মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


ছবি প্রতীকী।

এই রোগটি অত্য ন্ত ভয়ংকর কষ্টদায়ক অস্থিসন্ধিগত বিকার যা, রোগীকে ক্রমশঃ প্রতিবন্ধী করে তোলে। অস্থি ও সন্ধির আকারকে বিকৃত করে দেয়, জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে এবং চিকিৎসাতে অসফলতা আনে। এই রোগটি আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের রিউমাটয়েড আর্থারাইটিসের সমতুল্য যা এক ধরনের ইমিউনিটি সম্পর্কিত আর্থারাইটিস। ১৬ বছর বয়স থেকে ৬০ বছর বযস্ক মানুষের ক্ষেত্রে দেখা যেতে পারে। সারা ভারতে প্রায় দেড় কোটির বেশি মানুষ এই রোগে ভুগছেন। পুরুষের চেয়ে মেয়েদের ভোগার হার প্রায় তিন গুণ বেশি। আধুনিক বিজ্ঞানে ‘রিউমাটয়েড ফেক্টর পজিটিভ’ বা ‘অ্যান্টি সিসিপি পজিটিভ’ রোগীদের এই রোগের আওতায় আনলে ও আয়ুর্বেদে সেরো পজিটিভ এবং সেরো নেগেটিভ এই দুই ধরনের আর্থারাইটিসের নিদান এবং লক্ষণ গত সাদৃশ্যতা বিচার করে আমবাত রুপে চিহ্নিত করা যেতে পারে।
 

নিদান বা কারণ

আয়ুর্বেদ মতে, শরীরস্থ পাচকাগ্নি এবং ধাত্ব্যাগ্নি (ডাইজেস্টিভ অ্যান্ড মেটাবলিক ফায়ার বা এনজাইমেটিক সিক্রেশন) যখন দুর্বল হয় তখন পরিপাক ও বিপাক ক্রিয়া ব্যাহত হয় এবং তার ফলে অপক্ক অন্নরস বা আম তৈরি হয়। আবার যখন আহার, আচার বা জীবনশৈলীর অসঙ্গতির জন্য শরীরের বায়ু (অর্থাৎ নিউরোমাসকিউলো স্কেলিটাল অ্যান্ড সাইকোলজিক্যাল রিফ্লেক্স) বেড়ে যায় বা প্রকুপিত হয়, তখন ওই প্রকুপিত বায়ু আমরস কে বয়ে নিয়ে এসে সন্ধিস্থানে জমিয়ে দেয়। তার ফলে ফোলা, ব্যথা-সহ প্রদাহ (ইনফ্লামেশন) উৎপন্ন হয়।

এই প্রক্রিয়া ক্রমাগত চলতে থাকলে রোগী আরও দুর্বল হতে থাকে এবং ছোট, মাঝারি এবং কখনও বড় সন্ধিকে প্রদাহান্বিত ও বিকৃত (ডি ফরমড) করে সুতরাং এই রোগের মূল কারণ যখন খাদ্য খাবারের অনিয়ম ও ভুল জীবনশৈলী, অত্যাধিক গুরু, স্নিগ্ধ, শীতল আহার অর্থাৎ পায়েস, দই, ক্ষীর, মাখন, বেশি চর্বিযুক্ত খাওয়ার, সহজপাচ্য নয় এমন গুরুপাক বা কড়াপাক খাওয়ার, তেমনই দিনে ঘুম (যেহেতু দিবা নিদ্রায় কফ বাড়ে ও পাচকাগ্নি দুর্বল হয়), বেশি জল ঘাটা, শীতল বাতাস বা শীতল জলের উপযোগ, রাত জাগা, অত্যধিক সফর করা, অতিরিক্ত ব্যায়াম করা, মল-মূত্রের সাধারণ বেগ ধারণ করা, অত্যধিক ভয় পাওয়া, চিন্তা করা ইত্যাদি একদিকে আমরস তৈরি করে

