সোমবার ৮ জুলাই, ২০২৪


১৭৮৯ সালে ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার স্যার উইলিয়াম জেসপ সর্বপ্রথম পৃথিবীতে লোহার রেল তৈরি করেন। এটা সীমিত জায়গায় পাতা হলেও এর ওপর দিয়ে প্রচুর মাল পরিবহন করা হতো। এর পর ১৮১৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া থেকে নিউইয়র্ক পর্যন্ত ঘোড়ায় টানা রেলের পত্তন হয়। আমরা সকলেই বাষ্পীয় ইঞ্জিন এর আবিষ্কারক জর্জ স্টিফেনসনের নাম শুনেছি। তিনি কয়লা খনির একজন সামান্য শ্রমিক ছিলেন। লেখাপড়া বিশেষ কিছু করেননি। কিন্তু তার উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে ১৮১৪ সালে তিনি খনির মধ্যে কয়লা বোঝাই গাড়ি ট্রাম রাস্তার ওপর দিয়ে হাতে না টেনে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের সাহায্যে টেনে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেন। স্টিফেনসন থেমে থাকেনি, তিনি এগিয়ে যান। ১৮২১ সালে তিনি পরিপূর্ণ ভাবে রেল ইঞ্জিন তৈরি শুরু করেন। এবং ১৮২৫ সালে তাঁর কাজ সম্পূর্ণ করেন। তাঁর সৃষ্ট প্রথম বাষ্পীয় রেল ইঞ্জিনের নাম ‘লোকোমোশন’।

এর পর ক্রমান্বয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ও আমেরিকায় রেল প্রচলন শুরু হয়। ১৮২৯ সালে ফ্রান্সে, ১৮৩০ সালে আমেরিকায়, ১৮৩৫ সালে জার্মানিতে, ১৮৩৬ সালে কানাডায়, ১৮৩৭ সালে রাশিয়াতে, ১৮৩৯ সালে ইংল্যান্ডে, ১৮৫২ সালে ইতালিতে রেল চলাচল শুরু হয়I
 

ভারতে রেল চলাচল শুরু

স্বাধীনতার পূর্বে মুঘল বাদশারা ও পরবর্তী দীর্ঘ সময়ে ব্রিটিশরা ভারতে শাসনব্যবস্থা চালিয়ে গিয়েছেন। ১৮৪৮ সালে লর্ড ডালহৌসি ভারতে গভর্নর জেনারেল রূপে আগমন করেন। তিনি ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত ওই পদে আসীন ছিলেন। ইংল্যান্ডে থাকা অবস্থায় রেলের প্রযুক্তি ও সম্প্রসারণ নিয়ে তার কিছু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল। ভারতে এসে তিনি তা কার্যে রূপায়িত করেন। তারই প্রচেষ্টায় রেলের প্রতিষ্ঠা ও সম্প্রসারণের কাজ ত্বরানিত হয়।

ভারতের মতো বিশাল দেশে রেলপথ নির্মাণ এবং সম্প্রসারণ মোটেই সহজ কাজ ছিল না। নদী-নালা, পাহাড়, গভীর জঙ্গল, মুরুভূমিকে মোকাবিলা করে অসংখ্য ছোট বড় ব্রিজ ও টানেল নির্মাণ করে রেলের সম্প্রসারণ ও অগ্রগতি সম্ভবপর হয়েছে।

১৮৫৩ সালের ১৬ এপ্রিল (১ বৈশাখ) দুপুর ৩:৩৫ মিনিটে বরিন্দর থেকে থানে পর্যন্ত (২১ মাইল) ২১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে ভারতে প্রথম যাত্রীবাহী রেল চলাচল শুরু হয়। এই শুভ যাত্রা পরিদর্শন করার জন্য আশেপাশের মানুষ এসে সামিল হন। বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তারা দেখলেন যে, দৈত্যাকার এক যন্ত্র কেমন কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সরু দুটো লাইনের ওপর দিয়ে ছুটে চললো। কেউ কেউ সেই দৈত্যকে ফুলমালা দিয়ে পুজো করলো। গাড়িতে তিনটে স্টিম ইঞ্জিন আর ১৪টি কামরা লাগানো হয়েছিল। ৫৭ মিনিট চলার পর ট্রেন বরিন্দার থেকে থানে পৌঁছয়।
 

