সোমবার ৮ জুলাই, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

বিশ্ব জুড়ে পাটের ব্যবহার অপরিসীম। তবুও যেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়ে রয়েছেন আমাদের চাষিভাইরা। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পাটের যোগান দিয়ে চলেছে পশ্চিমবঙ্গ। পাটের মাদুর, পটচিত্র, পাটের গয়না বিশ্বমানে খ্যাতির শীর্ষে বিরাজ করছে। কিন্তু সেই উৎপাদনকারী মানুষগুলোর সংসার চলে অভাব অনটনে। পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথী, হুগলি নদীর পাশ্ববর্তী উর্বর পলিমাটি এবং পরিমিত উষ্ণতা এবং বৃষ্টিপাত হাওড়া, বজবজ, টিটাগড়, কলকাতা এবং ভদ্রেশ্বর—এইসব জেলায় পাট চাষের উন্নতিতে বিশেষ সহায়তা করেছে। অপরদিকে কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, মালদহ, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, পূর্ব মেদিনীপুর, পূর্ব বর্ধমান পাট চাষে সেভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।
 

পাট চাষ ক্রমশ কেন হারিয়ে যাচ্ছে?

গত কয়েক বছরে রাজ্যে পাট চাষের জমি প্রায় ২ লক্ষ হেক্টর কমেছে। অথচ দেশের মোট পাট উৎপাদনের বড় অংশই আসে পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলি থেকে। বছরে প্রায় ৩৫০০ টন পাটের বীজ প্রয়োজন হয়, তা সাধারণত খোলা বাজার থেকেই কিনতে হয় চাষিদের। আবার অনেক ক্ষেত্রেই বাজারে নিম্নমানের বীজও বিক্রি হয় বলে চাষিদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ। বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, বছর খানেক আগেও যেখানে রাজ্যে ৭ লক্ষ হেক্টরের মতো জমিতে পাট চাষ হতো, এখন তা কমে হয়েছে ৫ লক্ষ হেক্টর। আশঙ্কা, ভবিষ্যতে চাষের জমি আরও কমতে পারে। জলের অভাব, চাষের খরচ বেড়ে যাওয়া ও পাটের ঠিক মতো দাম না পাওয়া এর অন্যতম কারণ। আবার বাজারে সরকারি ভাবে পরীক্ষিত উন্নত মানের বীজ পাওয়া যায় না বলেও চাষিরা প্রায়ই অভিযোগ করেন। শিল্প মহলের বক্তব্য, খোলা বাজারে ভালো মানের বীজের অভাবেই পশ্চিমবঙ্গে প্রতি বছর উৎপাদন বেশ কিছুটা মার খায়। পাটের মানও বিশেষ ভালো হয় না। রঙের ক্ষেত্রেও প্রভাব পড়ে।

এককালে পশ্চিমবঙ্গের আরামবাগ মহকুমার পুড়শুড়া, আরামবাগ, খানাকুল এবং গোঘাটে ১৫ হাজার হেক্টর জমি জুড়ে পাট চাষ হতো। এলাকা কমতে কমতে এ বছর মাত্র ১৬০০ হেক্টরে ঠেকেছে। লাভ বেশি হওয়ায় পাট ছেড়ে বাদাম ও তিল চাষে মনোনিবেশ করছেন এখানকার চাষিরা। বংশানুক্রমে পাট চাষের সঙ্গে যুক্ত কৃষকরাও মুখ ফিরিয়েছেন চাষের থেকে। প্রধান কারণ হিসেবে বলা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাট বেচে দাম মেলে না। ক্রেতারা পাটের আঁশ খারাপের অজুহাত দেন, অনেক সময় পাট পচানোর জল মেলে না পরিমাণ মতো। আলুর বস্তা, ধানের বস্তা সব পলিথিনের হয়ে যাওয়ায় চাহিদা ক্রমশ কমে আসছে। খালি জ্বালানি হিসাবে উৎকৃষ্ট পাট কাটির প্রয়োজনে বিঘা খানেক জমি চাষ করেন কিছু চাষিভাই। সেই তুলনায় ওই জমিতে অন্যান্য ফসল চাষ করে লাভের মুখ দেখছেন তারা। কিছু চাষিরা গাছ বড় হওয়ার খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পাট বিক্রি করতে শুরু করে দেন। বিশেষত ছোট মাঝারি চাষিরা ফসল ধরে রাখতে পারে না। যাঁদের ধার-দেনা মেটাতে, দৈনন্দিন সাংসারিক অভাবের তাড়নায় দ্রুত ফসল বিক্রি করা ছাড়া উপায় থাকে না। সেই পাটের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে দালাল-মহাজন তথা বড় ব্যবসায়ীরা। পাট চাষিরা ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে চরম হতাশাগ্রস্ত, কিছু চাষিভাই ও বন্ধ হয়ে যাওয়া পাট কলের কর্মী আত্মহত্যা করেছেন। উৎসবের মরসুমেও এই ‘সোনালি তন্তু’র ছায়া অন্ধকারময় করে তোলে বহু মানুষের জীবন।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫১: সর্বত্র নিরবিচ্ছিন্ন প্রচার প্রয়োজন, তবেই বাড়বে মাছ নিয়ে সচেতনতা, উপকৃত হবে আমজনতা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৯: প্লেগে কন্যার মৃত্যু, সেই শোক অবনীন্দ্রনাথের ছবিতে পায় ভিন্নতর মাত্রা

