সাহিত্যিক বিমল মিত্র।
বিমল মিত্র যে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একজন বিরল ব্যক্তিত্ব এবং যুগ পুরুষ, এ বিষয়ে সন্দেহর কোনও অবকাশ নেই। রবীন্দ্রোত্তর সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর নাম অমর হয়ে আছে। এর প্রধান কারণ, তাঁর সাহিত্য কীর্তি। তিনি বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন। এই সাহিত্যিকের সৃষ্টি ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’, ‘বেগম মেরি বিশ্বাস’, ‘স্ত্রী’, ‘আসামী হাজির’ ইত্যাদি তাঁর অসাধারণ সাহিত্য কীর্তির মধ্যে কয়েকটি। এই সব সৃষ্টি তাঁকে চিরকাল বাঙালি মনে-মননে বিরল ব্যক্তিত্বের আসনে বসিয়েছে। বিমল মিত্র শুধু একজন সাহিত্য প্রেমিক বা এক অসাধারণ প্রতিভাময় সাহিত্যকি ছিলেন না, তিনি ছিলেন রবীন্দ্রোত্তর যুগে সাহিত্যের চালিকাশক্তি। ভারতের প্রাক স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতা উত্তর এই দুই যুগের সাহিত্যিক হিসেবে একজন যুগপুরুষ। কেন তাঁকে যুগ পুরুষ বলছি, তার কারণ তিনি শহর জীবনের কথা ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে এতো সুন্দর ও নিবিড় ভাবে গেঁথেছেন, তাঁর আগে কোনও সাহিত্যে এ ধরনের কাজ করেছেন কিনা তা নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন আছে।
শরৎচন্দ্রের মতো প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিকের উপন্যাস, ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ শুধু অসাধারণ সাহিত্যশৈলী নয়, বরং একটি বিশেষ যুগের অর্থাৎ পরাধীন ভারতের গ্রাম্য এবং শহর জীবনের উপকথা যেমন চিত্রায়িত করেছেন, একই ভাবে বিমল মিত্র কিন্তু এই যুগসন্ধি অর্থাৎ প্রাক স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতা উত্তর ভারতের ইতিহাসকে তাঁর ভাষার বিন্যাসে চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছেন। তাই শরৎচন্দ্রর পরে বিমল মিত্রকে আর একজন শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক বা ভাষ্য জাদুকর বা কথাসাগর এই অভিধায় চিহ্নিত করলে অত্যুক্তি হবে না।
শরৎচন্দ্রের মতো প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিকের উপন্যাস, ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ শুধু অসাধারণ সাহিত্যশৈলী নয়, বরং একটি বিশেষ যুগের অর্থাৎ পরাধীন ভারতের গ্রাম্য এবং শহর জীবনের উপকথা যেমন চিত্রায়িত করেছেন, একই ভাবে বিমল মিত্র কিন্তু এই যুগসন্ধি অর্থাৎ প্রাক স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতা উত্তর ভারতের ইতিহাসকে তাঁর ভাষার বিন্যাসে চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছেন। তাই শরৎচন্দ্রর পরে বিমল মিত্রকে আর একজন শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক বা ভাষ্য জাদুকর বা কথাসাগর এই অভিধায় চিহ্নিত করলে অত্যুক্তি হবে না।
বিমল মিত্র তাঁর অসাধারণ লেখনী শক্তির প্রয়োগে তিনশো বছরের ভারতের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ঘটনাকে সাহিত্যের আঙ্গিকে একাধিক চরিত্রের মাধ্যমে সৃজিত করেছেন এবং তা দর্শক ও পাঠকদের সামনে প্রাঞ্জল ভাবে প্রস্তুত করেছেন। এটা কিন্তু খুব সহজ কাজ নয়। ইতিহাসের সঙ্গে সাহিত্যের সুনিপুণ মেলবন্ধনে সজীব করে তোলা অত্যন্ত দুরূহ কীর্তি। কারণ একদিকে যেরকম ইতিহাসের উপাদানকে লেখককে তুলে আনতে হবে, সেই সঙ্গে বর্তমান সমাজ পরিস্থিতির মণি-মানিক্যকেও কিন্তু ঠিক ঠিক ভাবে মালাকরের মতো একটি সূত্রে গেঁথে তাকে সুন্দর রূপে সমাজের গ্রহণযোগ্য রূপে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে হবে। যথেষ্ট কঠিন কাজ। অনেকেই এই সাহিত্যিকের মতো আমাদের ইতিহাসকে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন। এটা পূর্বেও হয়নি, ভবিষ্যতেও কত জন লেখক বা সাহিত্যিক এটা তুলে ধরতে পারবেন, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