বাংলাতে প্রথম রেল গাড়ি চলাচল

ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে ১৮৫৪ সালে ১৫ আগস্ট হাওড়া- হুগলির মধ্যে রেল চলাচলের ব্যবস্থা করে। এই ট্রেন সকাল ৮:৩০ মিনিটে হাওড়া থেকে রওনা হয়ে ২৪ মাইল অতিক্রম করে বেলা ১০টার সময় হুগলি পৌঁছয়। এই সময় হাওড়া ছিল একটা গণ্ড গ্রাম। হাওড়া স্টেশন ছিল রেলের গোডাউন। একটি অস্থায়ী ঘর তৈরি করে টিকিট কাউন্টার বানানো হয়েছিল। তখনকার দিনে রেলগাড়িতে চড়ার জন্য বিভিন্ন কুসংস্কার থাকা সত্ত্বেও প্রথম ট্রেন চড়বার মর্যাদা পাবার জন্য প্রায় হাজার তিনেক দরখাস্ত জমা পড়েছিল। লোকাল ট্রেনগুলিতে বর্তমানে যে অবস্থা হয়, সেদিনও ছশো সাতশো ক্ষমতাসম্পন্ন রেলগাড়িতে প্রায় ৮০০ যাত্রী নিয়ে হাওড়া থেকে হুগলি গিয়ে ফিরে আসতো। হাওড়াতে এই প্রথম চালু হওয়া ট্রেনে তিনটি প্রথম শ্রেণি, দুটি দ্বিতীয় শ্রেণি এবং ব্রেকভ্যান সহ তিনটি তৃতীয় শ্রেণির কামরা ছিল। আনন্দের কথা এই সব কোচগুলি ভারতেই তৈরি হয়েছিল।

এই ট্রেনেও ভ্রমণ করার জন্য মানুষ খুব উৎসাহিত ছিল। শ্রদ্ধেয় ডাঃ সুকুমার সেনের লিখিত রেলের পাঁচালিতে এই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করা হয়েছে। বাবু রামগোপাল ঘোষ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শেয়ার কিনেছিলেন। তার বাড়ি ছিল পাণ্ডুয়া ও মগরার মাঝামাঝি কোনও এক গ্রামে। রেল কর্তৃপক্ষ তাদের কর্মচারীদের বিষয়টি জানিয়ে রেখেছিলেন। সপ্তাহের শেষে রামগোপাল দেশের বাড়িতে যাতায়াত করতেন। তার যাতায়াতের সময় রেল কর্মচারীরা টতোস্থ থাকতো। একদিন ওঁর দেশ থেকে ফেরার কথা। উনি গাড়িতে আছেন কিনা খেয়াল না করে রেলগাড়ি ছেড়ে দেওয়া হয়। কিছু দূরে যাবার পর তারা লক্ষ্য করে রামগোপাল বাবুর পালকি ছুটে আসছে। তৎক্ষণাৎ গাড়ি থামিয়ে দেওয়া হল। রামগোপাল বাবু এলেন, রেলগাড়িতে চড়ে বসলেন এবং তারপর গাড়ি ছাড়া হল। ১৫ আগস্ট হাওড়া থেকে হুগলি রেল চালু হওয়ার ১৫ দিনের মাথায় ১ সেপ্টেম্ব র ১৮৫৪ সালে পাণ্ডুয়া পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারিত হয়। ১৯৮৫ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে হাওড়া থেকে রানিগঞ্জ পর্যন্ত রেল চলাচল শুরু হল।

১৮৯০ সালে রেলওয়ে অ্যাক্ট তৈরি হয়। এই আইনের মাধ্যমে রেলের পরিষেবা, সুরক্ষা, সঞ্চালন, নির্মাণ ইত্যাদি প্রত্যেকটা বিষয়ে নিয়ম কানুন তৈরি করার ব্যবস্থা করা হয়। এই নিয়মগুলি রেলে শৃঙ্খলার সঞ্চার সৃষ্টি করে, যার ফলে শাসব্যবস্থার উন্নতি হয়। ১৮৬৫ সালে সর্বপ্রথম ভায়খেলা কারখানায় জিআইপি লোকোমোটিভ ইঞ্জিন তৈরি করে। ১৮৯০ সালে জামালপুর কারখানায় লোকোমোটিভ ইঞ্জিন তৈরি শুরু হয়। ভারতে ইঞ্জিন তৈরি হলেও বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। বিদ্যুতের বিকাশের ফলে রেলে সঞ্চার ব্যবস্থার উন্নতি ঘটে। ১৯২২ সালে নিউ হারবার লাইন তৈরি হয়। এবং প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রেন বোম্বের (এখন মুম্বই) ভিটি থেকে কুরলার মধ্যে যাতায়াত শুরু করে।

