শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী।

গৃধ্রসী রোগ একটি বাতব্যাধি বলে পরিচিত সমস্যা, যেখানে কটি (কোমর), নিতম্ব (বাটক), পা ইত্যাদি জায়গায় প্রবল ব্যথা এবং সেই ব্যথা গোড়ালি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে হাঁটা চলায় কষ্ট আনে। রোগী যন্ত্রণায় কাতর হন। প্রতিবন্ধীর মতো চলৎশক্তি রহিত হয়ে পড়েন। ‘গৃধ্র’একটি সংস্কৃত শব্দ, যার অর্থ হল শকুন। এই রোগে আক্রান্ত মানুষ শকুনের মতো পায়ের পাতায় ভর দিয়ে গোড়ালিকে তুলে রেখে হাঁটার চেষ্টা করেন। ইংরাজিতে একে ‘ভালচার গেইট’ বলা হয়। এই রোগে গৃধ্রসী নাড়ি বা সায়াটিকা নার্ভ আঘাতগ্রস্ত বা আক্রান্ত হয়ে এই ধরনের লক্ষণ গুলো নিয়ে আসে, যা আধুনিক বিজ্ঞানে সায়াটিকা বা সায়াটিকা সিনড্রোম-এর সমতুল্য।
সারা পৃথিবীতে প্রায় পঞ্চাশ ভাগ লোক জীবনে কোনও না কোনও সময় এই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন।
 

নিদান

যেহেতু এই রোগ মূলতঃ সায়াটিকা নার্ভকে আহত করে উৎপন্ন হয়, তাই উঁচু-নিচু রাস্তায় হাঁটা বা সাইকেল আরোহণ অন্যান্য যানে ঝাঁকুনি-সহ সফর, সামনে ঝোঁকা, সামনে ঝুঁকে ভারী জিনিস তোলা, রাতজাগা, মলমূত্রের স্বাভাবিক বেগ ধারণ, শরীরের ওজন বৃদ্ধি, অত্যধিক শীতল জল ও বাতাসের সংযোগ ইত্যাদি জীবনশৈলীর ত্রুটি-বিচ্যতি গুলির সঙ্গে খাদ্য-খাবারের অনিয়ম যেমন শুকনো, বাসি, শীতল খাবার, উপবাস ইত্যাদি কারণ শরীরের বায়ু দোষকে প্রকুপিত করে এবং সেই বায়ু কটি দেশ বা কোমরের অস্থিসন্ধির স্থলে স্নায়ুকে স্বস্থান থেকে সরিয়ে দেয়,প্রদাহ তৈরী করে ও এই বিচ্যুতির ফলে প্রভূত ব্যথা ও বেদনা হয়। সেই ব্যথা সায়টিকা নার্ভ বা গৃধ্রসী নাড়ির পথ দিয়ে কোমরের পেছন থেকে নিতম্ব বেয়ে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এই বায়ু বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কখনও কখনও কফও প্রকুপিত হয় এবং ঐ বায়ুকে অবরুদ্ধ করে। তাই আয়ুর্বেদে ‘বাতজ গৃধ্রসী’ ও ‘বাতকফজ গৃধ্রসী’ এই দুই ধরনের গৃধ্রসী দেখা যায়।

আরও পড়ুন:

বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ: বাতরক্ত বা গাউটে ভুগছেন? ঘরে বসেই মুক্তির উপায় জানুন

| উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৯: সুরের আকাশে ঘটালে তুমি স্বপ্নের ‘শাপমোচন’

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৬: কবির ভালোবাসার পশুপাখি

 

রোগের লক্ষণ

বাতজ গৃধ্রসীতে সুচ ফোটানোর মতো ব্যথা, শরীরের বক্রভাব হয়ে যাওয়া, কোটি (কোমর), ঊরু (থাই), জানু (হাঁটু) ইত্যাদিতে বেশি বেদনা, আড়ষ্টতা ও ঝিমঝিনে অনুভূতি হয়।

বাতকফজ গৃধ্রসীতে উপরিউক্ত লক্ষণ ছাড়াও অজীর্ণ, অরুচি, মুখে লালাশ্রাব, জ্বর জ্বর ভাব ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়।

আধুনিক বিজ্ঞানের মতে, লাম্বার ডিস্ক প্রলাপস, লাম্বার ভার্টিব্রাল কম্প্রেশন বা ডিজেনারেটিভ ডিস্ক ডিজিজ ইত্যাদিতে এই ধরনের লক্ষণ দেখা যায়।এখনকার দিনে লাম্বার স্পন্ডিলাইটিস ও এঙ্কাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস বহুল পরিলক্ষিত হচ্ছে।

আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৮: ড. হীরালাল চৌধুরীর আবিষ্কার আজও পোনামাছ চাষীদের কাছে এক পরম আশীর্বাদ

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১২: দক্ষ কর্মী নির্বাচন বনাম নারী সহকর্মী

চলো যাই ঘুরে আসি: চুপি চুপি ঘুরে আসি

 

রোগের চিকিৎসা

যেহেতু আয়ুর্বেদ মতে রোগের কারণ বা নিদানকে বাদ দেওয়া প্রধান চিকিৎসা, তাই রোগৎপত্তির ক্ষেত্রে যে যে কারণগুলি বলা হয়েছে তার থেকে রোগীকে বিরত রাখাটাই প্রধান কাজ।
 

মালিশ

ক্ষীরবলা তেল, পিণ্ড তেল, মধ্যম নারায়ণ তেল, মহা নারায়ণ তেল, মহামাষ তেল ব্যবহার করা হয়, সঙ্গে গরম সেঁক দেওয়া হয়।
 

চূর্ণ

বৈশ্বানর চূর্ণ, আজমোদাবি চূর্ণ ইত্যাদি দেড় থেকে তিন গ্রাম দিনে দু’ বার গরম জল-সহ দেওয়া যাবে।
 

পাচন

দশমূল ক্বাথ, রাস্না দশমূল ক্বাথ, অষ্টবর্গ কষায় ইত্যাদি কুড়ি মিলিলিটার করে দিলে দু’ বার গরম জল-সহ সকাল সন্ধে দেওয়া যায়।

ত্রয়োদশাঙ্গ গুগগুলু, সিংহনাথ গুগগুলু, যোগরাজ গুগগুলু, রাস্নাদি গুগগুলু ৫০০ মিলিগ্রাম দিনে দু’ বার গরম জল সহদেওয়া যাবে।
 

রসৌষধি

বাতগজাঙ্কুশ, বাতোগজেন্দ্র সিংহ, রামবান রস, অগ্নিতুণ্ডি বটি ইত্যাদি ২৫০ মিলিগ্রাম দিনে দু’ বার গরম জল সহ দেওয়া যাবে।

প্রত্যহ পায়খানা হওয়ার জন্য পথ্যাদি চূর্ণ, পঞ্চ সকার চূর্ণ, ত্রিফলা চূর্ণ তিন থেকে পাঁচ গ্রাম রাতে শোবার সময় গরম জল-সহ খাওয়ানো যায়।

বর্তমানে কটি বস্তি অর্থাৎ কোমরের উপরে মালিশে দেওয়ার যে কোনও একটি তেল সহ্যমতো গরম করে আটার লিচি দিয়ে রিং বলের সমান আকারে কোমরের ওপরে রেখে ১০০ থেকে ১৫০ মিলিলিটার তেল প্রত্যহ ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট রাখতে পারলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

আয়ুর্বেদ মতে উপযুক্ত ব্যবস্থাগুলি ছাড়াও হাসপাতালে ভর্তি রেখে পায়খানার দ্বার দিয়ে বস্তি প্রয়োগ নিয়ম মতো করলে আরও ভালো ফল পাওয়া যাবে।

আরও পড়ুন:

ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে, আপনি কি বডি শেমিং-এর শিকার?

ত্বকের পরিচর্যায়: ফর্সা হওয়ার দৌড়ে না গিয়ে স্বাভাবিক রং নিয়েই সুন্দর ও সুরক্ষিত থাকুন, জানুন ত্বক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ

হাত বাড়ালেই বনৌষধি: সবসময়ের সাথী ‘হরিতকী’

 

পথ্য

অশ্বগন্ধা,দ্রাক্ষা, বেগুন, পটল, দুধ, ঘি, মাখন, কড়িভস্ম, শঙ্খভস্ম, গরম জল, গরম সেঁক এবং বিশ্রাম ও সামনে না ঝোকার হালকা ব্যায়াম।
 

অপথ্য

চানা, মটর, মদ্য, কাঁচা মাংস পনির, কাঁচা ফল, সুপারি, দিনে ঘুম, রাত জাগা, দই, পায়েস ইত্যাদি।

* বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ (Ayurveda) : ডাঃ প্রদ্যোৎ বিকাশ কর মহাপাত্র (Dr. Pradyot Bikash Kar Mahapatra), অধ্যাপক ও চিকিৎসক, ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্রাজুয়েট আয়ুর্বেদিক এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ।

Skip to content