আরও পড়ুন:
যা দেখছি, যেমন দেখছি: জলবায়ু রাজনীতি— ভারত ও কানাডার মধ্যে সাহায্য ও সহযোগিতার সম্ভাবনা
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৭: কবির লেখা, লেখার গল্প
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৯: মিশ্র মাছচাষ পদ্ধতিতে শুধু ফলন বাড়েনি, মাছের বৈচিত্রের সমাহারও নজর কেড়েছে
বিমল মিত্রর সাহিত্যকর্ম শুধু আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেনি, আমাদের জীবনবোধকেও অন্যরূপ দিয়েছেন। ইতিহাসকে অনুধাবনের সুর ও তালের মধ্যে দিয়ে আয়ত্ত্ব করতে আমাদের তিনি বাধ্য করেছেন। সমাজ ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বহমান নদীর মতো চলে, বিভিন্ন সময়ে তা আবার বাধা প্রাপ্ত হয় এবং সেই বাধা প্রাপ্তির ফলে সে তার পরিবর্তিত পথও খুঁজে নেয়। অর্থাৎ সাহিত্যে যেখানে দমবন্ধ হয়ে উঠেছে, সেখানে একজন গুণী সাহিত্যিক তাঁর সাহিত্য প্রতিভার সাহায্যে অবরুদ্ধ হাওয়া পথ, হারিয়ে যাওয়া পথকে গতিমান করে তুলতে পারেন। বিমল মিত্র এমন একজন সাহিত্যিক যাঁর সাহিত্যসোপান বাংলা সাহিত্যকে শিখরের শীর্ষ বিন্দুতে নিয়ে গিয়েছে, তা আমরা জোর গলায় বলতেই পারি। বিমল মিত্রের অনিন্দ্য সুন্দর সাহিত্য কীর্তি বাংলা সাহিত্যকে শুধু সমৃদ্ধ করেছে তা কিন্তু নয়, নিজেদেরকে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে আয়নার সামনে একপ্রকার দাঁড়াতে বাধ্যই করিছেন।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৪: সমাজে নারীর বন্ধ্যাত্ব এবং পিতৃতান্ত্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থা
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩০: দিনের পরে দিন গড়ে যায় ‘বিধিলিপি’
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৫: আরডি-র ‘লাকড়ি কি কাঠি কাঠি পে ঘোড়া’ আজও ছোটদের মধ্যে সমানভাবে জনপ্রিয়
কলকাতার বাবু সংস্কৃতির সুচতুর রূপকে তিনি তাঁর উপন্যাসগুলির মাধ্যমে যেভাবে তুলে ধরেছেন তার আগে বা পরে অন্য কোনও সাহিত্যিক কিন্তু এই আঙ্গিকে বাংলা তথা ভারতের তিনশো বছর ইতিহাসকে এতো সুন্দর ভাবে পাঠকের সামনে আনতে পারেনি। এই জন্যই বিমল মিত্র এক অনন্য কৃতিত্বের অধিকারী। তিনি কেবল একজন প্রতিভাবান সাহিত্যিক শুধু নন, একজন অসামান্য মানুষও, যিনি তাঁর গবেষণা লব্ধ তথ্য ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে যাচাই করে পাত্র-পাত্রী সৃষ্টি করে এই ইতিহাসকে মানুষের সামনে সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে এমন অপূর্ব ভাবে পরিবেশন করেছেন, যা মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের সঙ্গে বলতে হয়, এমন একজন প্রতিভাবান সাহিত্যিককে আমরা বোধহয় যথাযথ মূল্য দিতে পারিনি।
আরও পড়ুন:
অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-১৪: প্রকৃত ভক্ত শত বিপদেও নামের সাধন করতে ছাড়েন না
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১১: কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দু’ একটি ছবি তুলতে না তুলতেই হাত অসাড় হয়ে যাচ্ছিল
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৪: গরম পড়েছে, যত পারুন ঠান্ডা খান! কী হচ্ছে এর ফলে?