এই বৈদ্যুতিক ট্রেনটির উদ্বোধন করেন তৎকালীন রাজ্যপাল লেসিলে উইলসন। আর বৈদ্যুতিক ট্রেন চলাচলের ক্ষেত্রে ভারত বিশ্বের ২৪তম দেশ এবং এশিয়াতে তৃতীয় দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। পশ্চিমবঙ্গে বৈদ্যুতিক ট্রেন চলাচল শুরু হয় ১৯৫৭ সালের ৩০ নভেম্বর হাওড়া থেকে শেওড়াফুলি পর্যন্ত। ১৯৩৬ সালে ভারতে সর্বপ্রথম বাতানুকুল রেলের প্রবর্তন হয়। জিআইপি রেল এগুলিকে মাতুঙ্গা কারখানায় তৈরি করায়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতীয় রেলের বিস্তার ছিল ৬৫,২১৭ কিমি। দেশ ভাগ হওয়ার ফলে ১০,৫২৩ কিমি পাকিস্তানে চলে যায়। ভারতে থাকে ৫৪,৬৯৪ কিমি। ১৯৫০ সালে চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ কারখানার গোড়াপত্তন হয়। প্রতিবছর ১২০টি স্টিম ইঞ্জিন তৈরি করা হতো। ১৯৫০ সালে রেল বোর্ডকে সুসংগঠিত করা হয়। একজন ক্যাবিনেট স্তরের রেল মন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। রেলবোর্ডকে প্রভূত ক্ষমতা দেওয়া হয়। আঞ্চলিক রেলের প্রধানকে জেনারেল ম্যানেজারের আখ্যা দেওয়া হল। আর অঞ্চলগুলোকে ডিভিশনে বিভক্ত করা হয়।
১৯৬৯ সালের ১ মার্চ ঘণ্টায় ১২০ কিমি গতিতে হাওড়া নিউদিল্লি রাজধানী এক্সপ্রেস চলাচল শুরু হয়। ১৯৮৫ সালে কম্পিউটার চালিত রিজার্ভেশন পদ্ধতি চালু করা হয়। ১৯৮৮ সালে শতাব্দী এক্সপ্রেস চালু হয় নিউ দিল্লি ও ঝাঁসির মাঝে। ২০০২ সালে পূর্ব রেল থেকে ডিভিশন ও নর্থ ইস্টার্ন রেল থেকে ২টি ডিভিশন নিয়ে নতুন জোন পূর্ব মধ্য রেল চালু করা হয়। অন্যভাবে পশ্চিম রেলকে ভাগ করে উত্তর পশ্চিম রেলওয়ে জোন গঠন করা হয়। দক্ষিণ পূর্ব রেলওয়েকে তিন ভাগ করে ইস্ট কোস্ট রেলওয়ে এবং সাউথ ইস্ট সেন্ট্রাল রেলওয়ে গঠন করা হয়। সর্বপ্রথম পাতাল রেল চালু হয় ইংল্যান্ডে। ১৮৬৩ সালের ১৮ জানুয়ারি কলকাতায় পাতাল রেলের শিলান্যাস করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭২ সালের ২৯ ডিসেম্বর।
আরও পড়ুন:

ছোটদের যত্নে: আপনার সন্তান কি প্রায়ই কাঁদে? শিশুর কান্না থামানোর সহজ উপায় বলে দিচ্ছেন ডাক্তারবাবু

আর রেস্তরাঁয় কেন? ভুনা চিকেন রেসিপি বাড়িতেই রাঁধুন সহজে

প্যারিস, ইউট্রেকট, আমস্টারডাম হয়ে ব্রাসেলস—স্বপ্নের ভ্রমণ ডেসটিনেশন/২

ইংলিশ টিংলিশ: Preposition-এর মূল নিয়মগুলো জানো কি?

