রবিবার ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

রিটেনশন অফ ইউরিন বা ইউরিনারি রিটেনশন এমন একটি অবস্থা যেখানে মূত্রথলিতে জমা মূত্র সঠিকভাবে বাইরে নির্গত হতে পারে না, রোগীর অস্বস্তি বাড়তে থাকে। মূত্রথলি খালি হতে না পারার জন্য ব্যথা, কষ্ট ও নানান উপদ্রব উপস্থিত হয়। এই প্রতিবন্ধকতা হল অ্যাকিউট বা তৎকালীন মারাত্মক এবং ক্রমশঃ জটিল হতে পারে। আধুনিক বিজ্ঞানে এই সমস্যার কারণ হিসাবে মূত্রথলির পাশে থাকা প্রোস্টেট গ্ল্যান্ড বা পৌরুষ গ্রন্থির বৃদ্ধি মূত্রথলির মুখে অবরোধ, ইউরেথ্রা বা মূত্র প্রসেক নালীর স্ট্রিকচার বা জুড়ে যাওয়া মূত্রথলিতে কোনও গ্রোথ বা অর্বুদ হওয়া, তলপেটে থাকা প্রত্যঙ্গগুলির প্রলাপস বা স্থানচ্যুতি, মুত্রস্থলীর সিস্ট (সিস্টোসিল, রেকটোসিল) এবং মূত্রবাহী নালীতে পাথর জমা বা ক্যালকুলি ইত্যাদিকে চিহ্নিত করেছে। সারা পৃথিবীতে এই ইউরিনারি রিটেনশনে পুরুষ মানুষের ভোগার সংখ্যা সর্বাধিক।

মহিলাদের সংখ্যা কম। প্রতি এক হাজার পুরুষ মানুষের প্রায় পাঁচ থেকে আটজন পুরুষ এই সমস্যায় পর্য্যুদস্ত হয়ে থাকেন। সারা পৃথিবীতে প্রায় ৩ কোটি বয়স্ক মানুষ শুধুমাত্র প্রস্টেট গ্ল্যান্ডের বৃদ্ধি জনিত ইউরেনারি রিটেনশন বা মূত্রত্যাগের প্রতিবন্ধকতায় ভুগে থাকেন। এই বিপুল সংখ্যায় আক্রান্ত পুরুষদের মধ্যে তিন থেকে পাঁচ শতাংশ যুবক বা মধ্য বয়স্ক। ১১ থেকে ৩৪ শতাংশ বয়স্ক। আমাদের বয়স্ক মানুষের মধ্যে একের ৩ শতাংশ প্রস্টেট বৃদ্ধিতে অংশীদার হন। তাঁদের রিটেনশন অফ ইউরিন বা মূত্রত্যাগের প্রতিবন্ধকতার কষ্ট সইতে হয়। একটি বিষয় ভীষণ লক্ষণীয় যে, ৮৫ বছরের বেশি বয়স্ক মানুষের প্রায় ৯০ জনেরই প্রোস্টেট গ্রন্থি বেড়ে থাকে।

এই প্রোস্টেট গ্রন্থি সাধারণত একজন যুবকের ক্ষেত্রে ২৫ গ্রাম হয়ে থাকে। যত বয়স বাড়ে বিশেষ করে ৪০ বা ৫০ বছরের পর থেকে এই গ্রন্থি বাড়ে। কোনও কোনও পুরুষের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক বেড়ে মূত্রথলির দ্বারে অবরোধ উৎপন্ন করে ফলে নানারকম শারীরিক কষ্ট উপস্থিত হয়। এই প্রোস্টেট গ্রন্থির বৃদ্ধি সাধারণত বিনাইন বা অকিঞ্চিত কর হয় তাই ভয়ের কিছু নেই, চিকিৎসাযোগ্য। কিন্তু যদি তা ম্যালিগন্যান্ট বা ক্যানসারস হয় তাহলে মারাত্মক। সারা পৃথিবীতে প্রতিবছর প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ এই প্রোস্টেট ক্যানসারে মারা যান।
দেখে নেওয়া যাক আমাদের প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে আয়ুর্বেদের আচার্য্যগণ চরক, সুশ্রুত, বাগভট্ট, মাধব কর, ভাব মিশ্র ও অন্যান্য আয়ুর্বেদবেত্তারা এই রিটেনশান অফ ইউরিন বা মূত্রত্যাগ প্রতিবন্ধকতাকে কি ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন?
 

