বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

পেটে জল জমে গিয়ে যে ভয়ংকর প্রাণঘাতী উদরি বা অ্যাসাইটিস রোগ হয় তার বহুল সফল চিকিৎসা আয়ুর্বেদজ্ঞরা যুগ যুগ ধরে করে এসেছেন। অথচ আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে তেমন কোন সফল চিকিৎসা পরিলক্ষিত হয় না। আধুনিক বিজ্ঞানের এই অ্যাসাইটিস রোগের কারণ হিসাবে হার্টের রোগ, যেমন কনজেস্টিভ পেরিকার্ডাইটিস, কনজেস্টিভ কার্ডিয়াক ফেলিওর, যকৃতগত বিকার যেমন হেপাটিক সিরোসিস, পোর্টাল হাইপারটেনশন, বৃক্কগত রোগ যেমন নেফ্রোটিক সিনড্রোম, পোষক তত্বের অভাবজনিত রোগ, যেমন হাইপোপ্রোটিনিমিয়া, রক্তাল্পতার জন্য অ্যানিমিয়া, সংক্রমণের জন্য যেমন টিউবারকুলার পেরিটোনাইটিস, টিউমার রোগ যেমন পেরিটোনিয়াল নিওপ্লাজম ইত্যাদিকে চিহ্নিত করেছে। এই কারণগুলির বেশির ভাগই হল দুশ্চিকিৎস্য। তাই স্বাভাবিকভাবে অ্যাসাইটিস রোগটি মারাত্মক।

২০১৭ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, প্রায় এক লক্ষ অ্যাসাইটিস রোগের মধ্যে ৬০ হাজার জনের অ্যাসাইটিসের কারণই হল সিরোসিস অব লিভার। এই সময়ে সারা পৃথিবীর জনসংখ্যার নিরিখে প্রায় প্রতি ১ লক্ষ মানুষের মধ্যে ১৪০০ মানুষ লিভারের সিরোসিস রোগে আক্রান্ত। অত্যন্ত আতঙ্কিত হওয়ার বিষয় হল যে, যত মানুষ লিভারের সিরোসিসে আক্রান্ত হন তার প্রায় ৩৩ শতাংশের কারণই হল মদ্যপান। এদের মধ্যে স্বভাবতই মহিলাদের চাইতে পুরুষের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। দেখা যাক্ আয়ুর্বেদ শাস্ত্র এই উদরি বা অ্যাসাইটিস রোগকে কীভাবে ব্যাখ্যা করেছে এবং তার যথাযোগ্য প্রতিকারের বিধানই বা কি দিয়েছে?
 

প্রকারভেদ

আয়ুর্বেদশাস্ত্র উদর প্রদেশের বা পেটের অস্বাভাবিক ফোলা ভাবকে উদর রোগ বলে আখ্যায়িত করে, তার কতগুলো প্রকারভেদকে উল্লেখ করেছে। যেমন—
● বাতোদর: অনেকটা অস্বাভাবিক রকম পেট ফেঁপে যাওয়ার সমতুল্য।
● পিত্তোদর: অনেকটা যকৃত ও পিত্তথলির পিত্ত বহনকারী নালীর বিকার থেকে উৎপন্ন হয়।
● কফোদর: পেটের জল জমার কারণ হিসেবে বৃক্কগত রোগ দায়ী হয়, তারই সমতুল্য লক্ষণ থাকে।
● সান্নিপাতিক উদর: যে ক্ষেত্রে পোর্টাল সিরোসিসের মতো লক্ষণ দেখা যায়।
● প্লীহোদর: যেখানে যকৃত ও প্লীহা বৃদ্ধি জনিত পেট ফুলে ওঠার লক্ষণ পাওয়া যায়।
● বদ্ধোদর: যেখানে ক্ষুদ্রান্ত বা বৃহদন্ত্রে অবরোধ জন্য পেট ফুলে ওঠার লক্ষণ প্রকাশ পায়।
● ক্ষতোদর: যেখানে অন্ত্রে কোনও কারণে রাপচার বা ক্ষত হয়ে যায় এবং অন্ত্রের ভিতরের অংশগুলি বাইরে বেরিয়ে এসে পেটকে ফুলিয়ে দেয়।
● জলোদর: যা উদর প্রদেশের ত্বক ও মাংসের অন্তর্বর্তী স্থানে জলকে জমিয়ে পেটকে ভয়ংকর ভাবে ফুলিয়ে দেয়।

