শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

মুখে লালচে, কালো, বাদামি, ফিকে ধূসর রঙের ছোপ ছোপ দাগ খুবই সৌন্দর্য্যহানিকর একটি সমস্যা। এর থেকে মনে একটা বিষণ্ণতা স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যা ম্যালাসমা, লেনটিগিনস, ট্যান পড়া, বার্ন হওয়া ইত্যাদি।এই সমস্যাগুলি ভয়ংকর বা জীবনদায়ী ব্যাপার না হলেও যথেষ্ট ভাবে স্বাভাবিক জীবনযাপনকে প্রভাবিত করে। বিশেষ করে ১৬ থেকে ৫০ বছর বয়স্কা নারীদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।

মুখে বিশেষ করে কপালে, গালে, নাকে, থুতনিতে যখন বাদামি বা ধূসরাভ ছোপ ছোপ দাগ হয়, তখন তাকে বলা হয় ম্যালাসমা। আয়ুর্বেদ মতে, এটি একটি ক্ষুদ্র রোগ, যা ব্যঙ্গ নামেই পরিচিত। লেনটিগিনস আবার কালো কালো ধূসর বাদামি রঙের স্পট, যা প্রায়শ গোলাকার কালচে দাগ, মুখ প্রদেশ ছাড়াও শরীরের যে কোন স্থানে দেখা যেতে পারে। এই সমস্যাকে আয়ুর্বেদের নীলিকা রোগের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।
সারা পৃথিবী জুড়ে এই ম্যালাসমা ও লেনটিগিনসের মতো পিগমেন্টারি সমস্যা এক থেকে চল্লিশ শতাংশ লোকের মধ্যে দেখা যেতে পারে। অনেকটা ভৌগোলিক বা পরিবেশগত কারণ, বয়সগত কারণ ইত্যাদি দ্বারাও প্রভাবিত। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলিতে এই সমস্যায় প্রায় শতকরা ৪০ জন নারী-পুরুষ ভুগে থাকে। এর মধ্যে যুবতী বা মধ্যবয়স্কা মহিলারা বেশি ভোগে।

এ বার দেখা যাক আয়ুর্বেদ এই সমস্যার কারণ বা প্রতিকার নিয়ে কী ভেবেছে? আয়ুর্বেদ মতে, অত্যধিক ক্রোধ বা পরিশ্রমের জন্য বায়ু ও পিত্ত দোষ প্রকুপিত হয় ও একে অপরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে মুখ প্রদেশে বেদনাহীন ছোপ ছোপ দাগ প্রকাশ করে। একে ব্যঙ্গ বলা হয়। এই ব্যঙ্গ হঠাৎ করেও হতে পারে। ফিকে লালচে বাদামি ছোপই এর পরিচয় জানান দেয়।
আরও পড়ুন:

কৃশতা রোগে হাড় জিরজিরে শীর্ণ অবস্থা? জানুন এর আয়ুর্বেদীয় প্রতিকার

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৭: তোমায় পড়েছে মনে আবারও…

নীলিকা রোগে ব্যঙ্গ রোগের মতোই লক্ষণ দেখা যায়, কিন্তু স্পটগুলি মূলত কালো রংয়ের ও গোলাকার হয়। সেই সঙ্গে যে কোনও জায়গায় এই কালোও ছোপ দেখা যেতে পারে। ব্যঙ্গ রোগে আবহাওয়া, রৌদ্রতাপ,মানসিক চাপ, চিন্তা, শোক, রাগ, উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের রোগ, লিভার বা যকৃতের সমস্যা, পেটের রোগ, হরমোনের সমস্যা প্রভাব ফেলে, নীলিকা রোগ আবার কোনও কোনও সময় অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন রোগের উপদ্রব হিসাবে আসতে পারে।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৭: নাক বন্ধ হলেই নাকের ড্রপ? এতে শরীরে কোনও ক্ষতি হচ্ছে না তো?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১১: মাতৃরূপে প্রথম পুজোগ্রহণ

 

ব্যঙ্গ বা মুখের ছোপ দাগের কতিপয় নিদান

অত্যধিক ক্রোধ, চিন্তা, শোক, পরিশ্রম, রোদে ঘোরাঘুরি, রাত জাগা, ঝাল-টক-তেতো ইত্যাদি খাবার বেশি খাওয়া, মশলাদার কড়াপাক খাবার, যৌবনকালের প্রভাব, ঋতু বন্ধের আগের বা পরের অবস্থা (প্রি-মেনোপজাল বা মেনোপজাল কাল), বিভিন্ন ধরনের কুপ্রভাবকারী ওষুধের প্রয়োগ।
 