অন্যদিকে বায়ুও বৃদ্ধি করে, ফলে ওই প্রকুপিত বায়ু আমরসকে বয়ে সন্ধিস্থানে নিয়ে যায় এবং ব্যথা ফোলা-সহ কষ্ট নিয়ে আসে তেমনই বায়ু আমরস দ্বারা নিজে অবরুদ্ধ হয় এবং ওই আম রস স্রোত বা সূক্ষ্ম চ্যানেল গুলোকে আবরিত করে সঠিক বিপাকীয় ক্রিয়া সম্পাদন করতে দেয় না, পোষক দ্রব্য কে সঠিক স্থানে পৌঁছাতে দেয় না,বিপাকে উৎপন্ন মল বা বর্জ্য পদার্থকেও বের করিয়ে দিতে বাধা দেয়। ফলে পরিস্থিতি ক্রমশঃ জটিল থেকে জটিলতর হয়।

আরও পড়ুন:

বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ, আর্থারাইটিসের ব্যথায় দীর্ঘ দিন কষ্ট পাচ্ছেন? স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে ভরসা রাখুন আয়ুর্বেদে

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৭: আপন হতে আপন জন ‘রাইকমল’

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৯: আগে তো প্রাণে বাঁচি, তার পরে না হয় বিমার নিয়ম কানুনের কথা ভাবা যাবে

 

লক্ষণ

অবিপাক (হজম না হওয়া), শরীরে ভারবোধ, দুর্বলতা, হাতের আঙ্গুল, কব্জি সন্ধি, কনুই সন্ধি, কাঁধের সন্ধি, পায়ের অঙ্গুলি সন্ধি, গুলফ সন্ধি (অ্যাঙ্কেল জয়েন্ট) গ্রীবাসন্ধি (সারভাইকাল জয়েন্ট) উরঃসন্ধি (রিব জয়েন্ট), কখনও কখনও বড় বড় সন্ধি যেমন হাঁটুর সন্ধি (নি জয়েন্ট), ত্রিকসন্ধি (হিপ জয়েন্ট) ইত্যাদিতে ফোলা, ব্যথা, আড়ষ্টতা (স্টিফনেস) দেখা যায়। রোগীর কখনও কখনও জ্বর, অস্থিরতা, সারা শরীরে বেদনা, খাওয়ার অনিচ্ছা, অরুচি ইত্যাদি প্রবল ভাবে থাকে। রোগী বহুদিন ভুগতে থাকলে সন্ধিগুলিতে বিকৃতি দেখা যায়। মাংসপেশী শুকিয়ে আসে। ক্রমান্বয়ে শারীরিক ও মানসিক বল তলানিতে ঠেকে রোগী প্রতিবন্ধীতে পর্যবসিত হয়।

আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১০: স্থাপত্য ছাড়িয়ে অভয়ারণ্য

পর্দার আড়ালে, পর্ব-২৮: সপ্তপদী: মূল কাহিনিতে দুই ভিন্ন ধর্মাবলম্বী পুরুষ ও নারীর ভালোবাসার মধ্যে মিলন রাখেননি তারাশঙ্কর

স্বাদে-আহ্লাদে: বিকেল হলেই জমিয়ে প্রেম বা আড্ডা, সঙ্গে যদি থাকে ভেজিটেবিল চপ

 

চিকিৎসা

প্রথমেই রোগের যা কারণ বা নিদান তা পরিবর্জন করতেই হবে, যেমন গুরুপাক খাওয়ার, পায়েস, মাখন, চর্বিযুক্ত খাওয়ার, দই, বড় খাসি বা বড় মুরগির মাংস, বড় মাছ, মশলাদার খাওয়ার, কড়াপাক খাওয়ার, তৈলাক্ত বা অত্যাধিক ভাজাভুজি খাওয়া, দই, শীতল পানীয় ইত্যাদি বর্জনীয়। এসিতে থাকা, রাতজাগা, অধিক পরিশ্রম, অধিক ব্যায়াম, শীতল বায়ু বা শীতল জলের উপযোগ, অসময়ে খাওয়া, অত্যধিক খাওয়া ইত্যাদি ছাড়তে হবে।

পরিপাক শক্তি বাড়ানোর জন্য শুণ্ঠী চূর্ণ (শুকনো আদার চূর্ণ) ২ গ্রাম ২ বার হালকা গরম জলে খাওয়া যেতে পারে। এতে ফোলা ও ব্যথা কমে।

