মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


ছবি প্রতীকী।

রক্তাল্পতা (রক্তহীনতা) বা অ্যানিমিয়া সারা পৃথিবী জুড়ে এক গভীর গণস্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যা। ভারতে এই সমস্যা অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত চলে আসা এক অস্বস্তিকর বিড়ম্বনা। প্রায় প্রতি ১০ জন গ্রামীণ মানুষের মধ্যে তিনজন এবং প্রতি ৫ জন শহরবাসী মানুষের মধ্যে একজন এই রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়ার শিকার। পৃথিবীতে শিশু ও সন্তানসম্ভবা মা সবচেয়ে বেশি এই রোগে পর্য্যুদস্ত। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু প্রায় শতকরা ৪২ জন এবং সন্তানসম্ভবা মা প্রায় শতকরা ৪০ জন এর কু-প্রভাবের অংশীদার। এহেন সমস্যায় আমাদের প্রাচীন চিকিৎসা শাস্ত্র আয়ুর্বেদ কী বিধান দিয়েছে দেখে নেওয়া যাক।

রক্তাল্পতা বা রক্তহীনতা এই সমস্যা আয়ুর্বেদে পান্ডু রোগ নামে অভিহিত। যেহেতু রক্ত কম থাকায় শরীরের ত্বক ফ্যাকাসে বা পেলর হয়ে যায় যা, শ্বেত- পীত বর্ণ ধারণ করে এবং সংস্কৃত শব্দে যাকে পান্ডুবর্ণ বলা হয়। পৌরাণিক ভাবনায় মহাভারতে দেখা যায়, মহারাজ পান্ডু’র এই রক্তাল্পতা রোগ ছিল এবং সেই কারণে তাঁর অকাল মৃত্যু ও হয়েছিল। তাই তার নাম অনুসারে এই রোগের নাম পান্ডু রোগ।

আধুনিক বিজ্ঞানে দেহে প্রবাহিত রক্তে যদি লাল রঞ্জক কণা বা হিমোগ্লোবিন ও লোহিত রক্তকণিকা বা রেড ব্লাড কর্পাসলস পরিমাণগত বা গুণগত মানে কমে যায়, তাহলে সেই অবস্থাতে ত্বক ও মুখগর্ভস্থ বা অন্যান্য স্থানের শ্লৈস্মিক ঝিল্লির বর্ণ ফ্যাকাসে বা শ্বেত-পীত হয়ে যায়। সেই অবস্থাকে অ্যানিমিয়া বলে, যা আয়ুর্বেদের পান্ডু রোগের সমতুল্য।
 

রোগের কারণ বা নিদান

অত্যধিক রক্তপাত বা রক্তক্ষরণ (হেমারেজ) রক্তের কণিকাগুলির ভঙ্গুরতা (হিমোলাইসিস) লৌহঘটিত পদার্থ কমে যাওয়া (আয়রনের ঘাটতি), অপোষন (ম্যাল নিউট্রিশন) ভিটামিন ও ফলিক অ্যাসিডের অভাব, প্রোটিনের অভাব, ব্লাড ক্যানসার, অস্থিমজ্জার কার্যক্রমে অস্বাভাবিকতা এবং বংশগত কারণ গুলি মূলত দায়ী হলেও আয়ুর্বেদে ভুল খাদ্য খাবার ও ভুল জীবনশৈলীকে বিশেষ করে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যেমন অত্যধিক টক, লবণ ও ক্ষারযুক্ত খাদ্য বা পানীয়, অতি উষ্ণ খাবার,রীতি বিরুদ্ধ আহার, যেমন: দইয়ের সঙ্গে মাছ-মাংস, পায়েসের সঙ্গে খিচুড়ি ইত্যাদি, অস্বাস্থ্যকর খাবার যেমন তেলে ভাজা, মশলাদার খাবার, মদ্য, কড়াপাক খাবার, তৈলাক্ত খাবারের পর জলপান, মাটি বা ছাই খাওয়ার বদ অভ্যাস, অত্যধিক ব্যায়াম, দুপুরে ঘুম, অতি রতিক্রিয়া, মল ও মূত্রের স্বাভাবিক বেগ ক্রমাগত চেপে যাওয়া, অত্যধিক ভয়, চিন্তা, শোক ও রাগ ইত্যাদি কারণে বায়ু, পিত্ত ও কফ এই তিন দোষ প্রকুপিত হয় এবং বিশেষ করে পিত্ত দোষ বেড়ে গিয়ে ত্বক ও মাংসের মধ্যে আশ্রয় নেয়। সেই সঙ্গে রক্ত, মাংস ইত্যাদি ধাতুকে দূষিত করে ত্বকের বর্ণ পান্ডুর বা পেলর করে দেয়।