রোগ উৎপত্তির ক্রম বা সম্প্রাপ্তি

যেহেতু উপরের কারণ গুলির দ্বারা বায়ু ও পিত্ত উভয়েই প্রকুপিত হয় ও মিলিত হয়ে ত্বকে বিশেষ করে মুখ প্রদেশের ত্বকে ব্যঙ্গ এবং সর্ব শরীরের ত্বকে নীলিকা নামের ছোপ ছোপ দাগকে নিয়ে আসে, উভয় সমস্যা অর্থাৎ ব্যঙ্গ বা ম্যালাসমা এবং নীলিকা বা লেনটিগিনসের চিকিৎসা একই রকম।

আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৭৩: সব জলাধারকে মাছ চাষের আওতায় আনলে মাছের ফলন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো সম্ভব

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৫: ‘আপনজন’ Chronicles

 

চিকিৎসা সিদ্ধান্ত

প্রথমেই অন্যান্য রোগের মতো নিদান বা কারণ গুলিকে বাদ দেওয়া উচিত।
শরীরের ভিতরের দোষকে বাইরে বের করার জন্য শোধন কর্ম করতে হবে। শিরাব্যাধ করে রক্তমোক্ষণ করা যায়, প্রলেপ, সঙ্গে হালকা ম্যাসাজ বা অভ্যঙ্গ দেওয়া যায়।
 

প্রলেপ

 

বিভিন্ন রকমের প্রলেপ

যেমন মসুর ডাল বাটা, কাঁচা হলুদ বাটা, বটের কচি ডগা ও মসুর ডাল একসঙ্গে বেটে মুখে প্রলেপ দেওয়া, যষ্টিমধু ও মঞ্জিষ্ট্যা চূর্ণ মধুর সঙ্গে মিশিয়ে প্রলেপ, রক্তচন্দন বাটা ও লোধ চূর্ণ একসঙ্গে মিশিয়ে প্রলেপ, জায়ফল গুঁড়ো করে তিল বাটা মিশিয়ে প্রলেপ।
 

তেল

কুম্কুমাদি তৈল, কিংশুকাদি তৈল, শোরকাদি তৈল। লাগানো যাবে দিনে ৩ বার
 

ঘৃত

কুম্কুমাদি ঘৃত, বর্ণকঘৃত লাগানো যায় তেলের মত।
 

শমন ঔষধ বা খাবার ঔষধ

 

গুগ্গুলু

কৈশোর গুগ্গুলু, ত্রিফলা গুগ্গুলু যে কোনও একটি ৫০০ মিলিগ্রাম দু’ বার দেওয়া যায়।
 

চূর্ণ

পঞ্চনিম্বাদি চূর্ণ, হরিদ্রাখণ্ড যে কোনও একটি ১ থেকে ২ গ্রাম দেওয়া যায়।
 

রসৌষধি

নবায়স লৌহ ২৫০ মিলিগ্রাম থেকে ৫০০ মিলিগ্রাম দিনে দু’ বার দেওয়া যায়।
 

রস মাণিক্য

১২৫ মিলিগ্রাম দিনে দু’ বার মধু-সহ দেওয়া যায়।
 

ভস্ম

প্রবালভস্ম, শঙ্খ ভস্ম ২৫০ মিলিগ্রাম দিনে দু’বার দেওয়া যায়।
 

ক্বাথ

মহামঞ্জিষ্ঠাদি ক্বাথ ২০ মিলিলিটার দু’বার দেওয়া যায়।
 

বটি

আরোগ্যবর্ধনী বটি ২৫০ মিলিগ্রাম দিনে দু’ বার দেওয়া যায়
 

আসব বা অরিষ্ট

কুমার্য্যাসব, রোহিতকারিষ্ট, মঞ্জিষ্ট্যাদ্যারিষ্ট, সারিবাদ্যারিষ্ট ইত্যাদির মধ্যে যে কোনও একটি ২০ মিলি করে দিনে দু’বার খাওয়া যায়।

আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-৬: বৈতরণীর পারে…

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৪: সুন্দরবনের মৎস্যদেবতা মাকাল

 

পথ্য

পটল, নিম, তেলাকুচা, রক্তচন্দন, যষ্টিমধু, আমলকী, ডাবের জল, শাঁখের গুঁড়ো, আখের রস, বিশ্রাম, সুনিদ্রা।
 

অপথ্য

অত্যধিক পরিশ্রম, রোদে ঘোরা, বেশি রাগ, ক্ষোভ, শোক, চিন্তা, রাতজাগা, কড়াপাক খাবার, ক্ষতিকর ওষুধ খাওয়া, মলমূত্রের স্বাভাবিক বেগ ধারণ করা।

* বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ (Ayurveda) : ডাঃ প্রদ্যোৎ বিকাশ কর মহাপাত্র (Dr. Pradyot Bikash Kar Mahapatra), অধ্যাপক ও চিকিৎসক, ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্রাজুয়েট আয়ুর্বেদিক এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ।

Skip to content