শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

আয়ুর্বেদে কাশ রোগ ও কাশ লক্ষণ এই দুই ভাবে কাশিকে বিবেচনা করা হয়েছে। কাশ যখন স্বতন্ত্র্য ভাবে দেখা যায় তখন সেটা কাশ রোগ। কিন্তু যখন অন্য রোগের লক্ষণ হিসাবে প্রতীয়মান হয় তখন শুধুই কাশ নামে পরিচিত হয়। আধুনিক বিজ্ঞানে কাশ বা কাশি মূলতঃ একটি লক্ষণ।

আয়ুর্বেদ মতে কণ্ঠ দেশে অবস্থিত উদান বায়ু যদি বিকৃত হয় এবং প্রাণ বায়ুর সঙ্গে এই বিকৃত উদান বায়ু মিলিত হয়ে যখন কণ্ঠদেশ থেকে সবেগে বিকৃত (ভাঙা কাঁসার বাসনের শব্দের মতো) শব্দের সঙ্গে মুখ থেকে নির্গত হয় তখনই তাকে কাশ বলে। আধুনিক বিজ্ঞানে বিভিন্ন রকম কাশির নাম জানা যায়। যেমন:
 

আধুনিক বিজ্ঞানে বিভিন্ন রকম কাশি

 

ড্রাই কাফ

অর্থাৎ যেখানে শুধুমাত্র শুকনো কাশি থাকে। কোনও রকম কফ ওঠে না।
 

প্রোডাক্টিভ কাফ

যেখানে কাশির সঙ্গে কফ জলের মতো বা থোকা থোকা ওঠে। একে ওয়েট কাফ ও বলা হয়ে থাকে।
 

প্যারাক্সিসমাল কাফ

অত্যন্ত বীভৎস কাশি। কিছুতেই রুখতে পারা যায় না। খুবই বেদনাদায়ক এবং কষ্টকর কাশি।
 

ক্রাউপ কাফ

যেখানে নাসারন্ধ্র থেকে শ্বাসযন্ত্র পর্যন্ত ঊর্ধ্ব ভাগের শ্বাসনালীতে জীবাণু সংক্রমণের কারণে শ্বাস প্রশ্বাস যাতায়াতের রাস্তায় অবরোধ তৈরি হয় এবং কাশি উৎপন্ন হয়। সাধারণতঃ বাচ্চাদের ক্ষেত্রেই বেশি দেখা যায়।
 

হুপিং কাফ

এটি একটি অত্যন্ত ভয়ানক ভাইরাসের সংক্রমণ জন্য কষ্টকর কাশি, যাকে সাধারণতঃ প্রতিহত করার জন্য প্রতিষেধক টিকা নেওয়া হয়ে থাকে। এর প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হওয়া সত্ত্বেও সারা ভারতে ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রায় ৩২ হাজার মানুষ এই ‘হুপিং কাফে’ আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে চার জনের মৃত্যু হতেও দেখা গিয়েছে।
 

স্মোকার্স কাফ

এই নামকরণ থেকে সহজেই বোঝা যাচ্ছে যারা বিড়ি, সিগারেট ইত্যাদির ধূমপান করেন তাঁদের যে কাশি হয় সেটাই স্মোকার্স কাফ।
 

জেরিয়েট্রিক কাফ

বার্ধক্যের জন্য রোগী যখন ঘন ঘন কাশিতে আক্রান্ত হন, বিশেষ করে শ্বাসযন্ত্রের ক্ষমতা যখন কমে যায় তখনই এই কাশি দেখা যায়। নিউমোনিয়া বা ব্রঙ্কাইটিসের লক্ষণ হিসাবে বয়স্ক মানুষেরা এই কাশিতে পর্য্যুদস্ত হন।

 