শাস্ত্রে পরিষ্কার ভাবে বলা হয়েছে যে, যদি প্রথম সাত রকম উদর রোগ ঠিকমতো চিকিৎসা না করা হয় তাহলে এই কষ্টসাধ্য বা অসাধ্য জলোদর রোগ দেখা দেবে।

আরও পড়ুন:

বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ: বার বার মূত্রত্যাগের বেগ, কিন্তু প্রস্রাব আটকে যায়? আয়ুর্বেদে রয়েছে সফল চিকিৎসা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৬: মাছের তেল হার্ট অ্যাটাক আটকায়?

 

রোগের নিদান বা কারণ

মূল কারণ হিসেবে মন্দাগ্নি বা হজমকারক তথা বিপাকীয় অগ্নির ক্ষীণ অবস্থা অর্থাৎ যাঁদের দেহের তেজভাব বা আগ্নেয় ভাব একদম কম থাকে, পরিপাক বা বিপাক করার মতো উৎসেচক রস কম জন্মায়, যাঁরা অজীর্ণ রোগে ভোগেন, পচা অস্বাস্থ্যকর খাদ্য যাঁরা খান, যাঁদের পায়খানা পরিষ্কার হয় না, ক্রমশ পেটে জমে থাকে, অত্যন্ত উষ্ণ লবণাক্ত ক্ষারীয় খাদ্য বা পানীয় খেতে অভ্যস্ত, মশলাদার কড়াপাক খাদ্যে যাঁরা অভ্যস্ত, ক্ষতিকারক আহার বা পানীয় যাঁরা নেন, বিভিন্ন রোগে ভুগতে ভুগতে যাঁরা চিররুগ্ন হন, মল-মূত্রের বেগ ধারণ করে রাখেন তাঁদের তিনটি দোষ ই অর্থাৎ বায়ু পিত্ত ও কফ দূষিত হয়, আম অর্থাৎ অপক্ক অন্নরস উৎপন্ন হয়, সঙ্গে সঙ্গে শরীরের বিশেষ ধাতু যেমন রস, রক্ত ও শরীররস্থ জলীয় ধাতু দূষিত হয়।

উৎপন্ন হওয়া আম বা অপাচিত অন্নরস বায়ু দ্বারা বাহিত হয়ে জলবাহী সূক্ষ্ম স্রোত সমষ্টিতে স্থান সংশ্রয় করে এবং স্রোতের বা সূক্ষ্ম জল বহনকারী চ্যানেল কে অবরুদ্ধ করে, ফলে জল তার স্থান থেকে নির্গত হয়ে ত্বক এবং মাংসের মধ্যবর্তী স্থানে জমে গিয়ে এই জলোদর রোগ উৎপন্ন করে। এই জলোদর রোগ বিভিন্ন নামে পরিচিত যেমন দকোদর, উদকোদর, জাতোদর ইত্যাদি।

জলোদর উৎপন্ন হওয়ার আগে কিছু লক্ষণ প্রকাশ করে, যাকে পূর্বরূপ বলা হয়। যেমন খিদে কমে যাওয়া, মুখের স্বাদে অকারণে মিষ্টত্ব আসা, তৈলাক্ত বা গুরুপাক খাবার অত্যন্ত দেরিতে হজম হওয়া, পেটে ভারবোধ হওয়া, ক্রমশঃ দুর্বল হয়ে পড়া, অল্প পরিশ্রমেই শ্বাসকষ্ট হওয়া বা হাঁফ ধরা, পেটে বায়ু ঘুরে বেড়ানো, পেটের উপরের শিরাগুলি নজরে চলে আসা ইত্যাদি।

আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৭: কবিকন্যার সঙ্গে নগেন্দ্রনাথের সম্পর্কের অবনতি ঘটলেও কবির সঙ্গে ঘটেনি

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৫: আমার পায়ে ঝিঁ ঝিঁ, আমি জ্ঞান হারিয়েছি

 

