শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

বারবার পাতলা পায়খানা হলে আমরা তাকে আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষায় ডায়েরিয়া বলে থাকি। এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সমস্যা। সারা ভারতে প্রায় শতকরা ১৫ জন পূর্ণ বয়স্ক মানুষ এই ডায়ারিয়ায় আক্রান্ত হন, যার মধ্যে প্রায় শতকরা ১৭ জন গ্রামীণ মানুষ এবং ৯ জন শহরবাসী। সারা পৃথিবীতে প্রায় প্রতিদিন ২২০০ জন ৫ বছরের কম বয়সী শিশু এই ডায়েরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। তাই বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এবং বিশ্বের প্রায় সব দেশের সরকার এই ডায়েরিয়া নামক ভয়ংকর স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে মানুষকে রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর। নানান ধরনের ডায়েরিয়ার নাম আমরা শুনে থাকি, যেমন: অ্যাকিউট ডায়েরিয়া, ক্রনিক ডায়েরিয়া, সামার ডায়েরিয়া, ট্রাভেলার্স ডায়েরিয়া, ইনফ্যান্টাইল ডায়েরিয়া, ব্যাকটেরিয়াল ডায়েরিয়া, ভাইরাল ডায়েরিয়া, ইমোশনাল ডায়েরিয়া ইত্যাদি। এথেকে বোঝা যায় ডায়েরিয়ার অবস্থানগত প্রকৃতি এবং উদ্ভবগত কারন অনুযায়ী আধুনিক বিজ্ঞান এই নাম করন নির্দিষ্ট করেছে। আয়ুর্বেদশাস্ত্রের অতিসার নামক রোগটি ডায়েরিয়ার সঙ্গে একদম সামঞ্জস্যপূর্ণ। অতিসার কথাটির অর্থই হল, অতিসরণ হওয়া। অর্থাৎ মলদ্বার থেকে যদি বারবার অনেক পরিমাণ দ্রব মলের সরণ ঘটে বা বার বার পাতলা পায়খানা হয়, তখন তাকে অতিসার বলা হয়।
 

ডায়েরিয়া বা অতিসারের নিদান বা কারণ কী?

অনেক পরিমাণ বা স্বভাবত গুরুপাক যেমন পায়েস, পিঠে, ক্ষীর ইত্যাদি খাওয়া অতি স্নিগ্ধ বা শীতল দ্রব্য খাওয়া, অধিক জলীয় পদার্থ পান, জীর্ণ না হওয়া সত্বেও খাওয়া, সময় না মেনে যখন তখন খাওয়া, অসাত্ম্য খাবার খাওয়া (যে খাদ্য নিজের স্বভাবের পক্ষে ভালো নয়, বা রীতিবিরুদ্ধ যেমন মাছ-মাংসের সঙ্গে দই বা পায়েস ইত্যাদি) ঠিকমতো সিদ্ধ না হওয়া খাবার খাওয়া, দূষিত জল পান, পচা, বাসি খাবার, কৃমির সংক্রমণ, মলমূত্রের স্বাভাবিক বেগ চেপে থাকা, মদ্যপান, কড়া পাক বা মশলাদার খাবার খাওয়া, বেশি সফর করা, নানা রকমের ক্ষতিকর ঔষধি নেওয়া, অতিচিন্তা, ভয়, শোক-ত্রাস, ঋতু বিপর্য্যয় ইত্যাদি কারণ থেকে পেটের পাচকাগ্নি দুর্বল হয় এবং অগ্নিমান্দ্য ঘটে। তার থেকে অপক্ক অন্নরস বা আম দোষ উৎপন্ন হয়। সেই আম ক্ষুদ্রান্ত্র তথা বৃহদন্ত্র কে ক্ষোভিত করে ও বায়ুর প্রকোপ ঘটায়, সেই সঙ্গে অন্নবহ স্রোতের সঙ্গে পুরিষবহ ও উদকবহ স্রোতকে দূষিত করে। তাই বারবার মলত্যাগ বা অতিসার নামক রোগকে নিয়ে আসে।

আরও পড়ুন:

দীর্ঘদিন অম্লপিত্তের সমস্যায় ভুগছেন? আয়ুর্বেদে রয়েছে সহজ প্রতিকার

হাত বাড়ালেই বনৌষধি: ‘লঙ্কা কাণ্ড’

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬২: প্রথম রবীন্দ্রজীব

 

অতিসার রোগের প্রকারভেদ

আয়ুর্বেদে বিভিন্ন শাস্ত্রকার বিভিন্ন রকমের প্রকারভেদের উল্লেখ করেছেন। তবে বাতজ অতিসার, পিতজ অতিসার, কফজ অতিসার ও সান্নিপাতিক অতিসার এই চার প্রকার অতিসার সবাই স্বীকার করলেও কেউ কেউ ভয়জ অতিমার, আমজ অতিসার ও শোকজ অতিসারকেও প্রকারভেদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
 

অতিসার রোগের সাধারণ লক্ষণ

নানান বর্ণের মল বারবার নির্গত হওয়া কখনও ফেনাযুক্ত বা কখনও ফেনা ছাড়া পাতলা মল বারবার নির্গমন, পেটে ব্যথা, পেটে জ্বালা, পায়খানা রাস্তায় ব্যথা, অত্যধিক জল তেষ্টা পাওয়া, সারা দেহে ব্যথা বা জ্বালা, শরীরের ভার বোধ, আলস্য, পেট ফাঁপা, পেটে ভারী বোধ, কখনও কখনও পায়খানার সঙ্গে রক্ত পড়া, উৎসাহহানী, দুর্বলতা, মূর্ছা, জ্বর, বমি বমি ভাব, কখনও বমি ইত্যাদি দেখা যায়।