আয়ুর্বেদে এই ধরনের সমস্যা মূত্রাঘাত রূপে পরিচিত। মহর্ষি চরকের মতে মূত্রঘাত ১৩ প্রকার। যেমন—

● মূত্রসাদ: আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষায় যা অলিগো উহরিবার লক্ষণকে নির্দিষ্ট করে।
● মূত্র জঠর: যা ডিসটেনডেড ইউরিনারি ব্লাডারের সমতুল্য।
● বাতকুন্ডলিকা: যা অনেকটা স্পেসমোডিক স্ট্রিকচারকে ইঙ্গিত করে।
● অস্টিলা: যে লক্ষণগুলি একদমই বেড়ে যাওয়া প্রোস্টেটের সমতুল্য।
● বাতবস্তি: ওভারলোডেড ইউরিনারি ব্লাডারের লক্ষণ প্রকাশ করে।
● মূত্রাতীত: মূত্রধারণ ক্ষমতার সমস্যা বা ইনকন্টিনেন্স অব ইউরিনকে সূচিত করে।
● মূত্রসঙ্গ: অনেকটা স্ট্রিকচার ইউরেথ্রার মতো লক্ষণ।
● মূত্রক্ষয়: অ্যানিউরিয়ার সমতুল্য।
● মূত্রবস্তি: স্টোন অব ইউরিনারি ব্লাডার বা পাথুরী যুক্ত মূত্রথলির লক্ষণ প্রকাশ করে।
● উষ্ণবাত: যা একদমই মূত্রের সংক্রমণ বা ইউরিনারি ইনফেকশনের লক্ষণ প্রকাশ করে।
● বিড্ বিঘাত: যেখানে রিটেনশন অব ইউরিন মূলতঃ কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য দায়ী।
● বস্তি কুন্ডল: যা অ্যাকিউট ইউরিনারি ব্লাডার সিনড্রোমকে সূচিত করে।
 

এই ১৩ রকমের মুত্রাঘাত কী কারণে হয় বা এর নিদান কি?

মলমূত্র বা অধো বায়ুর স্বাভাবিক বেগকে যদি চেপে রাখা হয়, শুক্র বেগধারণ, তীক্ষ্ণ বা কড়া ওষুধ, অন্য পানীয় গ্রহণ, মদ্যপান, শুকনো কড়াপাক খাবার, জল-কম পান করা, রাতজাগা, বেশি মৈথুন, বেশি সফর করা, বেশি ঘর্মাক্ত হওয়া, অতি পরিশ্রম, উপবাস ইত্যাদি নিদান বা কারণের উপযোগে বায়ু, পিত্ত ও কফ এই তিন দোষ বিশেষ করে বায়ু দোষ প্রকুপিত হয়ে বস্তি প্রদেশ বা মূত্রথলির জায়গায় স্থান নেয় ও মূলতঃ মূত্রথলিকে বিকৃত করে এই ধরনের ১৩ রকমের মুত্রাঘাত উৎপন্ন করে।

আরও পড়ুন:

বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ: প্রস্রাবে ব্যথা বা জ্বালা? মূত্রনালিতে সংক্রমণ? প্রতিকার আছে আয়ুর্বেদে

পুরনো গাড়ি কেনার কথা ভাবছেন? কেনার আগে কী কী দেখে নিতেই হবে

পুরুষের রিটেনশন অব ইউরিনের যে মূল কারণ আধুনিক বিজ্ঞান নির্দেশ করেছে তা হল বেড়ে যাওয়া প্রোস্টেট (এনলার্জ প্রোস্টেট) যা আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় প্রতিহত করা যায়। আধুনিক বিজ্ঞানে প্রোস্টেট গ্ল্যান্ডকে বাদ দিয়ে অপারেশনের মাধ্যমে যে চিকিৎসা করে তাতে অনেক জটিলতা নিয়ে আসে। এছাড়া যে সমস্ত সিন্থেটিক ওষুধ ব্যবহার করা হয় তার ও বহুল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। এই ব্যাপারে একটি বিষয় বলে রাখা ভালো যে, সাধারণ প্রোস্টেট বৃদ্ধি অনেক সময় ক্যানসারকে নিয়ে আসে যদি তা সময় মতো চিকিৎসা না করে উপেক্ষা করা হয়। তাই লক্ষণ বিচার করে প্রথম থেকে যদি আয়ুর্বেদিক প্রণালীতে চিকিৎসা করা হয়, তাহলে ভালো ফল পাওয়া যায়। অন্যান্য যে ১২ প্রকার ইউরিনারি রিটেনশন বা মুত্রাঘাত আয়ুর্বেদে বলা হয়েছে সেগুলোরও উপযুক্ত চিকিৎসায় সারানো সম্ভব।
 

মূত্রাঘাতের সাধারণ লক্ষণ

মূত্রের বিবন্ধতা বা মূত্রবেগ আটকে যাওয়া, ব্যথা, অস্বস্তি সঙ্গে মূত্রকৃচ্ছ্র রোগের লক্ষণওযুক্ত হয়। প্রোস্টেট গ্রন্থির বৃদ্ধির জন্য বিশেষ লক্ষণগুলি হল— মুত্র ত্যাগের কষ্ট, ফোটা ফোটা প্রস্রাব নির্গমন, ঘন ঘন মূত্রত্যাগ, বিশেষ করে রাত্রিবেলা। প্রস্রাব করার পরও যেন মনে হয় ঠিক মতো হল না, আরও একটু হলে ভালো হয়। মূত্রের বেগে জোর কমে যাওয়া। প্রস্রাব পেলেই সঙ্গে সঙ্গে ত্যাগ করার প্রয়াস, অন্যথায় মূত্র বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা ইত্যাদি।