বিমল মিত্রের ছোটগল্পের আঙিনায় অসংখ্য সিনেমা সৃষ্টি হয়েছে। বাংলা ও হিন্দি-সহ একাধিক প্রাদেশিক ভাষায় তা অনূদিতও হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের সাহিত্যপ্রেমী মানুষ অনুবাদ সাহিত্যের সুযোগে বিমল মিত্রকে জানার সুযোগ পেয়েছেন। তাঁর সাহিত্য রসের আঘ্রাণে স্নাত হয়েছেন। তাঁকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে তাঁদের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান দিয়েছেন। একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক হিসাবে যুগান্তরের পথে যাত্রা করেছেন।
তবে একটা দ্বিধা বার বার জানান দেয় যে, বাঙালি হিসেবে বিমল মিত্রের মতো একজন অনন্য সাহিত্যকে আমরা সেই ভাবে মনে রাখতে পারিনি। সম্মান জানাতে পারিনি। হয়তো অনেকেরই অজানা, ইনি এমন একজন সাহিত্যিক, যাঁর লেখার মূল্যায়ন সেই যুগে এমন কোনও পত্র-পত্রিকা নেই যেখানে তাঁর প্রতিভাকে সম্মান জানানো হয়েছে। বাংলা, হিন্দি সিনেমার মধ্যে তার চিত্রিত গল্পের চরিত্রগুলি নির্দ্বিধায় ফিরে এসেছে মানুষের মনে, শয়নে-স্বপনে-জাগরণে। তিনি আমাদের নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছেন সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা। প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন আমাদের মৌলিক মূল্যবোধকে, আমাদের ইতিহাস চেতনাকে। সেই সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক বোধের দোরগোড়ায় কড়া নেড়েছে তাঁর অমর সাহিত্য কীর্তিগুলি।
তবে তাঁর সাহিত্যে কর্ম পাঠকের মনের মণিকোঠায় স্থান করে নিলেও, শুধু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রবীন্দ্র পুরস্কার ব্যতীত তাঁর ঝুলিতে ভারতের বড় কোনও পুরস্কার জোটেনি। অর্থাৎ পদ্ম সম্মান, একাদেমি পুরস্কার ইত্যাদি কোনও পুরস্কারই তিনি পাননি। কেন এমনটা হল? এমন প্রশ্ন অবশ্যই করা যায়। তার কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, বিমল মিত্রের মতো এমন সাহিত্যিক আগে ও পরে এই ধরণের বড় পুরস্কার পেয়েছেন, কিন্তু এটাও ঠিক কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাঁদের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঁকি দিয়েছে। কিন্তু ইর্ষনীয় কীর্তির অধিকারী হয়েও বিমল মিত্রের মতো এমন ব্যতিক্রমী প্রতিভার যথাযথ মুল্যায়ন কেন হয়নি, এ প্রশ্ন মরিচিকা মতো আজও বাঙালি মননে দানা বেঁধে আছে।
* প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
তবে একটা দ্বিধা বার বার জানান দেয় যে, বাঙালি হিসেবে বিমল মিত্রের মতো একজন অনন্য সাহিত্যকে আমরা সেই ভাবে মনে রাখতে পারিনি। সম্মান জানাতে পারিনি। হয়তো অনেকেরই অজানা, ইনি এমন একজন সাহিত্যিক, যাঁর লেখার মূল্যায়ন সেই যুগে এমন কোনও পত্র-পত্রিকা নেই যেখানে তাঁর প্রতিভাকে সম্মান জানানো হয়েছে। বাংলা, হিন্দি সিনেমার মধ্যে তার চিত্রিত গল্পের চরিত্রগুলি নির্দ্বিধায় ফিরে এসেছে মানুষের মনে, শয়নে-স্বপনে-জাগরণে। তিনি আমাদের নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছেন সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা। প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন আমাদের মৌলিক মূল্যবোধকে, আমাদের ইতিহাস চেতনাকে। সেই সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক বোধের দোরগোড়ায় কড়া নেড়েছে তাঁর অমর সাহিত্য কীর্তিগুলি।
তবে তাঁর সাহিত্যে কর্ম পাঠকের মনের মণিকোঠায় স্থান করে নিলেও, শুধু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রবীন্দ্র পুরস্কার ব্যতীত তাঁর ঝুলিতে ভারতের বড় কোনও পুরস্কার জোটেনি। অর্থাৎ পদ্ম সম্মান, একাদেমি পুরস্কার ইত্যাদি কোনও পুরস্কারই তিনি পাননি। কেন এমনটা হল? এমন প্রশ্ন অবশ্যই করা যায়। তার কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, বিমল মিত্রের মতো এমন সাহিত্যিক আগে ও পরে এই ধরণের বড় পুরস্কার পেয়েছেন, কিন্তু এটাও ঠিক কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাঁদের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঁকি দিয়েছে। কিন্তু ইর্ষনীয় কীর্তির অধিকারী হয়েও বিমল মিত্রের মতো এমন ব্যতিক্রমী প্রতিভার যথাযথ মুল্যায়ন কেন হয়নি, এ প্রশ্ন মরিচিকা মতো আজও বাঙালি মননে দানা বেঁধে আছে।
* প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
* সৈকতকুমার বসু (Saikat Kumar Basu), বিশিষ্ট উদ্ভিদ বিজ্ঞানী, কানাডা।