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১২: দ্রুত গাড়ি চালিয়ে ঢুকে পড়লাম নিকটবর্তী একটা অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে

হাত বাড়ালেই বনৌষধি: রোজ খাওয়ার পরে পান খান? অনেক ওষুধ কেনার খরচ বেঁচে যেতে পারে

 

সীমাবদ্ধতার সম্ভাব্য কারণ

 

মিলছে না ক্ষতিপূরণ

ফসলে পাওয়া লাভের তুলনায়, ফসল চাষ করতে কৃষকরা অনেক বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। বিঘাপ্রতি পাট কাটা ও বয়ে নিয়ে যাওয়াতে গড়ে ৭ জন করে মজুরের প্রয়োজন পড়ছে। সেই টাকা উঠে আসছে না পাট বিক্রি করে। পাটের দাম প্রতি মনে (৪০ কেজি) কমে চলেছে ক্রমাগত। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় পাট পচাতে ও আঁশ ছাড়াতে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন চাষিভাইরা। পাটের রঙের ওপর এর প্রভাব পড়ছে প্রচুর পরিমাণে। ফলে বাজারে কমে চলেছে দাম। ক্ষতিপূরণ মিলছে না কোনও মতে।
 

বাজার দর কমেছে

পাটের বাজার দর কমেছে অনেকাংশে। বাজারজাত জিনিসের আকাশ ছোঁয়া দামের কাছে পাট চাষিরা পিছিয়ে পড়ছেন ক্রমাগত। ফলে এই চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্যান্য চাষে উৎসাহিত হচ্ছেন অনেকেই। সার, বিষের দামের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে হাঁপিয়ে উঠছেন নিম্নবিত্ত শ্রেণির কৃষকরা।
 

চাহিদা মেটাচ্ছে পলিথিনের বস্তা

আগে কৃষিজ ফসল-সহ অন্যান্য শিল্পজাত দ্রব্য আমদানি, রপ্তানি কিংবা সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে প্রচুর পরিমাণে পাটের বস্তার চাহিদা ছিল। এখন সেই চাহিদা মিটিয়ে দিয়েছে পলিথিনের বস্তা, পাটের বস্তার চাহিদা কমে আসছে দ্রুতগতিতে। পলিথিনের বস্তা পরিবেশের সঙ্গে পচনশীল নয়, পরিবেশের ক্ষতি করে চলেছে ক্রমাগত, সেই বিষয়ে সরকারের সতর্ক বার্তা দেওয়া উচিত, পলিথিনের বস্তার পরিবর্তে আবার পাটের বস্তা ব্যবহারে জোর দেওয়া প্রয়োজন।

আরও পড়ুন:

বিমল মিত্র: এক অসামান্য প্রতিভার অবমূল্যায়ন

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-১৬: বৈধীভক্তি ছাড়িয়ে রাগভক্তি লাভ হয়

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩২: কি ‘উপহার’ সাজিয়ে দেব

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০: তত্ত্বতালাশ

 

