রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

আয়ুর্বেদ মতে, সপ্তধাতু অর্থাৎ রস, রক্ত, মাংস, মেদ, অস্থি, মজ্জা ও শুক্র এই শরীরকে ধারণ করেছে। এই সপ্তধাতুর শেষতম ধাতু হল শুক্র। এই শুক্রধাতু যদি দূষিত হয়, তবেই ক্লৈব্য বা ইম্পোটেন্সি নামক এক অতি গুরুত্বপূর্ণ রোগের উদ্ভব হয়। এই রোগের জন্য মৈথুন বা স্ত্রীসঙ্গ করার ক্ষমতা কমে যায় বা হারিয়ে যায়। অথবা সন্তান উৎপাদনে অসমর্থতা আসে। চলতি কথায় এই ধরনের অক্ষমতাকে নপুংসকতা ও বলা হয়।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী বলছে, ভারতে প্রায় শতকরা ১৫ জন পুরুষ শুক্রাণুহীনতায় ভোগেন। আর যতজন পুরুষ সন্তান উৎপাদনে ব্যর্থ হন তাদের মধ্যে শতকরা একজন অ্যাজোস্পার্মিয়াতে ভুগছেন, অর্থাৎ একদমই শুক্রাণু তৈরিতে অক্ষম। অল্প শুক্রাণু তৈরি হলে তাকে বলা হয় অলিগোস্পার্মিয়া। একটি সমীক্ষাতে দেখা যাচ্ছে, যতজন পুরুষ মানুষ সন্তান উৎপাদনে ব্যর্থ, তাদের মধ্যে শতকরা ৫৮ জন অ্যাজোস্পার্মিয়ার জন্য এবং শতকরার ২৪ জন অলিগোস্পার্মিয়ার জন্য দায়ী।

সাধারণত যে সমস্ত পুরুষ মৈথুন করতে অসমর্থ্য তাদেরকে নপুংসক বলা হয় এবং নপুংসকতার ভাবকে ক্লৈব্য বলা হয়। কথ্য ভাষায় অনেকে এই অবস্থাকে ধ্বজভঙ্গ বলে।
 

ক্লৈব্যের ভেদ

আয়ুর্বেদের আচার্য্যরা একে চারভাগে ভেবেছেন।
ধ্বজোপঘাত জন্য নপুংসকতা
বীজোপঘাত জন্য নপুংসকতা
জরা জন্য নপুংসকতা
শুক্রক্ষয় জন্য নপুংসকতা
 

নামকরণ

আচার্য্য সুশ্রুত নপুংসকতার স্তর অনুযায়ী পাঁচ রকম নামকরণ করেছেন, যেমন—
আসেক্য।
সৌগন্ধিক।
কুম্ভিক।
ঈর্ষ্যক।
নারীষণ্ড বা নরষণ্ড।

 

ক্লৈব্য ছয় রকম

রোগের নিদান অনুযায়ী আচার্য্য সুশ্রুত ক্লৈব্যকে ৬ ভাগে বিবৃত করেছেন।
মানস ক্লৈব্য।
আহার জন্য ক্লৈব্য।
শুক্রক্ষয় জন্য ধ্বজভঙ্গ।
মর্মচ্ছেদন জন্য ক্লৈব্য।
সহজ ক্লৈব্য।
ব্রহ্মচর্য্য জন্য ক্লৈব্য।
 

সমস্ত রকম ক্লৈব্যের সাধারণ নিদান বা কারণ

অত্যধিক মৈথুন বা স্ত্রীসঙ্গ করা।
অকালমৈথুনের অভ্যস্ত হওয়া।
নিষিদ্ধ বিশেষ করে পশু ইত্যাদির যোনিতে মৈথুন করা।
অতিরিক্ত ঝাল-তেতো-কষা নোনতা ইত্যাদি স্বাদের আহার করা।
শুক্রক্ষয় বা অত্যধিক বীর্য্যপাত করা।
বয়স বেশি হওয়ায় দুর্বলতা।
ভয়, চিন্তা, শোক বা ক্রোধ ইত্যাদির অতিযোগ।
শস্ত্রকর্ম, ক্ষারকর্ম, অগ্নিকর্ম ইত্যাদির অনুচিত প্রয়োগ।
শুক্রবহ স্রোত বা জেনিটাল ট্রাক্টের দুষ্টি।
মলমূত্র, শুক্র ইত্যাদির বেগ ধারণ করা।
রস ও রক্ত ইত্যাদি ধাতু দূষিত হয়ে যাওয়া।