রাস্না: দশ মূল ক্বাথ বা পাচন কিংবা শুন্ঠ্যাদি পাচন ২০ মিলি করে সকাল-সন্ধ্যা টিফিনের আগে সমপরিমাণ গরম জল-সহ খাওয়ানো যায়।

প্রত্যহ যাতে পায়খানা পরিষ্কার হয় এরণ্ড তেল বা ক্যাস্টর অয়েল ৫ থেকে ১০ মিলি সকালে খালি পেটে গরম জল-সহ দেওয়া যায়।

আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের কিছু ঔষধি যেমন বৈশ্বানর চূর্ণ তিন গ্রাম দিনে দু বার গরম জল সহ খাওয়ানো যেতে পারে। সিংহনাদ গুগগুলু বা রাস্না এরণ্ডাদি গুগগুলু ৫০০ মিগ্রা দিনে দু’বার।

বাতগজাঙ্কুশ, বাতগজেন্দ্র সিংহ, হিঙ্গুলেশ্বর রস, রামবান রস, অগ্নিতুণ্ডি বটি, আমবাতারি রস ইত্যাদি ঔষধি ১২৫ মিগ্রা থেকে ২৫০ মিগ্রা দিনে দু’ বার মধু বা গরম জল-সহ দেওয়া যায়।

মালিশ হিসাবে সৈন্ধবাদ্য তৈল ব্যথা ও ফোলার স্থানে হালকা লাগিয়ে গরম বালির পুঁটলি-সহ সেঁক দিনে ২-৩ বার দেওয়া যায়।

অত্যাধিক ফোলা কমানোর জন্য পুনর্নবাদি ক্বাথ ২০ মিলি করে দিনে দু’বার দেওয়া যায়।

সমস্ত চিকিৎসাই রোগীর বল ও রোগের বল বিচার করে দিতে হবে।

যেহেতু এই রোগ অত্যন্ত কষ্টসাধ্য, তাই শোধন চিকিৎসা অর্থাৎ শরীরস্থ মলকে বহিঃ নিঃসরণ (ডিটক্সিফিকেশন) করা হয়। যেমন, স্নেহন, স্বেদন, বিরেচন, ইত্যাদি প্রক্রিয়া আয়ুর্বেদে আছে, যা রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে করানো হয়। বস্তি নামক একটি মলদ্বার দিয়ে ওষধি প্রয়োগ করার প্রক্রিয়া আছে, যেমন নিরুহ বস্তি, ক্ষার বস্তি, বৈতরণ বস্তি ইত্যাদি অত্যন্ত ফলদায়ী।

আরও পড়ুন:

ডায়াবেটিস থাকবে দূরে, জেনে নিন কোন ফল কতটা পরিমাণে খাবেন, আর কোনটা খেতে হবে সাবধানে, দেখুন ভিডিয়ো

প্রসঙ্গ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান, মানসিক চাপ এবং উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভুগছেন? কোন পথে সমাধান? রইল কিছু ঘরোয়া সমাধান

হেলদি ডায়েট: রোজ টক দই খাচ্ছেন? খাওয়ার আগে কোন বিষয়গুলি অবশ্যই মাথায় রাখবেন

 

পথ্য

পুরনো চালের ভাত, গম, মুগ, হিংচে শাক, জিরে, পটল, গুলঞ্চ, গোলমরিচ, আদ্রক, নিসিন্দা, নিম, জিওল মাছ, গরম জল, পরিমাণ মতো বেদানা, পেয়ারা, পেঁপে ইত্যাদি ফল ।
 

অপথ্য

দই, ক্ষীর, পায়েস,তেলে ভাজা, অত্যাধিক তৈলাক্ত ও ঘি যুক্ত খাওয়ার, দুপুরে ঘুম, শীতল উপাচার, বেশি সফর করা, মলমূত্রের বেগ ধারণ করা ।

* বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ (Ayurveda) : ডাঃ প্রদ্যোৎ বিকাশ কর মহাপাত্র (Dr. Pradyot Bikash Kar Mahapatra), অধ্যাপক ও চিকিৎসক, ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্রাজুয়েট আয়ুর্বেদিক এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ।

Skip to content