পর্যাপ্ত জলের অভাব

পাটের আঁশ ছাড়ানোর মতো পর্যাপ্ত জলের দেখা মিলছে না অনেকাংশেই, জলের সমস্যা থাকায় কিছু চাষি নদী থেকে খাল কেটে বাঁধ দিয়ে জল সংরক্ষণ করে পাট পচান, সে ক্ষেত্রে পাটের রং নষ্ট হয়ে যায়, পাট ময়লা হয়, দামও কম মেলে। অনেকাংশে জলের অভাবে পাট মাঠে পড়ে থেকেই শুকনো হয়ে যায়। নিম্ন মানের বীজ চাষে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চলেছেন চাষিরা।
 

প্রতারিত হচ্ছেন গরিব চাষিভাইরা

পাটের বাজারে সরকারের দাম নিশ্চিত নয়। এর ফলে খুব সহজেই দালালরা ঠকিয়ে পয়সা কামিয়ে নিচ্ছে গরিব চাষিভাইদের থেকে।
 

পাট কেনার আগ্ৰহ কম

পঞ্চায়েতগুলি পাট কেনাতে আগ্ৰহ দেখাচ্ছে না। এমনকি উন্নত মানের পাটের বীজ চাষিদের দেওয়াতেও দেখা দিয়েছে চরম অনীহা।
 

পুরানো প্রযুক্তির

পুরোনো পাট কাচার পদ্ধতির পরিবর্তে, নতুন প্রযুক্তির দাবি করছেন চাষিরা। যাতে জলের অভাবে চাষিদের ক্ষতির সম্মুখীন না হতে হয়।
 

চাহিদা কম

পাট কলের মালিকদের দাবি, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় নিয়মিত রপ্তানি হচ্ছে না, বিদেশ থেকে পাওয়া পাটের অর্ডার কমেছে।

আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৭: পঞ্চমের কথা মতো ড্রাম ছেড়ে অমরুতের পিঠের উপর স্যাম্পল রিদম বাজাতে শুরু করলেন ফ্রাঙ্কো!

ইংলিশ টিংলিশ: ‘be verb’ এবং ‘have verb’ এর ব্যবহার জানেন? সহজ উপায়ে শিখে নিতে ভিডিয়ো ক্লিপটি দেখুন

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-৫: বলবয় থেকে বিশ্বসেরা

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-১: রাজার ছেলেদের রাজনীতি-কূটনীতি শেখানোর জন্যই লেখা হয়েছিল এই গ্রন্থ

 

নিম্নমানের যন্ত্রপাতি

রাজ্যের বেশিরভাগ পাটকল ইংরেজ আমলে তৈরি। যন্ত্রপাতির মান অতি নিম্ন। ফলে উন্নত মানের জিনিস তৈরির থেকে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছে রাজ্যের পাটকলগুলি।
 

মালিক-শ্রমিক অসন্তোষ

মালিক-শ্রমিক অসন্তোষ পাটের বাজারে এক বিরাট প্রভাব ফেলছে। কিছু দিন পর পর পাটের কারখানায় ধর্না, ধর্মঘট, শ্রমিক ছাঁটাই, শ্রমিকদের সঠিক সময় বেতন না দেওয়া লেগেই রয়েছে, যা পাটের বাজার নষ্ট হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হয়।
 

জমি রক্ষা করতে

শুধু জমি রক্ষার খাতিরে পাট চাষ করছেন বহু কৃষক পরিবার, ক্ষতির সম্মুখীন হয়েও।
 

প্রশিক্ষণের অভাব

কিছু কিছু জেলার পাট চাষিদের পর্যাপ্ত ধারণা নেই এই চাষ সম্পর্কে। কিছু অংশে পাটের বাজার মন্দা যাওয়ার কারণ হিসেবে এটাও ধরে নেওয়া যেতে পারে। বিশেষ প্রশিক্ষণ-সহ হাতে কলমে এই চাষ সম্পর্কে তাঁদের বোঝালে হয়তো তাঁরাও এই তন্তু চাষে আগ্রহী হতে পারেন।

* প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।

* প্রতনু বন্দোপাধ্যায় ও সুদীপ ভট্টাচার্য, গবেষক।

Skip to content