আরও পড়ুন:

আধুনিক আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় সায়াটিকার অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব

হাত বাড়ালেই বনৌষধি: সারা বছরের বন্ধু ‘কলা’

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৩: সারাদিন যত পারেন জল খান! এতে শরীরের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে না তো? কী করে বুঝবেন?

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪: অপবাদ এবং রামচন্দ্রের সুশাসনের রামরাজত্ব

 

রোগ প্রকাশের আগের লক্ষণ বা পূর্ব রূপ

হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া (প্যালপিটেশন), ত্বক রুক্ষ হওয়া (ড্রাইনেস অফ স্কিন), ঘাম কম হওয়া, দুর্বল ভাব, ক্লান্তি, মুখে বেশি থুথু আসা, অবসাদ, চোখে ফোলা ভাব, হালকা হলুদ আভাযুক্ত মলমূত্র ত্যাগ, অজীর্ণ বা খাবার হজম না হওয়া ইত্যাদি।
 

রোগের প্রকার ও লক্ষণ

আয়ুর্বেদে মূলতঃ ৫ প্রকার পান্ডু রোগের কথা বলা হয়েছে। বাতজ, পিত্তজ, কফজ, সান্নিপাতজ ও মৃৎ ভক্ষণনজ। দোষের বাহুল্য অনুযায়ী যেমন রোগা ভেদের নির্দেশ করা হয়েছে, তেমনই মাটি বা ছাই খাওয়ার বদ-অভ্যাস থেকেও এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা কে এই প্রকার ভেদের সঙ্গে সূচিত করা হয়েছে। সাধারণ ভাবে যে লক্ষণগুলি প্রকাশ পায় তা হল ত্বকের বর্ণ শ্বেত-পিত বা ফ্যাকাসে হয়ে যায়, শরীরের ত্বকের চকচকে ভাব বা প্রভা নষ্ট হওয়া, ইন্দ্রিয়গুলি শিথিল হওয়া, কানে অদ্ভুত শব্দ হওয়া, অতি দুর্বল ভাব, খাদ্যে রুচি না হওয়া, খিদে না পাওয়া, অত্যন্ত অবসন্নতা, মাথা ঘোরা, কখনও কখনও জ্বর, হাঁফ ধরা, চোখের কোণায় ফোলা ভাব, চুল পাতলা ও শীর্ণ হওয়া, শীতল দ্রব্যের প্রতি অনিচ্ছা, প্রচুর থুতু মুখ দিয়ে তোলা, কথা বলতে অনিচ্ছা, বুক ধড়ফড় করা, গা হাত পায়ে ব্যথা ইত্যাদি।

আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৫: আরডি-র ‘লাকড়ি কি কাঠি কাঠি পে ঘোড়া’ আজও ছোটদের মধ্যে সমানভাবে জনপ্রিয়

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৯: সুরের আকাশে ঘটালে তুমি স্বপ্নের ‘শাপমোচন’

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৩: বাইগা বস্তি হয়ে ভোরামদেব মন্দির

স্বাদে-গন্ধে: সামনেই জন্মদিন? বিশেষ দিনের ভূরিভোজে বানিয়ে ফেলুন কাশ্মীরি পদ মটন রোগান জোস!