রোগের প্রকারভেদ

সাধারণত জলোদর রোগ দু’ প্রকার। এক: স্বতন্ত্র জলোদর। অর্থাৎ যেখানে এই রোগ নিজে থেকে স্বতন্ত্রভাবে উৎপন্ন হয়, অন্য কোন রোগের উপদ্রব বা জটিলতা হিসাবে উৎপন্ন হয় না। দুই: পরতন্ত্র জলোদর, যখন অন্য রোগের উপদ্রব হিসাবে উৎপন্ন হয়, যেমন বৃক্কগত বা হৃদয়গত রোগ থেকে জলোদর রোগ আসে।
 

অপর প্রকারভেদ

জাতোদক ও অজাতোদকের উল্লেখ আমরা পাই, অর্থাৎ যখন জলোদর রোগে পেটের মধ্যে জমা জল আমরা লক্ষণ দ্বারা বুঝতে পারি তখন তা জাতোদক। অজাতোদক এমন একটি অবস্থা যেখানে জল জমার আগের অবস্থা সূচিত করে।
 

জলোদরের সাধারণ লক্ষণ

অরুচি, অক্ষুধা, অতি জলতেষ্টা বেড়ে যাওয়া, পায়খানা রাস্তায় নিরন্তর ভেজা ভাব, পেটে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, কাশি, দুর্বলতা, উদরপ্রদেশে অনেক শিরা রেখার আকারে প্রকাশ পাওয়া, জলপূর্ণ ভিস্তির মতো পেট হওয়া, জলের কম্পন বোধ টোকা দিলে বুঝতে পারা, বীভৎস ভাবে পেট উঁচু হয়ে ছড়িয়ে পড়া, বুকের ধড়ফড়ানি, হাঁটতে অক্ষমতা ইত্যাদি।
 

সাধ্যাসাধ্যত্ব

এই রোগ কষ্টসাধ্য বা অসাধ্য। দ্রুত রোগ নির্ণয়, নিদান পরিবর্জন ও সম্যক চিকিৎসা পেলে রোগী সারে। রোগের কিছু অসাধ্য লক্ষণ আছে, যেমন চোখের চারপাশে ফোলা, লিঙ্গ বা মূত্র প্রসেক দ্বার বিকৃত হওয়া, পেটের ত্বকে ভেজাভাব হওয়া এবং ভীষণ পাতলা হয়ে যাওয়া, ভীষণ ক্ষীণ বল হওয়া, রক্ত অত্যন্ত কমে যাওয়া, মাংস পেশী ক্রমশ শুকিয়ে যাওয়া, হজম ক্ষমতা ভীষণভাবে কমে যাওয়া, বুকে, মূত্রথলির উপর এবং মস্তকে শোথ বা ফোলাভাব আসা,হিক্কা, শ্বাস, বমি,পাতলা পায়খানা বারবার হতে থাকা, অতিতৃষ্ণা, মূর্ছা ইত্যাদি একসঙ্গে উপস্থিত হলে এই রোগ অসাধ্য।

আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩: সুন্দরবনে মানুষের আদি বসতি

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-১১: অধীনস্থ কর্মীদের উৎসাহ দিয়ে মানবসম্পদকে কী করে ব্যবহার করতে হয় সে বিদ্যা সুদক্ষ শাসকের থাকা উচিত

 

রোগের চিকিৎসা

অন্যান্য রোগের মতো এই রোগে ও নিদান অর্থাৎ রোগের কারণগুলি বিশেষ করে আহার-বিহার ও আচরণগত নিদানকে বাদ দিতে হবে।
 

আয়ুর্বেদের নিত্য বিরেচন

এই ক্রিয়া দ্বারা জল বার করা, আধুনিক চিকিৎসার মতো প্যারাসেনটেসিস করা হয় না। সাধারণতঃ সংশোধন চিকিৎসা অর্থাৎ বিরেচন ক্রিয়া ও পরবর্তীকালে নিরূহবস্তি দ্বারা জলোদর কে প্রশমিত করা হয়। সংশমন চিকিৎসা করেও ভালো ফল পাওয়া যায়। নিত্য বিরেচনের জন্য জলোদরারি রস ১২৫ মিলিগ্রাম থেকে ২৫০ মিলিগ্রাম মধু-সহ দেওয়া হয়।
 

