শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

কৃমি অতি পরিচিত একটি শব্দ। আমরা ছেলেবেলা থেকেই ঘরে-বাইরে শুনে এসেছি। পায়খানায় ছোট ছোট কৃমি বেরোয়, এটাও সবার জানা। বড় বড় লম্বা লম্বা ক্রিমিকে পায়খানার রাস্তা থেকে বেরিয়ে আসতে ও দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষে কৃমি একটি সংস্কৃত শব্দ, একে পর্যালোচনা করলে জানা যায় যে, ‘ক্রব্যে মেদ্যতি’। অর্থাৎ মাংসের প্রতি এর অত্যন্ত স্পৃহা বা আসক্তি বলেই এর নাম কৃমি। আধুনিক বিজ্ঞান এই কৃমিকে ওয়ার্ম বা হেলমিন্থ বলে অভিহিত করেছে।

২০১৫ সালের এক সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, সারা ভারতে প্রায় ২৬ কোটি মানুষ এই কৃমির দ্বারা আক্রান্ত। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার প্রতি ৫ জন মানুষের মধ্যে প্রায় একজন মানুষকে এই কৃমিতে সংক্রমিত হতে দেখা যায়। এই কৃমিগুলি আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিভিন্ন ধরনের আকৃতি অনুযায়ী বা এদের অবস্থান ও রোগ তৈরির ক্ষমতা অনুযায়ী বিভিন্ন নামে অভিহিত হয়েছে। যেমন প্রায় ১৫ কোটি ভারতীয়কে ত্র্যাসকারিস নামে কৃমিতে আক্রান্ত হতে দেখা গেছে। ১১ কোটি মানুষ কে হুক ওয়ার্ম ও ৪ কোটি মানুষ কে ট্রাইচুরিস নামক কৃমির সংক্রমনে ভুগতে হয়েছে। সারা পৃথিবীর নিরিখে মোট কৃমি আক্রান্ত মানুষের ২৪ ভাগ মানুষের বাস আমাদের এই ভারতবর্ষেই। সাধারণত অন্ত্রগত কৃমিতে প্রায় ৪৪ শতাংশ শিশু আক্রান্ত হয় এবং তার কুপ্রভাব থেকে নানান রোগে ভুগে চলেছে।

সুতরাং এটা অনস্বীকার্য যে, কৃমির আক্রমণ একটি অতি ভয়ংকর জনস্বাস্থ্য সমস্যা। দেখা যাক আয়ুর্বেদ শাস্ত্র, এই সমস্যার ব্যাখ্যা ও সমাধানের উপায় কীভাবে ব্যক্ত করেছে। কৃমির প্রকারভেদ নিয়ে আয়ুর্বেদ আচার্যদের কিঞ্চিত মতভেদ থাকলেও যেহেতু মহর্ষি চরক চিকিৎসাতে শ্রেষ্ঠ পথ প্রদর্শক হিসেবে পরিগণিত হন, তাই তাঁর মতকে প্রাধান্য দিয়ে বলা যায়— কৃমি প্রধানত দুই প্রকার। বাহ্য কৃমি ও আভ্যন্তর ক্রিমি। বাহ্য ক্রিমি আবার দু প্রকারের— যূকা এবং লিখ্যা।

আভ্যন্তর কৃমি আবার উৎপত্তি ভেদ অনুযায়ী তিন রকম, আর সংখ্যা অনুযায়ী ১৮ প্রকার। যেমন, পুরীষজ ক্রিমি পাঁচ প্রকার (ককেরুক, মকেরুক, লেলিহ, সশূলক ও সৌসূরাদ)। কফজ কৃমি সাত প্রকার (অন্ত্রাদ, উদরাদ, হৃদয়াদ, চুরু, দর্ভপুষ্প ও সৌগন্ধিক)। রক্তজ ক্রিমি ছয় প্রকার (কেশাদ, লোমাদ, লোমদ্বীপ, সৌরস, ঔদুম্বর ও জন্তুমাতা)। এই প্রভেদ অনুযায়ী সব শুদ্ধ ২০ প্রকারের কৃমির উল্লেখ আয়ুর্বেদ আচার্যরা করে গিয়েছেন। বস্তুত আয়ুর্বেদ সমস্ত রকমের জীবণুকে কৃমি বলে মেনেছে। আধুনিক বিজ্ঞানে ব্যাকটিরিয়া, ভাইরাস, প্যারাসাইট ইত্যাদি সবই আয়ুর্বেদের কৃমি পদবাচ্য।
 

