শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছাত্রদরদী অধ্যাপক অমরকুমার চট্টোপাধ্যায়।

অমরকুমার চট্টোপাধ্যায়, যাঁর নামের মধ্যেই ছিল এক দৃঢ় ব্যক্তিত্ব। সংস্কৃত জগতের অন্যতম স্বনামধন্য একজন মানুষ যাঁর অবদান আসমুদ্রহিমাচল বিস্তৃত। পৃথিবীর তথা ভারতের এমন কোন অঞ্চল নেই যেখানে তার কোন ছাত্রছাত্রী নেই। শিক্ষক দিবসে কিংবা বিজয়ার দিন তিনি সারাক্ষণ তাঁর ফোনের পাশে বসে থাকতেন ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করার জন্য।

উপনিষদে বর্ণিত হয়েছে, ‘আচার্যদেবো ভব’। সত্যিই যদি কোনও আচার্যকে ঈশ্বরের স্থানে বসিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে হয়, তাহলে তিনিই হলেন সেই আচার্য। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বললে—
‘জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ
ধন্য হলো ধন্য হলো মানব-জীবন।’
কোনও বিশেষ দিনে অনেক সময় এরকমও হয়েছে হয়তো চার-পাঁচবার চেষ্টা করার পর তাঁকে ফোনে ধরতে পেরেছি। কিন্তু এই যে এত বার চেষ্টা করেছি তার জন্য তিনি বরাবরই নিজে থেকে কুণ্ঠাবোধ করেছেন। শুধু সংস্কৃত জগতের ছাত্রছাত্রীরা নন, অন্যান্য বিষয়ের ছাত্রছাত্রীরাও তাঁর কাছে আসতেন তাঁদের জিজ্ঞাসু বিষয় নিয়ে। সবসময়ই তাঁর দ্বার অবারিত থাকত ছাত্রছাত্রীদের জন্য। হয়তো তিনি খুবই অসুস্থ, কিন্তু কখনও সেটা ছাত্রছাত্রীদের সামনে মুখে প্রকাশ করতেন না। সকল মানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল নিয়মিত।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৯: প্লেগে কন্যার মৃত্যু, সেই শোক অবনীন্দ্রনাথের ছবিতে পায় ভিন্নতর মাত্রা

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৬০: দুই ভাইয়ের সাক্ষাৎ হল, হনুমানের রূপে মুগ্ধ হলেন ভীমসেন

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-১: রাজার ছেলেদের রাজনীতি-কূটনীতি শেখানোর জন্যই লেখা হয়েছিল এই গ্রন্থ

স্যার নিরলসভাবে তাঁর পরিচিতদের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বেদ, উপনিষদ থেকে ধ্রুপদী সাহিত্য, দর্শন প্রভৃতি বিষয়ে ছিল তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য। ছাত্রছাত্রীদের দেখলেই তাঁর চোখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি ফুটে উঠতো। কোনও ছাত্রছাত্রীকেই তিনি কোনদিনও অবহেলা করেননি। বরং অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে তাঁদেরকে শিখিয়েছেন।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪৩: সীতার মনে কি আশঙ্কার অশনি সংকেত?

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫১: সর্বত্র নিরবিচ্ছিন্ন প্রচার প্রয়োজন, তবেই বাড়বে মাছ নিয়ে সচেতনতা, উপকৃত হবে আমজনতা

বিমল মিত্র: এক অসামান্য প্রতিভার অবমূল্যায়ন

শ্রীমদ্ভগবতগীতায় বলা আছে— ‘সুখং বা যদি বা দুঃখং স যোগী পরমো মত’। অর্থাৎ সুখ এবং দুঃখকে যিনি সমানভাবে দেখেন সেই যোগী হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। শ্রীকৃষ্ণের এই বাণী যেন যথার্থ সার্থক স্যারের ক্ষেত্রে। কারণ কখনও সুখেও তিনি বিচলিত হননি, আবার দুঃখও তাঁকে টলাতে পারেনি। এক কথায় বলা যায়—মানব সমাজের যোগীস্বরূপ ছিলেন তিনি।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ তিনি প্রয়াত হয়েছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল প্রায় ৮০ বছর। তাঁর মৃত্যুতে সমগ্র সংস্কৃত জগত স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। তাঁর এই অমৃতলোকে চলে যাওয়া সংস্কৃত জগতের এক অপূরণীয় ক্ষতি। কারণ, তাঁর মতো ব্যক্তিত্ব খুবই কমই ছিল। তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল জগৎজোড়া। সপ্তাহে প্রতিটি দিন সকালে কিংবা বিকেলে তিনি ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে নানা বিষয়ের আলোচনায় মশগুল থাকতেন।
আরও পড়ুন:

৭৮ বছর বয়সে নিভৃতে চলে গিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের ভীষ্ম পিতামহ/৩

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৫: সারদা দাদার থেকে চিল্পিঘাটি

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৬: গরমে কক্ষনও ডিম খেতে নেই?

‘ঈশান স্কলার’ প্রাপ্ত অধ্যাপক অমরকুমার চট্টোপাধ্যায় সোনামুখি কলেজে পড়ানোর পরে আশুতোষ কলেজের সংস্কৃত বিভাগের প্রধান হন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সময়ে সংস্কৃত কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, বারাসত রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়, বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ বিদ্যামন্দির (বেলুড়)-সহ একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিনি নিরলস ভাবে তাঁর দায়িত্ব সামলেছেন।

তাঁর লেখা অনেক বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: বৈদিক ব্যাকরণ, বেদচর্চায় বঙ্গভূমি ও সামশ্রমী, পিঙ্গলের ছন্দঃশাস্ত্র, বৈদিক মাধ্যমিক দেবতা, আশ্বলায়ন শ্রৌতসূত্র প্রভৃতি। এছাড়া বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় স্যারের গবেষণামূলক লেখা প্রকাশিত হয়েছে।

স্যারের একজন ছাত্রী হিসেবে এটাই ঈশ্বরের কাছে কামনা করি যে, তিনি যেখানেই যান সেখানেই যেন খুব ভালো থাকতে পারেন। তাই শেষে বলি—’মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়’।
* ড. সঞ্চিতা কুণ্ডু (Sanchita Kundu), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, হুগলি মহসিন কলেজ।

Skip to content