কাশ রোগের কারণ বা নিদান

অত্যধিক ধুলো বা ধোঁয়ার সংস্পর্শে আসা, অত্যধিক পরিশ্রম, শুকনো নীরস রুক্ষ খাদ্য খাবার, খাদ্য বা পানিয়ের বিমার্গ গমন অর্থাৎ খাদ্যনালীতে না গিয়ে শ্বাসনালীতে চলে যাওয়া,হাঁচির বেগ চেপে রাখা, অত্যাধিক উপবাসে থাকা, বেশি মৈথুন করা, বেশি ঝাল, কড়া পাক খাবার ইত্যাদি কারণে যখন বায়ু বিকৃত হয় এবং বিশেষ করে কণ্ঠদেশের উদান বায়ু বিকৃত হয়ে যখন প্রাণ বায়ুর সঙ্গে মিলিত হয় তখন এই রোগ উৎপন্ন হয়। আয়ুর্বেদ আর্দ্র কাশ ও শুষ্ক কাশ কে স্বীকার করেছে যা ওয়েট কাজ এবং ড্রাই কাফের সমতুল্য।
 

কাশ রোগের প্রকারভেদ

আয়ুর্বেদ সাধারণত ৫ প্রকার কাশির কথা উল্লেখ করেছে। বাতজ কাশ, পিত্তজ কাশ, কফজ কাশ, ক্ষতজ কাশ এবং ক্ষয়জ কাশ। বাতজ, পিত্তজ ও কফজ কাশ সাধারণতঃ কাশ রোগের নিদানগত ও লক্ষণগত বৈশিষ্ট্যের উপর দৃষ্টি রেখে নির্ণয় করা হয়। যেমন:
 

বাতজ কাশ

এক্ষেত্রে কাশির নিরন্তর বেগ, শুষ্ক কাশ, বুকে পিঠে ব্যথা এই লক্ষণগুলি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
 

পিত্তজ কাশ

বুকে জ্বালা করার মতো অস্বস্তি, মুখের শুষ্কতা, তৃষ্ণা ইত্যাদি দেখা যায়।
 

কফজ কাশ

মুখে কফ ওঠা, অরুচি, নাক ও চোখ দিয়ে জল পড়া ইত্যাদি লক্ষণগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
 

ক্ষতজ কাশ

প্রথম অবস্থায় শুষ্ক কাশি ও পরে রক্ত ওঠা, গলা ও বুকে ব্যাথা, জ্বর ইত্যাদি থাকে। এই কাশ সাধারণত বুকে আঘাত থেকে উৎপন্ন হয়। অর্থাৎ যখন বাইরের কোনও আঘাত যখন শ্বাসবাহী অঙ্গগুলিতে ক্ষত তৈরি করে তখন এই রোগ দেখা যায়।
 

ক্ষয়জ কাশ

সাধারণত শরীরের অত্যাধিক ক্ষয় থেকে হয়। যেমন: রাজ যক্ষ্মা ইত্যাদিতে দেখা যায়, এক্ষেত্রে অত্যাধিক দুর্বলতা,অরুচি, বুকে ব্যথা ইত্যাদির সঙ্গে কাশি, কখনও কখনও ঘন পুরু রক্ত কফের সঙ্গে নির্গমন হতে দেখা যায়।

আয়ুর্বেদে জরাজ কাশ বা বার্ধক্য জনিত কাশের কথাও কোনও কোনও শাস্ত্রকার উল্লেখ করেছেন। কিন্তু প্রবীণ শাস্ত্রকারগন, জরাজ কাশের আলাদা করে উল্লেখ না করে, যেহেতু বৃদ্ধাবস্থায় বাতের প্রকোপ স্বাভাবিক তাই এই কাশিকে বাতজ কাশের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

আরও পড়ুন:

বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ: ব্রঙ্কাইটিস বা ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমাতে আতঙ্কিত হবেন না, ভরসা রাখুন আয়ুর্বেদে

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২২: স্টেরয়েড বড় ভয়ঙ্কর ওষুধ?