কৃমির নিদান

অজীর্ন অবস্থায় বা আগের খাবার হজম হয়নি সেই অবস্থায় আবার খেয়ে নেওয়া, বেশি বেশি মিষ্টি খাওয়া, বেশি টক খাওয়া, জলীয় খাবার বেশি খাওয়া, পিঠে পুলি বা গুড় জাতীয় খাবার বেশি খাওয়া, শারীরিক শ্রম না করা, দুপুরে ঘুম দেওয়া, শরীরের মল ঠিকমতো না ধোয়া, স্নান না করা, খাদ্য বা পানীয় অপরিশ্রুত অবস্থায় গ্রহণ করা, গুরুপাক খাবার বেশি খাওয়া, শাকসব্জি ঠিকমতো না ধুয়ে বা পাক করে খাওয়া, পচা বা বাসি খাবার খাওয়া, মাছ-মাংস ইত্যাদি ঠিকমতো পাক না করে খাওয়া, মল-মূত্রাদির সঙ্গে আহার বা পানিয়ের সংযোগ স্থাপনা, হাত না ধুয়ে খাওয়া, নখ না কাটা, কাঁচা চাল বা দানাদার শস্য খাওয়া, দই পায়েস ইত্যাদি বেশি বেশি খাওয়া প্রভৃতি কারণে কৃমির উৎপত্তি হয়, সেই সঙ্গে পেটের মধ্যে ক্রমশ বংশবিস্তার করে।এই কৃমি রক্তের মধ্যে পরিবাহিত হয়ে ও বিভিন্ন স্থানে নানান উপদ্রবকে উপস্থাপিত করে।
 

রোগের সম্প্রাপ্তি বা রোগ তৈরির ক্রম

উপরিউক্ত নিদানগুলির জন্য কৃমির উৎপত্তি হয়ে সারা শরীরে বাহিত হয়। এক্ষেত্রে তিনটি দোষ বায়ু, পিত্ত ও কফের মধ্যে কফ দোষ বিশেষভাবে প্রকুপিত হয়ে মল, রক্ত ও রস ধাতুকে বিশেষভাবে দূষিত করে এবং পক্কাশয়-সহ সারা অন্নবহ স্রোতকেই আশ্রয় করে এবং বিভিন্ন রকমের লক্ষণ প্রদর্শন করে।

আরও পড়ুন:

বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ: মুখের রুচি চলে গিয়েছে? আয়ুর্বেদ উপায়ে অরুচি দূর করবেন কী ভাবে?

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-১: ভিতরকুঠি টেরাকোটা শিবমন্দির এক অনন্যসাধারণ কোচ স্থাপত্যশৈলীর উদাহরণ

 

কৃমি রোগের লক্ষণ

বাহ্য কৃমি

সাধারণত কন্ডু, কোঠ এবং পিড়কা তৈরি করে।
 

সমস্ত ধরনের কৃমির সাধারণ লক্ষণ

জ্বর, ত্বকের বিবর্ণতা, পেটে ব্যথা, হৃদরোগ, শরীরের মাংস পেশির শিথিলতা, মাথা ঘোরা, অরুচি, বারবার পাতলা পায়খানা হওয়া, দুর্বলতা, পায়খানার রাস্তায় কামড়ানোর মতো বোধ হওয়া, শরীর শুকিয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
 

পুরীষজ কৃমির বিশেষ লক্ষণ

বারবার পাতলা জলের মতো পায়খানা হওয়া, রক্তাল্পতা, দুর্বল বোধ, পেট শক্ত হওয়া, শরীরে শিরশিরানি বোধ, পায়খানার রাস্তায় চুলকানো, পায়খানার সঙ্গে কৃমি বেরিয়ে আসা, ঘুমের ঘোরে দাঁত কিরমির।
 

কফজ কৃমির বিশেষ লক্ষণ

বমি বমি ভাব, মুখে লালা ঝরা, অরুচি, অজীর্ণ হওয়া, জ্বর, মূর্ছা, বেশি হাই তোলা, হাঁচি হওয়া, পেট ফাঁপা, গায়ে ব্যথা, বমি, শরীর ও মুখ শুকিয়ে যাওয়া।
 

রক্তজ কৃমির বিশেষ লক্ষণ

শরীরে চুলকানি, অস্বস্তি বোধ, ছুঁচ ফোটানোর মতো ব্যথা, শরীরের চুল পড়ে যাওয়া, মাথার চুল পড়া, শিরা স্নায়ু মাংসপেশির শিথিলতা, চোখের পাতার চুল পড়ে যাওয়া, নখ ভেঙে যাওয়া ইত্যাদি।
 

কৃমি রোগের চিকিৎসা

সিদ্ধান্ত: আচার্য চরক কৃমি চিকিৎসার তিনটি সিদ্ধান্ত বলেছেন।
অপকর্ষণ (ক্রিমিকে বাইরে বের করে দেওয়া)
প্রকৃতি বিঘাত (অভ্যন্তরীণ পরিবেশকে কৃমির অননুকূল করে কৃমিকে বাঁচতে বা বাড়তে না দেওয়ার ব্যবস্থা করা) ও
নিদান পরিবর্জন (যে কারণে কৃমির উৎপত্তি হচ্ছে তাকে বাদ দেওয়া)।

আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-১: একটু শুরুর কথা হলে ক্ষতি কী…

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৬৭: প্রবাল প্রাচীর আমাদের ভবিষ্যতের ওষুধের ভাণ্ডার

 

