাইরে বার করা বা বায়ো পিউরিফিকেশন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে বমন, বিবেচন, নিরুহ বা কষায় বস্তি এবং কর্ষণ কারক নস্য প্রয়োগকরা হয়ে থাকে।
 

সংশমন চিকিৎসা

ঔষধাদি প্রয়োগের মাধ্যমে এই রোগের চিকিৎসাও করা হয়।
 

চূর্ণ ঔষধি

ত্রিফলা চূর্ণ, বচা চূর্ণ, পুষ্কর মূল চূর্ণ, ত্রিকটু চূর্ণ, ফলত্রিকাদি চূর্ণ ইত্যাদির যে কোনও একটি ৩ থেকে ৬ গ্রাম গরম জল বা মধু সহ দেওয়া যায়।
 

পাচন বা ক্বাথ

বৃহৎ পঞ্চমূল ক্বাথ, ফলত্রিকাদি ক্বাথ এদের যে কোনও একটা ২০ থেকে ৩০ মিলিলিটার প্রতিদিন সমপরিমাণ উষ্ণ জল-সহ দেওয়া যায়।
 

গুগগুলু ঔষধ

নবক গুগগুলু, মেদহর গুগ্গুলু ৫০০ মিলিগ্রাম থেকে ১ গ্রাম গরম জল-সহ দেওয়া যায়।
 

বটি

আরোগ্য বর্ধনী বটি, মেদনি বটি ২৫০ মিলিগ্রাম থেকে ৫০০ মিলিগ্রাম দিনে দু’বার মধু বা গরম জল-সহ দেওয়া যায়।
 

লৌহ

বিড়ঙ্গাদি লৌহ, নবায়স লৌহ ২৫০ মিলিগ্রাম থেকে ৫০০ মিলিগ্রাম দিনে দু’বার দেওয়া যায়।
 

রসৌষধি

বাড়বাগ্নি রস, ত্রিমূর্তি রস ১২৫ মিলিগ্রাম থেকে ২৫০ মিলিগ্রাম দিনে দু’বার মধু-সহ দেওয়া যায়।
 

রসায়ন

আমলকি রসায়ন বা লৌহ রসায়ন ১ গ্রাম থেকে দু’ গ্রাম মধু-সহ খাওয়া যায়।

আরও পড়ুন:

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-৫: অনন্যসাধারণ হরিপুরের হরিহর শিবমন্দির

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১২: সুন্দরবনের আর এক ব্যাঘ্রদেবতা বড় খাঁ গাজী

 

পথ্য

পুরানো শালি চাল, মুগ কলাই, কুলত্থকলাই, ছোলা, যবের ছাতু, মসুর ডাল, অড়হর ডাল, ঘোল, বেগুন, পটল, সজনে ডাঁটা, আমলকি। পরিশ্রম, ব্যায়াম, নিয়ম মতো উপবাস।
 

অপথ্য

নতুন চালের ভাত, মালাই, দুধ, ঘি, মাখন, দই, রাবড়ি, চর্বিযুক্ত খাসির মাংস, বড় মাছ, বড় মুরগির মাংস, দিনে ঘুম, শুয়ে-বসে থাকা, আলসেমি।

* বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ (Ayurveda) : ডাঃ প্রদ্যোৎ বিকাশ কর মহাপাত্র (Dr. Pradyot Bikash Kar Mahapatra), অধ্যাপক ও চিকিৎসক, ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্রাজুয়েট আয়ুর্বেদিক এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ।

Skip to content