রোগোৎপত্তির আসল কারণই হল এই সমস্ত নিদান থেকে বায়ু, পিত্ত ও কফ এই তিন দোষ যখন প্রকুপিত হয়ে শুক্রবহ স্রোত যেমন অন্ডকোষ, শুক্রবাহি নালী ও লিঙ্গতে যায় এবং শুক্রধাতুকে বিশেষভাবে প্রদূষিত করে, তখনই ক্লৈব্য উৎপন্ন হয়।

আরও পড়ুন:

বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ: ডায়াবিটিস প্রতিরোধের কোনও সহজ উপায় আছে কি? চিন্তা নেই, সমাধান রয়েছে আয়ুর্বেদে

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-৪: ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে কোচস্থাপত্যের অন্যতম কীর্তি দেওতাপাড়া শিব মন্দির

 

বিভিন্ন রকম ক্লৈব্যের লক্ষণ

 

বীজোপঘাত জন্য ক্লৈব্যের রোগী

দুর্বল, নিস্প্রাণের মতো ভাব, হাসি বা স্ফূর্তির অভাব, শরীরে ফেকাসে ভাব, স্ত্রীসঙ্গ করার ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা না থাকা, হৃদয়ে চাপ বোধ, কখনও কখনও রক্তহীনতা, জন্ডিস, হাঁপানি ভাব, বমি বমি ভাব, অলসতা বোধ, ক্লান্তি বোধ, পাতলা পায়খানা হওয়া, পেটে ব্যথা ইত্যাদি থাকবে।
 

ধজোপঘাত জন্য ক্লৈব্যের লক্ষণ

লিঙ্গে ফোলা বা ব্যথা, লাল ভাব, তীব্র কোনও ফোঁড়া বা প্রদাহ থাকা, লিঙ্গের ওপর মাংসের বৃদ্ধি বা ঘা, লিঙ্গের ক্ষত থেকে স্রাব নির্গত হওয়া, লিঙ্গ বেঁকে যাওয়া, জ্বর, প্রচণ্ড জল তেষ্টা, মাথা ঘোরা, মূর্ছা যাওয়া, বমি হওয়া, মূত্রাশয়,অন্ডকোষ, কুচকি ইত্যাদি জায়গায় তীব্র দাহ এবং ব্যথা, কখনও ঘা থেকে কৃমি তৈরি হওয়া, লিঙ্গের মণিতে ক্ষত, লিঙ্গ নেতিয়ে পড়ে যাওয়া।
 

জরা জন্য ক্লৈব্যতার লক্ষণ

পরিশ্রম ছাড়া ও আলস্যবোধ, প্রচণ্ড দুর্বলতা, অনেক ধরনের কষ্ট বোধ করা, বল-বীর্য ক্ষীণ হয়ে যাওয়া, ইন্দ্রিয় শিথিল হয়ে যাওয়া।
 

শুক্র ক্ষয়জ ক্লৈব্যতার লক্ষণ

শরীরের রসধাতুর ক্ষয়, রক্ত-মাংস-মেদ ইত্যাদি ধাতুর ক্ষীণতা আসা, শুক্র নাশ হওয়া, অনেক ধরনের শারীরিক কষ্ট বোধ করা, ক্রমশ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া।

আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১১: সুন্দরবনের ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণ রায়

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮: নহবতে সহধর্মিণী সারদা

 

সহজ (জন্মকাল থেকে ক্লাব্যতার লক্ষণ

মহর্ষি সুশ্রুত সহজ ক্লৈব্যতার নিম্নোক্ত পাঁচভেদ বর্ণনা করেছেন—
আসেক্য ক্লৈব্যতা, সাধারণত মাতা-পিতার অতি অল্প বীজ (শুক্র-শোনিত) থেকে উৎপন্ন পুরুষ হল আসেক্য পুরুষ। এরা অন্য পুরুষের সঙ্গে বিকৃত কাম উপভোগ করে। কখনও নিজের মুখে অন্য পুরুষের দ্বারা মৈথুন করে, সেই বীর্য খেয়ে ও নেয়। তাই এদেরকে মুখযোনিও বলা হয়।
সৌগন্ধিক ক্লৈব্যতার ক্ষেত্রে যে সমস্ত পুরুষ দুর্গন্ধজনক যোনি থেকে উৎপন্ন হয়, এরা যোনির গন্ধ নিতে ভালোবাসে।
কুম্ভিক ক্লৈব্যতার ক্ষেত্রে যে পুরুষ নিজের গুহ্যদ্বারে অপর পুরুষকে মৈথুন করতে দেয় বা নিজে অপর পুরুষ বা স্ত্রীর গুহ্যদ্বারে মৈথুন করে।
ঈর্ষ্যক ক্লৈব্যতার ক্ষেত্রে যে পুরুষ অপর কাউকে মৈথুন করতে দেখে তবেই মৈথুনে প্রবৃত্ত হয়।
নারীষন্ড ক্লৈব্যতার ক্ষেত্রে যে পুরুষ স্ত্রীর রজঃস্রাব চলাকালীন রতিক্রিয়া বা মৈথুন করে তজ্জন্য যে পুত্র উৎপন্ন হয় তার চেষ্টা, হাবভাব, আকার স্ত্রীর মতো হয়। আর যদি কন্যা উৎপন্ন হয় তার চেষ্টা, হাবভাব, আকার পুরুষের মতো হয় সে ক্ষেত্রে পুরুষ সন্তান নরষণ্ড এবং কন্যা সন্তান নারীষণ্ড নাম পায়।

আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-8: চলতি কা নাম কিশোর

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২৬: অবশেষে চার হাত এক হল, পঞ্চম-আশা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে শুরু করলেন দ্বিতীয় ইনিংস

 

ক্লৈব্য রোগের সাধারণ চিকিৎসা

প্রথমত, নিদান বা কারণগুলিকে অবশ্যই পরিবর্জন করতে হবে। যেহেতু ধ্বজোপঘাত ও শুক্রক্ষয় জন্য ক্লৈব্য শুধুমাত্র সাধ্য, তাই তাদেরই চিকিৎসা করা সহজ। তাতে ভালো ফলও পাওয়া যায়।
 

শোধন চিকিৎসা

বমন-বিরেচন ইত্যাদির মাধ্যমে শরীরকে শোধন করা উচিত। ১৬ বছর বয়স্ক থেকে ৭০ বছর বয়স্ক পর্যন্ত রোগীকে বৃষ্যযোগ (শুক্র-বর্ধক ঔষধ) দেওয়া উচিত।
 

শমন চিকিৎসা

চূর্ণ হিসাবে

অশ্বগন্ধাদি চূর্ণ, শতাবরাদি চূর্ণ, নরসিংহ চূর্ণ রতি বল্লভ চূর্ণ এদের যেকোন একটিকে ৩ থেকে ৫ গ্রাম দুধ-সহ খেতে দেওয়া যায়।
 

বটি হিসাবে

বানরি বটিকা, বৃংহিনি বটিকা, চন্দ্রপ্রভা বটি, মদনমঞ্জরী বটি যেকোনও একটি ২৫০ মিলিগ্রাম থেকে ৫০০ মিলিগ্রাম মধু বা দুধ-সহ দেওয়া যায়।
 

মোদক ঔষধি

শ্রীমদনানন্দ মোদক, কামেশ্বর মোদক, রতিবল্লভ মোদক ৩ থেকে ৫ গ্রাম দুধ-সহ দেওয়া যেতে পারে।
 

আসব বা আরিষ্ট

দশমূলারিষ্ট, অশ্বগন্ধারিষ্ট ২০ মিলিলিটার করে দিনে দু’বার খাবার পর সমপরিমাণ জল-সহ দেওয়া যায়।
 

ঘৃত ঔষধি হিসাবে

ফলঘৃত, কল্যাণকঘৃত, কামদেবঘৃত, অশ্বগন্ধাঘৃত ১০ থেকে ২০ গ্রাম খাওয়ানো যেতে পারে।
 

রসৌষধি

পূর্ণচন্দ্র রস, পুষ্পধন্যা রস, নবজীবন রস যে কোনও একটি ১২৫ থেকে ২৫০ মিলিগ্রাম মধু বা মাখন-সহ দেওয়া যায়।
 

মালিশ

প্রলেপ বা মালিশের জন্য তেল হিসেবে মহাচন্দনাদি তেল, অশ্বগন্ধা তেল, মহা সুগন্ধি তেল, শ্রীগোপাল তেল লিঙ্গে দিনে দু’বার মালিশ করা যায়।

আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৪: গলায় মাছের কাঁটা ফুটলে ওষুধ খেলে গলে যায়?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৮: মেয়ের জন্য হেমন্তবালা কবির পরা জোব্বা নিয়েছিলেন

 

পথ্য

দুধ, ঘি, পান, শালী ধান্যের চাল, মাংস রস, মদিরা, মধু, মোনাক্কা, খেজুর, বাদাম, কাজু, আখরোট।
 

অপথ্য

ঝাল, তেতো খাবার, রাত জাগা, অতি মৈথুন।

* বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ (Ayurveda) : ডাঃ প্রদ্যোৎ বিকাশ কর মহাপাত্র (Dr. Pradyot Bikash Kar Mahapatra), অধ্যাপক ও চিকিৎসক, ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্রাজুয়েট আয়ুর্বেদিক এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ।

Skip to content