সংশোধন চিকিৎসা

কৃমি রোগের সংশোধন চিকিৎসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসকের উপস্থিতিতে বমন, বিবেচন, আস্থাপন, শিরঃবিরেচন ইত্যাদি সংশোধন কর্ম করে শরীরের দোষকে বাইরে বের করে দিলে কৃমির উৎপত্তি রোধ করা যায়।
 

সংশমন চিকিৎসা

ঔষধি প্রয়োগের দ্বারা কৃমির উৎপত্তি রোধ করা এবং কৃমি জনিত বিভিন্ন লক্ষণ এবং উপদ্রবকে শমিত করার ব্যবস্থা।
 

চূর্ণ ঔষধি

বিড়ঙ্গ চূর্ণ, পলাশ বীজ চূর্ণ, পারসিকাদি চূর্ণ ইত্যাদি বড়দের ক্ষেত্রে ৩ গ্রাম দু’ বার আর ছোটদের ক্ষেত্রে ১ গ্রাম বা ৫০০ মিলিগ্রাম দিনে দু’ বার হালকা গরম জল-সহ দিলে কৃমি মরে ও পরে আর উৎপন্ন হয় না।
 

বটি ঔষধি

কৃমি ঘাতনী বটিকা, লাক্ষাদী বটি, সঞ্জীবনী বটি ২৫০ মিলিগ্রাম থেকে ৫০০ মিলিগ্রাম দু’বার বড়দের জন্য, আর ছোটদের ক্ষেত্রে ১২৫ মিলিগ্রাম দিনে দু’বার গরম জল-সহ।
 

ক্বাথ বা পাচন

খেজুরপত্র ক্বাথ, মুস্তাদি ক্বাথ বড়দের ক্ষেত্রে ২০ মিলি লিটার এবং ছোটদের ক্ষেত্রে ১০ মিলি লিটার প্রতিদিন একবার বা দু’বার খাওয়ানো যায়।
 

রসৌষধি

কৃমিমুদ্গর রস, কৃমি হর রস, কৃমিকালানল রস, যে কোনও একটি বড়দের ক্ষেত্রে ২৫০ মিলিগ্রাম দিনে দু’ বার এবং ছোটদের ক্ষেত্রে ১২৫ মিলিগ্রাম দিনে দু’বার উষ্ণজল বা মধু-সহ খাওয়ানো যায়।
 

ঘৃত ঔষধি

বিড়ঙ্গাদ্য ঘৃত, ত্রিফলাদ্য ঘৃত, যেকোনও একটি বড়দের ১০ মিলিলিটার দু’বার এবং ছোটদের ক্ষেত্রে ৫ মিলিলিটার এক থেকে দু’বার দেওয়া যায়।
 

অরিষ্ট বা আসব ঔষধি

বিড়ঙ্গারিষ্ট, মুস্তকারিষ্ট, যেকোনও একটি বড়দের ক্ষেত্রে ২০ মিলিলিটার দিনে দু’বার সমপরিমাণ গরম জল-সহ খাওয়ানো যায়।
 

পাক বা অবলেহ

বিড়ঙ্গাবলেহ, পারিভদ্রাবলেহ যেকোনও একটি ১০ গ্রাম করে বড়দের জন্য, আর ছোটদের ২ থেকে ৫ গ্রাম চেটে চেটে খেতে দেওয়া যায়।

আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫: চন্দ্রমণির বধূবরণ

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩১: বিড়াল ঘাঁটলেই কি ডিপথেরিয়া হতে পারে?

 

এছাড়াও

কিছু একক দ্রব্য কৃমিরনাশ করতে সমর্থ্য যেমন, পারসিক যমানি, বিড়ঙ্গ, পারিভদ্রপত্র, পলাশ বীজ, সুপারি, আনারস পাতার নিচের সাদা অংশের রস, ডালিমের বীজ, স্বর্ণক্ষীরী বীজ এদের চূর্ণ করে বড়দের ক্ষেত্রে ৩ গ্রাম এবং ছোটদের ক্ষেত্রে হাফ গ্রাম থেকে ১ গ্রাম দিনে দু’বার গরম জল-সহ দেওয়া হয়। অথবা কলি চুনের উপরের জল দিয়ে খেতে দেওয়া হয়।
 

পথ্য

পুরনো চালের ভাত, গমের রুটি, অড়হর ডাল, সবুজ সুসিদ্ধ সব্জি, পটল, উচ্ছে, সজনেডাঁটা, উষ্ণ দুধ, ঘি, ঘোল, মানকচু ইত্যাদি।
 

অপথ্য

দুধ ও মাছ একসঙ্গে খাওয়া, পায়েস ও মাংস বা দই ও মাংস একসঙ্গে খাওয়া, অতি ভোজন, দুপুরে ঘুম, কাঁচা চাল খাওয়া, বেশি চিনি বা মিষ্টি খাওয়া, অপরিষ্কার বা অপরিচ্ছন্ন থাকা।

* বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ (Ayurveda) : ডাঃ প্রদ্যোৎ বিকাশ কর মহাপাত্র (Dr. Pradyot Bikash Kar Mahapatra), অধ্যাপক ও চিকিৎসক, ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্রাজুয়েট আয়ুর্বেদিক এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ।

Skip to content