আরও পড়ুন:

ত্বকের হারানো ঔজ্জ্বল্য ফিরবে এই ৩ পানীয় নিয়মিত খেলে

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২: চলমান সুন্দরবন

 

চিকিৎসা

অন্যান্য রোগের মতো এই রোগের ক্ষেত্রেও নিদান বা কারণগুলিকে বাদ দিতে হবে। সুতরাং মলমূত্রের বেগ ধারণ করা, কড়াপাক, রুক্ষ মশালাদার খাবার ইত্যাদি যে নিদান পূর্বে বলা হয়েছে, তা বাদ দিতে হবে। সাধারণত দু’রকম চিকিৎসা অর্থাৎ সংশোধন ও সংশমন চিকিৎসা এই ক্ষেত্রে দেওয়া হয়। সংশোধন অর্থাৎ শরীরের ভেতরের প্রকুপিত দোষকে বিভিন্ন প্রক্রিয়া, যেমন স্নেহন, স্বেদন, স্নেহ, বিরেচন ইত্যাদির মাধ্যমে বাইরে বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়। সঙ্গে বস্তি প্রয়োগ বিশেষ করে মূত্রমার্গ দিয়ে উত্তরবস্তি এবং মলমার্গ দিয়ে আস্থাপন ও অনুবাসন বস্তি প্রয়োগ করার ব্যবস্থা আছে। সেক্ষেত্রে বৈদ্যের উপস্থিতিতে করা বাঞ্ছনীয়।
 

সংশমন চিকিৎসা বাড়িতেই সহজে করা যায়

 

চূর্ণ হিসেবে

পাথুরির ক্ষেত্রে পাষাণভেদাদ্য চূর্ণ ৩ গ্রাম দিনে দু’ বার। অন্যান্য ক্ষেত্রে পুনর্নবাদী চূর্ণ ৩ গ্রাম করে দু’ বার দেওয়া হয়। কোষ্ঠকাঠিন্য সারাতে ও বায়ুর অনুলোমনের জন্য পথ্যাদি চূর্ণ ৩ থেকে ৫ গ্রাম রাতে শোয়ার সময় গরম জল-সহ দেওয়া যায়।
 

ক্বাথ বা পাচন হিসাবে

বরুণাদি ক্বাথ, এলাদি ক্বাথ, চন্দনাদি ক্বাথ ইত্যাদির মধ্যে যেকোনও একটি ২০ মিলি লিটার করে দিনে একবার বা দু’ বার সমপরিমাণ জল-সহ খাওয়ানো যায়।
 

বটি হিসাবে

চন্দ্রপ্রভা বটি, আরোগ্য বর্ধনী বটি ২৫০ মিলিগ্রাম থেকে ৫০০ মিলিগ্রাম দিনে দু’ বার দেওয়া যায়। শুদ্ধ শিলাজিত ১২৫ মিলিগ্রাম থেকে ২৫০ মিলিগ্রাম দিনে দু’ বার দেওয়া যায়।
 

রসৌষধী হিসাবে

চন্দ্রকলা রস, তারকেশ্বর রস, বঙ্গেশ্বর রস ১২৫ মিলিগ্রাম থেকে ২৫০ মিলিগ্রাম দিনে দু’ বার মধু-সহ দেওয়া যাবে।
 

ঘৃত ঔষধি

চিত্রকাদ্য ঘৃত, বিদারী ঘৃত ১০ মিলিলিটার থেকে ২০ মিলিলিটার দেওয়া যায়।
 

তৈল হিসেবে

শিলাভেদাদী তৈল ১০ মিলিটার থেকে ২০ মিলিলিটার দিনে এক থেকে দু’ বার দেওয়া যেতে পারে।

আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৪: এ শুধু অলস মায়া?

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৫: আমাদের নাকি রোজই চুল পড়ে!

 

আসব বা আরিষ্ট হিসাবে

পুনর্নবাদীরিষ্ট, চন্দনাসব, অমৃতারিষ্ট, ধান্যাসব ইত্যাদি ২০ মিলিলিটার থেকে ৪০ মিলিলিটার সমপরিমাণ জল-সহ খাওয়ানো যেতে পারে।
 

পিষ্টি হিসাবে

প্রবাল পিষ্টি, মোতি পিষ্টি, জহরমোহরা বৃষ্টি ২৫০ মিলিগ্রাম দিনে দু’বার মধু-সহ দেওয়া যায়।
 

ক্ষার ঔষধি

যবক্ষার বা বজ্রক্ষার ২৫০ মিলিগ্রাম থেকে ৫০০ মিলিগ্রাম ১ থেকে ২ বার খাওয়ানো যায়।

* বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ (Ayurveda) : ডাঃ প্রদ্যোৎ বিকাশ কর মহাপাত্র (Dr. Pradyot Bikash Kar Mahapatra), অধ্যাপক ও চিকিৎসক, ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্রাজুয়েট আয়ুর্বেদিক এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ।

Skip to content