 

চিকিৎসা

আয়ুর্বেদের সাধারণ চিকিৎসা ই হল, নিদান বা রোগের কারণ গুলি বাদ রাখা। সুতরাং আগে বলা নিদান গুলিকে সম্পূর্ণ বর্জন করতে হবে। বাতজ পান্ডুতে স্নেহন, পিত্তজ পান্ডুতে তিক্ত রসযুক্ত উষ্ণ বীর্য ঔষধি, কফজ পান্ডুতে কটু (ঝাল), তিক্ত রসযুক্ত উষ্ণ বীর্য ঔষধি এবং সান্নিপাতিক বা ত্রিদোষজ পান্ডুতে এই প্রক্রিয়া গুলির মিশ্র চিকিৎসা করতে হবে।
 

সাধারণ ঔষধ চূর্ণ হিসেবে

আমলকি চূর্ণ, ত্রিফলা চূর্ণ, হরিতকি চূর্ণ, দুই থেকে চার গ্রাম পর্যন্ত দিনে একবার বা দু’ বার দেওয়া যাবে।
 

ক্বাথ বা পাচন হিসাবে

ফলত্রিকাদি পাচন বা পুনর্নবাস্টক পাচন ১৫ মিলি লিটার করে দিনে দু’ বার সমপরিমাণ জল-সহ দেওয়া যাবে।
 

আসব বা অরিষ্ঠ হিসেবে

রোহিতকারিষ্ট কুমারী আসব, দ্রাক্ষাসব, লোহাসব, বিড়ঙ্গারিষ্ট ইত্যাদি ১৫ মিলিলিটার করে দিনে দু’ বার খাবার পর সমপরিমাণে জল-সহ দেওয়া যায়।
 

লৌহ প্রয়োগ

বহুল ব্যবহৃত লৌহভস্ম যুক্ত ঔষধি, যেমন নবায়স লৌহ, বিড়ঙ্গাদি লৌহ, ত্রষনাদ্য লৌহ, ধাত্রী লৌহ ইত্যাদি ২৫০ থেকে ৫০০ মিলিগ্রাম দিনে দু’বার মধু বা উষ্ণ জল-সহ দেওয়া যায়।
 

ঘৃতযুক্ত ঔষধি

মহাতিক্ত ঘৃত, রোহিতক ঘৃত, কল্যাণক ঘৃত, ত্রিফলাঘৃত ইত্যাদি ৫ থেকে ১০ মিলি লিটার প্রত্যহ খেতে দেওয়া যেতে পারে।

উপরিউক্ত ঔষধিগুলি ছাড়াও আয়ুর্বেদে সংশোধন বা ডিটক্সিফিকেশন প্রক্রিয়া হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে করানো হয়।

আরও পড়ুন:

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১১: ফুটবলের ব্ল্যাক প্যান্থার: লেভ ইয়াসিন

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৭: কবির লেখা, লেখার গল্প

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৯: মিশ্র মাছচাষ পদ্ধতিতে শুধু ফলন বাড়েনি, মাছের বৈচিত্রের সমাহারও নজর কেড়েছে

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১১: কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দু’ একটি ছবি তুলতে না তুলতেই হাত অসাড় হয়ে যাচ্ছিল

 

পথ্য

শালী ধানের চাল, পুরনো ঢেঁকি ছাটা চাল, মুগ, মসুর, কুমড়ো, পটল, আমলকি, হলুদ, শুকনো আদা, পালংশাক, লালশাক, বিট, গাজর, কাঁচকলা, আপেল, সবেদা, খেজুর, বেদানা, পেয়ারা, জিওল মাছ, সিঙ্গি, মাগুর, কই, চ্যাং, পাঁকাল মাছ, বান মাছ, মাংস রস ইত্যাদি।
 

অপথ্য

মাসকলাই, তিল, পানপাতা, সরষে, মদ, বেশি নুন-ঝাল, গরম খাবার, বেশি জলপান, বেশি রোদে ঘোরা, অত্যধিক স্ত্রীসঙ্গ, ধূমপান, দুপুরে ঘুম, রাতজাগা, অত্যধিক ব্যায়াম, মল মুত্রের বেগ ধারন, চিন্তা, শোক, ভয় ইত্যাদি।

* বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ (Ayurveda) : ডাঃ প্রদ্যোৎ বিকাশ কর মহাপাত্র (Dr. Pradyot Bikash Kar Mahapatra), অধ্যাপক ও চিকিৎসক, ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্রাজুয়েট আয়ুর্বেদিক এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ।

Skip to content