অন্যান্য রসৌষধী

বারিশোষণ রস, নারাচ রস, যকৃত প্লিহারী রস, লোকনাথ রস ইত্যাদি ১২৫ মিলিগ্রাম থেকে ২৫০ মিলিগ্রাম দিনে দু’ বার মধু-সহ দেওয়া যায়।
 

বটি হিসেবে

কুটকি বটি, অভয়া বটি, আরোগ্যবর্ধিনী বটি ইত্যাদি ২৫০ মিলিগ্রাম থেকে ৫০০ মিলিগ্রাম দিনে একবার থেকে দু’বার দেওয়া যায়।
 

চূর্ণ হিসাবে

নারায়ণ চূর্ণ, পুনর্নবাদী চূর্ণ দু’ গ্রাম থেকে চার গ্রাম দিনে দু’বার দেওয়া যায়।
 

ক্বাথ বা পাচন হিসাবে

পুনর্নবাদী ক্বাথ, দশমূলাদী ক্বাথ ২০ মিলিলিটার থেকে ৪০ মিলিলিটার দিনে এক থেকে দু’ বার দেওয়া যায়।
 

অরিষ্ট হিসাবে

অর্জুনারিষ্ট, অভয়ারিষ্ট পুনর্নবাসব ২০ মিলিগ্রাম করে দিনে দু’ বার খাবার পর দিতে পারা যায়।
 

অর্ক ঔষধি হিসাবে

অর্কমকোর, অর্ক পুদিনা ১০ মিলিগ্রাম থেকে ২০ মিলিগ্রাম দেওয়া যায়।

আরও পড়ুন:

গা ছমছমে ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-৯: মোহাবিষ্ট মায়াবী কণ্ঠস্বর, চেনা বলার ঢং, তবে কি মোহিনী?

বিচিত্রের বৈচিত্র: মাই নেম ইজ গওহর জান—ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে অঘোষিত বিপ্লব এনেছিলেন এই শিল্পী

 

রসায়ন চিকিৎসা

পিপ্পলি বর্ধমান রসায়ন বিভিন্ন মাত্রায় বৈদ্যের পরামর্শ অনুযায়ী দিলে অত্যন্ত ভাল ফল পাওয়া যায়।
হরিতকী রসায়ন ও গুগ্গুলু রসায়ন বৈদ্যের পরামর্শ অনুযায়ী দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
 

খাদ্য হিসেবে

নির্জলা দুধে মানকচুর কন্দ চূর্ণ ও পুরনো শালী তন্ডুলের চূর্ণ মিশিয়ে ফুটিয়ে ক্ষীরের মতো দিলে জলোদর রোগী বলপায়, ও রোগ দ্রুত সেরে যায়।

এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো, জলপানের উপর ও জলীয় খাদ্য খাবার গ্রহণের উপর বিধিনিষেধ জারি রাখা হয়। কারণ শরীরের জল ভাব কমিয়ে আগ্নেয় ভাব বৃদ্ধি করা অর্থাৎ মন্দাগ্নি অবস্থা থেকে রোগীকে সমাগ্নিতে নিয়ে আসাই হল চিকিৎসার মূল চাবিকাঠি। তাই যদি জলোদর রোগের সঠিক চিকিৎসা পেতে চান, তবে সঠিক বৈদ্যের উপদেশ ও নির্দেশ পালন একান্ত কর্তব্য।
 

পথ্য

লালশাক, পুরনো চাল, পুরনো মানকচুর কন্দ চূর্ণ, নির্জলা দুধ, মাংস রস, মুগ ডাল, গোমূত্র, ঘোল, মধু, শুকনো আদা, পিপুল, পটল, মরিচ, করলা, হরিতকী ইত্যাদি।
 

অপথ্য

জলীয় প্রাণীর মাংস, পত্র শাক, পিস্টক, তেলেভাজা, গুরুপাক খাবার, দই, তিল, লবণ, টক, ঝাল, দূষিত খাবার, দিবানিদ্রা, ধূমপান ইত্যাদি।

* বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ (Ayurveda) : ডাঃ প্রদ্যোৎ বিকাশ কর মহাপাত্র (Dr. Pradyot Bikash Kar Mahapatra), অধ্যাপক ও চিকিৎসক, ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্রাজুয়েট আয়ুর্বেদিক এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ।

Skip to content