২৪ অক্টোবর ১৯৮৪ সালে ধর্মতলা থেকে ভবানীপুর পর্যন্ত বিকেল ৩:৪০ মিনিটে মেট্রো রেল চলা শুরু করে। সেদিন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ও তৎকালীন রেল মন্ত্রী এবিএ গনিখান চৌধুরী। ১৯৯৫ সালে দমদম থেকে টালিগঞ্জ পর্যন্ত মেট্রো রেল সম্প্রসারিত হয় (১৬.৪৩ কিমি)। পরবর্তী সময়ে উত্তরে প্রথমে নোয়াপাড়া ও তারপর দক্ষিণেশ্বর পর্যন্ত এবং দক্ষিণে নিউ গড়িয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়।

কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে রেল হল সর্ববৃহৎ দপ্তর। রেলের জন্য ক্যাবিনেট পর্যায়ে একজন স্বাধীন মন্ত্রী থাকেন। সঙ্গে প্রতিমন্ত্রী ও রাষ্ট্রীয় মন্ত্রী আছেন। ভারতীয় রেল পরিচালনা করে রেল বোর্ড। এই বোর্ডের শীর্ষে আছেন চেয়ারম্যান। তাঁকে সাহায্য করার জন্য আছেন ছয় জন সদস্য। ১. ফিনান্সিয়াল কমিশনার, ২. মেম্বার স্টাফ, ৩. মেম্বার ইঞ্জিনিয়ার, ৪. মেম্বার ইলেকট্রিকেল, ৫. মেম্বার মেকানিকেল, ৬. মেম্বার ট্রাফিক। এছাড়া ১৭টি জোনাল রেলের জন্য একজন করে জেনারেল ম্যানেজার, ছয়টি প্রোডাকশন ইউনিটের জন্য একজন করে জেনারেল ম্যানেজার, প্রত্যেকটা ডিভিশন অর্থাৎ ৬০টি ডিভিশনের জন্য একজন করে ডিভিশনার ম্যানেজার, ৪২টি ওয়ার্কশপের জন্য একজন করে চিফ ওয়ার্ক ম্যানেজার আছেন। ভারতীয় রেলের ১১টি মূল বিভাগ আছে— ১. মেকানিকেল, ২. ইলেকট্রিকেল, ৩. সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, ৪. সিগনাল ও টেলিকম ইঞ্জিনিয়ারিং, ৫. অপারেটিং, ৬. কমার্শিয়াল, ৭. স্টোর, ৮. অ্যাকাউন্টস, ৯. পার্সোনেল, ১০. মেডিকেল এবং ১১. সিকিউরিটি।

৩১ মার্চ, ২০১৫-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতীয় রেলের মোট রুটে ব্রড গেজ ৫৮,১৭৭ কিমি, মিটার গেজ ৫,৩৩৪ কিমি, ন্যারো গেজ ২,২৯৭ কিমি রেলপথ রয়েছে। তাহলে দেশে সর্ব মোট ৬৫,৮০৮ কিমি রেলপথ আছে। আর একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতীয় রেলে মোট স্টেশন ৭,১১২টি, মোট ওয়াগন ২,৪৫,২৬৭টি, মোট যাত্রীবাহী ট্রেন ৫৯,৬০০টি রয়েছে। ওই বছর মোট যাত্রী সংখ্যা ছিল ৮,৩৯৭ মিলিয়ন, মোট মাল বহন করেছে ১,০৫,৮৮১ মিলিয়ন টন। ভারতীয় রেলে মোট কর্মচারী গ্রুপ-এ তে ৯০৮৯ জন, গ্রুপ-বি তে ৭,৯৭৩ জন, এবং গ্রুপ-সি, ওয়ার্কশপ, আর্টিজেন স্টাফ ৩,৪১,৮৯৪ জন, রানিং স্টাফ ১,০৭,৭৮৫ জন, অন্যান্য ৭,৩৮,২৩৩ জন, গ্রুপ-ডি এবং আর্টিজেন ৩১,৪৯৬ জন এবং অন্যান্য ৯৭,৪৯৬ জন, মোট ১৩,৩৩,৯৫৬ জন।
বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির অগ্রগতি ঘটছে। অতীতে কম দূরত্বে রেল চলাচল হতো, এখন বহু দূর থেকে দুরান্তে মানুষ ও পণ্য সামগ্রী অনায়াসেই রেল পরিবহনের মাধ্যমে পৌঁছে যায়। এটাই বিজ্ঞানের অগ্রগতি। শুরুর দিকে কয়লা কে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে ইঞ্জিন চালানো হতো, এখন ইলেকট্রিক ট্রেন বা ডিজেল এর মাধ্যমেই রেল যাতায়াত করে থাকে। ভবিষ্যতে আরও অনেক আধুনিক ডিজাইন নিয়ে আসা হচ্ছে বিজ্ঞানের অগ্রগতির হাত ধরে। মানুষ একে সাদরে গ্রহণ করেছে। মানুষের রুচি পরিবর্তন ঘটছে, ফলে সমাজের অগ্রগতি ঘটছে। তবে জাতীয় সম্পত্তি হিসেবে রেল ব্যবস্থা কে আমাদের দায়িত্বের সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে, পরিবেশ কে পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
 