 

চিকিৎসা

অন্যান্য রোগের মতো এই রোগের চিকিৎসায় ও প্রথমেই নিদান বা কারণকে বর্জন করার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ পূর্বে উল্লেখ করা ধুলো ধোঁয়ার সংস্পর্শে আসা, অতি পরিশ্রম করা, শুকনো, রুক্ষ, ঝাল খাবার খাওয়া, উপবাস দেওয়া ইত্যাদি যে নিদান তাকে পরিত্যাগ করতেই হবে।
 

শুষ্ক কাশে

তালিশাদি চূর্ণ দেড় গ্রাম করে দিনে দু-তিনবার মধু-সহ চেটে খাওয়া যায়।
 

চন্দ্রামৃত রস

২৫০ মিলিগ্রাম দিনে তিনবার তাল মিছরি-সহ চুষে খাওয়া যায়।
 

কাশ কুঠার রস

২৫০ মিলিগ্রাম দিনে দুবার মধু-সহ খাওয়া যায়
 

মরিচ্যাদি বটি

২৫০ মিলিগ্রাম দিনে তিনবার মধু-সহ খাওয়া যায়।

আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৪: কিশোরের শুধু কণ্ঠই নয়, তাঁর অভিনয় ক্ষমতাকেও গানের নেপথ্যে সুকৌশলে কাজে লাগাতেন পঞ্চম

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১: আমি ‘কেবলই’ স্বপন…

 

আর্দ্র কাশিতে

 

সিতোপলাদি চূর্ণ

দেড় গ্রাম করে দিনে তিনবার মধু-সহ চেটে খাওয়া যায়।
 

বামাবলেহ

৫ থেকে ১০ গ্রাম দিনে দু’বার চেটে খাওয়া যায়
 

লক্ষী বিলাস রস

২৫০ মিলিগ্রাম দিনে দু’বার আদার রস দিয়ে চিবিয়ে খাওয়া যায়।
 

আর্দ্র বা শুষ্ক বা যে কোনও কাশে

 

শ্বাসকাস চিন্তামণি রস

১২৫ থেকে ২৫০ মিলিগ্রাম দিনে দু’বার মধু-সহ খেতে দিতে হবে।
 

কাসান্তক রস

২৫০ মিলিগ্রাম দিনে দু’বার।
 

দশমূল ক্বাথ

২০ মিলি লিটার দিনে দু’বার সমপরিমাণে জল-সহ দিতে হবে।
 

আভ্রক ভস্ম, প্রবাল ভস্ম

২৫০ মিলিগ্রাম করে দিনে দু’বার ভীষণ উপকারী।
 

লঘুমালিনি রস

১২৫ মিলিগ্রাম দিনে দু’বার মধু-সহ উপকারী।

আরও পড়ুন:

অজানার সন্ধানে: পাচার হয়েছিল টন টন সোনা ও দামি ধাতু! ৮৫ বছরের সেই ভূতুড়ে রেলস্টেশন এখন অভিজাত হোটেল

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৮: জীবনে উন্নতি করতে হলে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গেই আপনাকে থাকতে হবে

 

পথ্য

কুলথি কলাইয়ের জুস, মুগ ডালের জুস, তিল তেল, মালিশের জন্য সরষে তেল বা পরানো ঘি, বেদানার রস নোটেশাক, দ্রাক্ষা, গরম জল ইত্যাদি।
 

অপথ্য

দিনে ঘুম, পরিশ্রম, যুদ্ধ করা বা কুস্তি করা, উঁচুতে সিঁড়ি বেয়ে ওঠা, মশলাদার খাবার খাওয়া, কড়াপাক খাবার, শীতল খাবার ও পানীয়।

* বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ (Ayurveda) : ডাঃ প্রদ্যোৎ বিকাশ কর মহাপাত্র (Dr. Pradyot Bikash Kar Mahapatra), অধ্যাপক ও চিকিৎসক, ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্রাজুয়েট আয়ুর্বেদিক এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ।

Skip to content