শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

ভারতের দুই মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত। বিষয়ের নতুনত্বে এবং লেখনীর গুণে এই দুই মহান কাব্য কেবলমাত্র মহা ভারতে নয়, সমগ্র পৃথিবীতে মহাবিস্ময়ের বিষয়। ‘যা নেই মহাভারতে, তা নেই ভারতে’ অর্থাৎ যা, মহাভারতে নেই তা ভূ-ভারতে নেই। অপূর্ব লেখনী শৈলীতে ফুটে উঠেছে ভারতের ধর্ম, ভারতের বৈচিত্র ও ভারতীয়দের জীবনযাত্রা। কেবল তাই নয়—পরিবেশ রক্ষা, পরিবেশ সচেতনতা এবং পরিবেশ সংক্রান্ত নানান বিষয় সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে এই দুই মহাকাব্যে।
 

রামায়ণ

রামায়ণে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন ইকোসিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্র দেখতে পাওয়া যায়; যথা—মহাবন, তপোবন ও শ্রীবন। তপোবনে পশুরা থাকতো নিশ্চিন্তে, মানুষ এবং পশুর সহবস্থান লক্ষ্য করা যায়। এখানে পশুদের উপর না হয় কোন অত্যাচার, না হয় পশুশিকার। তপোবনের ঋষিপুত্র ও ঋষিকন্যাদের সঙ্গে ছোট ছোট পশুরা খেলা করতো, এই ভালোবাসার ফলে হিংস্র পশুরা তাদের হিংসা ভুলে, লোকালয়ের মধ্যে পরম নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াতো। এই তপোবনের ধারণা থেকেই, বর্তমান দিনে অভয়ারণ্য, জাতীয় উদ্যান ও বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের জন্ম হয় বলে মনে করা হয়।

আরও পড়ুন:

হরিয়ানার পানিপথ থেকে গুজরাতের পোরবন্দর পর্যন্ত ১৪০০ কিমি ‘গ্রিনওয়াল’ তৈরি করবে ভারত

যত মত, তত পথ, পর্ব-৪: শ্রীরামকৃষ্ণের কথা রবীন্দ্রনাথের গান

বিভিন্ন স্থানের বনভূমি এবং সেখানকার গাছপালা সম্বন্ধে একটি সুস্পষ্ট ধারণা দেওয়া হয়েছে রামায়ণে, যেমন পঞ্চবটি, দণ্ডকারণ্যের ক্রান্তীয় পর্ণমোচী অরণ্য, হিমালয়ের সন্নিহিত অঞ্চলের আলপাইনীয় অরণ্যের বাস্তুতন্ত্র ও শ্রীলংঙ্কার চিরহরিৎ বনভূমি ইত্যাদি। এই মহাকাব্যে বানর, হনুমান, জাম্বুবান ও কাঠবেড়ালি ইত্যাদি প্রায় প্রত্যেক প্রাণীকেই ভীষণ গুরুত্ব সহকারে দেখানো হয়েছে। রামসেতু বন্ধনের সময় যখন কাঠবেড়ালি হনুমান দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তখন রাম এসে তার পিঠের উপর সযত্নে হাত বুলিয়ে দেয়, অর্থাৎ জীবে প্রেম এখানে সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৫: সফল হোগি তেরি আরাধনা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৫: টনিক খাওয়া শরীরের পক্ষে ভালো?

 

মহাভারত

পরিবেশ চিন্তা ও পরিবেশ চেতনা মহাভারতের বিভিন্ন ছত্রে সুন্দরভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে। উদ্ভিদের প্রাণ, বৃক্ষরোপণের পুণ্যনতা ও উপকারিতা, জলাশয় খনন, নগরায়ন, অরণ্য উচ্ছেদ ও ভৌম জলের সন্ধান ইত্যাদি বিভিন্ন পরিবেশ সম্পর্কিত খুটিনাটি তথ্য পাওয়া যায় মহাভারতে। মহাবীর ভীষ্ম যখন শরশয্যায় ও অতি তৃষ্ণার্ত, তখন মহাধনুর্ধর অর্জুন তখন তীর গেঁথে মাটি থেকে ভৌমজল বার করেন ও সেই জল পিতামহ ভীষ্মের মুখে দেন ও তাঁর তৃষ্ণা নিবারণ করেন। ভূতত্ত্ববিদ্যা এবং পরিবেশের উপর প্রখর জ্ঞান না থাকলে, মাটির তলায় যে ভৌম জল পাওয়া যায়, তার সন্ধান তিনি পেতেন না।

ব্যাসদেব বর্ণিত এক শ্লোক হল—
‘বক্রোপোৎ পলানালেন যথোধবং জল মাদদেৎ।
তথা পবনসংযুক্ত: পৈদি পিবতি পদপ:।’


এর অর্থ— উদ্ভিদ মূলদ্বারা যে জল শোষণ করে, অগ্নি ও বায়ু সেই জল জীর্ণ করে থাকে। এই জল পরিপাক হওয়াতেই ঐ সকল স্থাবর পদার্থ লাবণ্যবিশিষ্ট ও পরিবর্তিত হয়। উপরোক্ত বক্তব্যের মধ্যে উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষের ইঙ্গিত আছে বলে মনে হয়, যা অনেক পূর্বেই আমাদের মহাপুরুষেরা বলে গিয়েছেন মহাভারতে।

আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১২: সুন্দরবনের আর এক ব্যাঘ্রদেবতা বড় খাঁ গাজী

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৭১: ছোট মাছকে অবাঞ্ছিত না ভেবে প্রতিপালন করলে বিকল্প আয়ের দিশা পাওয়া যাবে

এই মহাকাব্যে, পিতামহ ভীষ্ম, যুধিষ্ঠীরকে বৃক্ষরোপণের সুফল সম্বন্ধে বলেছেন। তিনি উদ্ভিদের ছটি ভাগে ভাগ করেছেন যথা বৃক্ষ, গুল্ম, লতা, বল্লী, বংশ ও তৃণ। পরবর্তীকালে অনেক উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা উদ্ভিদের এই রকমই শ্রেণিবিন্যাস করেছেন। পিতামহ ভীষ্ম বলেছেন বৃক্ষরোপণ করলে তার সুফল ইহলোক ও পরলোকেও পাওয়া যায়। সুতরাং, বৃক্ষরোপণ একটি পবিত্র কর্তব্য। ভাবীকালের উদ্দেশ্যে ধ্বনিত এই মহান বার্তা পরবর্তীকালে বিজ্ঞানীদের মুখেও ধ্বনিত হয়। তারাও বলেন ‘একটি গাছ, একটি প্রাণ, গাছ লাগাও, প্রাণ বাঁচাও’। তাই বলা যায়, এই দুই মহাকাব্যে পরিবেশ চিন্তা ও পরিবেশ চর্চা মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে।
* ড. উৎপল অধিকারী, সহ-শিক্ষক, আঝাপুর হাই স্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান।

Skip to content