রোগের নিদান জেনে কোন্ প্রকারের অতিসার তা নিশ্চিত করতে হয়। কখনও কখনও রোগের লক্ষণ দেখে বায়ু, পিত্ত ও কফ-এর মধ্যে কোন দোষের আধিক্য তা বিচার করে রোগ নির্ণয় করা হয়। তার পরে সেই মতো চিকিৎসা দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন:

ভানুসিংহের পদাবলীর ভাষা এবং বিষয় মাহাত্ম্য

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯: কৌরবদের জন্ম এবং কুরুপাণ্ডবদের ছেলেবেলার শত্রুতা

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৪: স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের ‘রাত-ভোর’

 

চিকিৎসা

চিকিৎসা করতে হলে মূলতঃ আমাতিসার না পক্বাতিসার তার বিবেচনা করা দরকার। যদি অজীর্ণের কারণে আম সঞ্চিত হয় এবং আম সংযুক্ত মল উপরিউক্ত লক্ষণগুলির সঙ্গে বারবার মলদ্বার থেকে নির্গত হয়, সেক্ষেত্রে আমকে পাক করা সর্বাগ্রে প্রয়োজন।

নিদান বা রোগের কারণকে যেমন প্রথমেই পরিবর্জন করা হবে, সঙ্গে সঙ্গে জঠরাগ্নি কে উদ্দীপিত করে আমকে পাক করতে হবে। অতিসারের আমাবস্থায় রোগী যদি দুর্বল না হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে রোগীকে কোনও খাদ্য খেতে না দিয়ে লঙ্ঘন করানো হয়। রোগী দুর্বল হলে শরীরস্হ জলীয় ভাগ কমে গেলে (ডিহাইড্রেশন) ষড়ঙ্গ পানীয় অর্থাৎ মুথা, সুগন্ধ বালা, রক্ত চন্দন, ক্ষেত্ পাঁপড়া, বেনামূল, ধনে এই ছয় রকমের জিনিস নিয়ে সমমাত্রায় মোট ১৮ গ্রামকে এক লিটার জলে ফুটিয়ে ২৫০ মিলিলিটার থাকতে নামিয়ে সেই জল বারবার খাওয়ানো যায়।
 

দীপন ও পাচন করার জন্য

ত্রুষনাদ্য চূর্ণ, শুণ্ঠ্যাদি চূর্ণ, লবণ ভাস্কর চূর্ণ ইত্যাদি তিন গ্রাম করে দিনে দুবার দুপুরে-রাতে খাওয়ার পর গরম জল-সহ দেওয়া যায়।
 

বটি হিসাবে

চিত্রকাদি বটি, সঞ্জীবনী বটি, শঙ্খবটি ইত্যাদি দুটো করে দুবার দুপুরে-রাতে খাওয়ার পর দেওয়া যায়।

আম বা পক্ষ যেকোনও অতিসারে যদি রোগী বেশি দুর্বল হয়, তাহলে উপরোক্ত ওষুধগুলির সঙ্গে কুটজ ঘনবটি, লবঙ্গাদি বটি দুটো করে দুবার দেওয়া যায়।

 

রসৌষধির মধ্যে

রামবান রস, ভুবনেশ্বর রস, কর্পূর রস ইত্যাদি ২৫০ থেকে ৫০০ মিলিগ্রাম দিনে দুবার দেওয়া যায়।
 

পাচন হিসাবে

নাগরাদি ক্বাথ, ধন্য পঞ্চক ক্বাথ ইত্যাদি কুড়ি মিলিলিটার দিনে দুবার দেওয়া যায়।
 

দীর্ঘ মেয়াদী অতিসার চলতে থাকলে

অরিষ্ট হিসাবে মুস্তকারিষ্ট, কুটজারিষ্ট ইত্যাদি কুড়ি মিলিলিটার দিনে দুবার সমপরিমাণ জল-সহ খাওয়ার পর দেওয়া যায়।

আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১০: কিশোর কণ্ঠের উপর যেন এক অলিখিত দাবি ছিল পঞ্চমের

গল্প: ফিরে পাওয়া পঁচিশ

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১২: ঘাম কমাতে পাউডার ব্যবহার করেন?

 

পথ্য

পুরানো চালের সুসিদ্ধ ভাত, খইয়ের মণ্ড, মসুর, অড়হর বা মুগ ডাল সেদ্ধ জল, জাম, মধু, কচি বেলের শুট, শুকনো আদার গুঁড়ো, জিরে, ধনে, ঘোল, ছাগলের দুগ্ধ, পটল ইত্যাদি।
 

অপথ্য

মটর ডাল, উড়দ ডাল, আখের রস, শসা, কড়া পাক বা গুরুপাক খাবার, মদ, দই, কচুরি, শিঙাড়া ইত্যাদি।

* বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ (Ayurveda) : ডাঃ প্রদ্যোৎ বিকাশ কর মহাপাত্র (Dr. Pradyot Bikash Kar Mahapatra), অধ্যাপক ও চিকিৎসক, ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্রাজুয়েট আয়ুর্বেদিক এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ।

Skip to content