অপারেটিং বিভাগ

ভারতীয় রেলের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হল অপারেটিং। এই বিভাগ মূলত ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থা করে। চালকরা রেলগাড়ি চালান, আর পিছন থেকে নজরদারী করেন গার্ডরা। স্টেশনমাস্টার গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থাটা নিয়ন্ত্রণ করেন। আরও অনেকে এর সঙ্গে যুক্ত আছেন।
 

সিগনাল টেলিকম ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ

এই বিভাগ অতীব গুরুত্বপূ্র্ণ। রেলের সম্পূর্ণ নেটওয়ার্ক যোগাযোগ ব্যবস্থার দায়িত্ব এই বিভাগের ওপর। সিগনাল টেলিকম ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কাজ যত উন্নত হবে, ততই ট্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। অপটিক্যাল ফাইবার নামক অতি উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে এই বিভাগের সিংহভাগ কাজটাই সম্পন্ন করা হচ্ছে। বেশিরভাগটাই আউটসোর্স হয়ে গিয়েছে। অনেক কাজ রেলটেল নামক কর্পোরেশনের মাধ্যমে উন্নত করা হচ্ছে।
 

ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ

আধুনিক সভ্য এবং উন্নত সমাজব্যবস্থায় বিদ্যুৎ হল অপরিহার্য এবং গুরুত্বপূর্ণ। স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয় রেলেওয়েতেও বিদ্যুৎ ইঞ্জিনিয়ারং দপ্তর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বিভাগের ৪টি ভাগ—১. জেনারেল, ২. টিআরএস এবং ৩. ডিআরডিও লোকো।

 

মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ

ভারতীয় রেলের সমগ্র মেল এক্সপ্রেস নন-সুবারবন ট্রেন ও মালগাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব এই বিভাগের। কোচ বা বগি এবং একটি সম্পূর্ণ ট্রেনের রক্ষণাবেক্ষণ না হলে ট্রেন চালানো বিপদজনক। ট্রেনের গতিবৃদ্ধি করা এবং নিরাপত্তাকে আরও সু্নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বগির গঠনশৈলিতে নিত্যনতুন পরিবর্তন করা হচ্ছে। অবশ্যই উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগ করে। এটা যেন একটা ইতিবাচক দিক কিন্তু নেতিবাচক দিক হল এর ফলে এই বিভাগে কর্মীসংখ্যা কমছে।
 

কমার্শিয়াল বিভাগ

রেলের যাবতীয় আয় এই বিভাগের মাধ্যমে হয়। রেলের আয়ের বড় সূত্র হল, মাল পরিবহণ আর যাত্রী পরিবহণ করে। রেলবোর্ডের হিসেব অনুসারে ২০১৪-১৫ অর্থবর্ষে রেলের মোট আয়ের ২৬.১৪ শতাংশ পাওয়া গিয়েছে যাত্রীবহন করে। আর ৬৫.৬১ শতাংশ এসেছে মাল পরিবহণের মাধ্যমে। এ সংক্রান্ত বহুবিধ কর্মপদ্ধতি অতীতে ম্যানুয়ালি সম্পন্ন করা হতো। ফলে অসংখ্য কর্মচারীর প্রয়োজন হতো। কিন্তু এই কাজগুলি বর্তমানে উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগ করে অর্থাত কম্পিউটারের মাধ্যমে সম্পন্ন করার ফলে কমসংখ্যক কর্মী দিয়ে দ্রুততার সঙ্গে অনেক বেশি রিটার্ন পাওয়া যাচ্ছে।
 

অ্যাকাউন্টস বিভাগ

অ্যাকাউন্টস বিভাগের দুটি শাখা। ১. ট্রাফিক অ্যাকাউন্টস আয়ের হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ করে এবং ২. জেনারেল অ্যাকাউন্টস ব্যয়ের হিসাবরক্ষক। প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এই ২টি বিভাগে ব্যাপক কর্মীসংখ্যা কমছে। ভারতীয় রেলের আরও যে সমস্ত বিভাগ আছে প্রত্যেকটি বিভাগ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তির কারণে কর্মীসংখ্যা কমলেও কারোর চাকরি যায়নি। অবসরগ্রহণের পর ওই পদগুলির অবলুপ্তি ঘটেছে।

ফিল্ম রিভিউ: পিএস-১, মণি রত্নমই পারেন এমন গ্রাফিক্সবিহীন রূপকথার জন্ম দিতে

যোগা-প্রাণায়াম: ব্লাড প্রেশারের সমস্যায় ভুগছেন? যোগাসনেই নিয়ন্ত্রণে থাকুক প্রেশার

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫: সে এক হতভাগ্যের ‘নষ্ট নীড়’ [২৪/০৮/১৯৫১]

দশভুজা: দেবীপক্ষের প্রাককালে তিনিই তো দুর্গা…

 

যাত্রীসাধারণের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য

‘প্যাসেঞ্জার এমিনিটিস’ নামে ভারতীয় রেলে একটা বিষয় আছে। যাত্রী সাধারণ সত্যিই সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন কিনা সেটা দেখার জন্য। কম-বেশি যাত্রী সাধারণ বলবেন,…না। কিন্তু প্রকৃত অভিজ্ঞতা কী…
১. দূরপাল্লার বেশির ভাগ ট্রেন এমনকি ভিআইপি ট্রেন রাজধানী-দুরন্ত-শতাব্দী এক্সপ্রেস পর্যন্ত বেশির ভাগ সময়ে বিলম্বে চলে। লোকাল ট্রেনেরও এই অবস্থা।
২. অনেক ট্রেনে প্যান্ট্রিকার না থাকার জন্য দূরপাল্লার ট্রেনের যাত্রীদের খাবার পেতে বা খেতে অসুবিধা হয়। রাস্তায় ঠিকাদারের কর্মীরা যে খাবার বিক্রি করে তার মূল্য অত্যধিক এবং তা অত্যন্ত নিম্নমানের।
৩. সংরক্ষিত বগিতে বাইরের লোক বসে পড়ে। প্যাসেঞ্জারদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য দেখভালের জন্য কমিটি আছে। এই কমিটিকে অত্যন্ত সক্রিয় হতে হবে।

ভারতীয় রেল সারা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বড় সরকারি সংস্থা, যার কর্মীসংখ্যা একটা সময়ে ছিল প্রায় ২০ লক্ষ। ভারতীয় রেল ভারতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড। একটা সময়ে আয়ের বেশির ভাগটাই আসত রেলের নিজস্ব ভাণ্ডার থেকে। কিন্তু এখন আর সেই অবস্থা নেই। ভারত সরকারকে রেলের জন্য এখন আলাদাভাবে অর্থ বরাদ্দ করতে হয়। কিন্তু যেটা সবথেকে আগে বলা প্রয়োজন তা হল ভারতীয় রেলের চাকরিতে ক্রীড়াবিদদের প্রাধান্য দেওয়া হয়। ভারতে যে সমস্ত ক্রীড়াবিদরা অলিম্পক, বিশ্বকাপ বা এশিয়ান গেমসের মতো প্রতিযোগিতা অংশগ্রহণ করেন, তাদের অধিকাংশই কিন্তু রেল কর্মচারী। ফুটবলার পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়, অরুণ ঘোষ, অ্যাথলেটিক্সের পিটি উষা বা ব্যাডমিন্টনের পিভি সিন্ধু, বক্সার মেরি কম প্রমুখ সকলেই কিন্তু রেল কর্মচারী।

পরিশেষে যে কথাটা বলা প্রয়োজন, তা হল রেলশ্রমিক এবং কর্মচারিরাই কিন্তু ভারতীয় রেলের মেরুদণ্ড। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমেই রেল এগিয়ে চলেছে। তাই রেল প্রশাসন ও রেল কর্মচারিদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা প্রয়োজন। শ্রমিক কর্মচারিদেরও রেল প্রশাসনের সঙ্গে যথাযথ সহযোগিতা করা প্রয়োজন ভারতীয় রেলের সার্বিক উন্নতির জন্য। পাশাপাশি যাত্রিসাধারণের সঙ্গে রেল প্রশাসন ও কর্মচারিদের মানবিক সুসম্পর্ক রাখা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তাই একে অপরের সমালোচনার জায়গায় দুই পক্ষই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে লাভবান হবে দু’ পক্ষই।


Skip to content