মঙ্গলবার ৪ মার্চ, ২০২৫


গত পাঁচই জুন ছিল বিশ্বপরিবেশ দিবস। বেশ ঘটা করে উদ্‌যাপিত হয়েছে এই দিনটি। বৃক্ষরোপণ হয়েছে অনেক জায়গায়। হয়েছে অনেক আলোচনা সভা। পরিবেশ নিয়ে সাময়িক হলেও সচেতনতা চোখে পড়েছে, সেই বা কম কিসের? পরিবেশ মানে আমাদের চারপাশের জীবজগৎ, গাছপালা, জলাশয় এই সমস্ত কিছু। সেই পরিবেশকে টিকিয়ে রাখতে হলে, আমাদের সুস্থ থাকতে হলে গাছপালাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, অরণ্যসৃজন করতে হবে। গাছপালার এক অভিনব সংগ্রহশালা অর্থাৎ বোটানিক্যাল গার্ডেনে অবস্থান হাওড়ার শিবপুরে। একথা হয়তো সকলেরই জানা যে এশিয়ার বৃহত্তম বোটানিক্যাল গার্ডেন হল এটি। সদ্য পার হয়ে আসা পরিবেশ দিবসের কথা মনে করে আজ বরং সেই বোটানিক্যাল গার্ডেন নিয়ে জানা অজানা দু’ চার কথা আলোচনা করা যাক।

এই মস্ত বাগানটি তৈরি হয় ১৭৮৬ সালের ১৫ এপ্রিল। এর প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যে মানুষটির যোগ সবচাইতে বেশি তিনি কিন্তু কোনও উদ্ভিদবিদ ছিলেন না। তিনি ছিলেন বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পস-এর একজন ইঞ্জিনিয়ার। গাছপালা অসম্ভব ভালোবাসতেন তিনি। লেফটেন্যান্ট কর্ণেল রবার্ট কিডের প্রাসাদোপম বাড়ি ছিল হাওড়ার শালিমারে গঙ্গার ধারে। নিজের গাছপালার শখের জন্য কিডসাহেব বাড়িতে একটা বাগানও তৈরি করেন। সেই বাগানে একটা চেরি গাছ লাগিয়েছিলেন তিনি। আর ভারতকে ভালোবেসে, গাছকে ভালোবেসে কিড চেয়েছিলেন সেই গাছের নীচেই তাঁকে যেন সমাধিস্থ করা হয়। তাঁর মৃত্যুর পর অবশ্য তাঁর স্ত্রী তাঁর দেহ ইংল্যান্ডে নিয়ে যান। যাই হোক, সেসব অন্য কথা। তবে বোটানিক্যাল গার্ডেনের প্রতিষ্টাতাকে স্মরণ করে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি সাদা মার্বেলের সৌধ নির্মাণ করা হয়েছিল। সেটি আজ ও তাঁর কথা মনে করায়।

এবার বরং আবার বোটানিক্যাল গার্ডেনের শুরুর দিনের কথা প্রসঙ্গে আসা যাক। রবার্ট কিড গাছপালা ভালোবাসতেন। তিনি চিন্তা করলেন যে, ভারতে বনজ সম্পদের কোনও তো কোনো অভাব নেই। কিন্তু এর কোনও সংগ্রহশালা নেই। তিনি তখন তত্কালীন গভর্নর লর্ড কর্ণওয়ালিসকে একটা চিঠি লেখেন এই মর্মে, এখানে একটা বাগান তৈরি করা হোক, যেখানে বিভিন্ন অর্থকরী ফসল, কাঠের জন্য উপযোগী গাছ ইত্যাদি লাগানো হবে। আর তাতে সরকার ও লাভবান হবে। কারণ তাতে এইসমস্ত গাছপালা থেকে পাওয়া মশলা বা অন্যান্য সামগ্রী বাইরে রপ্তানী করলে সরকারের লাভই হবে। আর যেসমস্ত গাছের কাঠ উপযোগী সেসমস্ত কাঠ থেকে জাহাজের কাঠ, রেলের স্লিপার এমনকি বাড়িঘরদোরের কড়ি বরগার উপযোগী কাঠও মিলবে। এইসব বিভিন্ন অর্থকরী গাছপালা চাষের কথা চিন্তা করেই প্রথম এই বাগান তৈরির পরিকল্পনা করেন। গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্ণওয়ালিস তাঁর এই প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। এইবারে শুরু হল বাগানের জন্য জমি খোঁজা। লন্ডনে থেমস নদীর তীরে কিউতে ততদিনে রয়্যাল বোটানিক গার্ডেন তৈরি হয়ে গিয়েছে। এখানেও কিডের উদ্যোগে হুগলি নদীর পশ্চিম তটে একটা জায়গা চিহ্ণিত হল বাগান করবার জন্য। ১১০ হেক্টর অর্থাৎ ২৭৩ একর ছিল সেই জমির আয়তন। এখানে অনেক গ্রামও ছিল। জনবসতি ছিল। রাতারাতি সেসব গ্রামের অধিবাসীদের স্থানান্তরের ব্যবস্থা করা হল।
সেই সময়ে মশলপাতি, রবার এদেরও কোনও সংগ্রহশালা ছিল না। কিডের মনের ইচ্ছা ছিল, এই বাগানে এইসবও চাষ করা হোক। আর সেই তালিকায় ওষধিও ছিল। গভর্নর জানতে চেয়েছিলেন, তুমি ঠিক কি চাও। কিড বললেন, আমি রবার কফি, কোকো, মেহগনি, আলু, সিঙ্কোনা, মশলা এই সমস্ত গাছই মূলত চাষ করতে চাই। কিডের মনে অনেক পরিকল্পনা ছিল এই বাগানকে ঘিরে। কিডের ইচ্ছেমতন দক্ষিণ ভারত থেকে কিছু মশলার গাছ যেমন মরিচ, এলাচ এগুলো এনে লাগালো হল এই বাগানে। এইভাবে বাগান তৈরির প্রাথমিক ধাপ পার হওয়া গেল। এরপর কিড মারা গেলেন। কিড মারা যাবার পর সেই সংগ্রহশালার প্রথম বেতনভুক্ত সুপারিন্টেণ্ডেন্ট হলেন উইলিয়াম রক্সবার্গ। ঘটনাচক্রে যাঁরা যাঁরা এই বাগানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁরা কেউই প্রায় গাছপালার লোক ছিলেন না। রক্সবার্গ ডাক্তার ছিলেন তিনি। তিনি ইণ্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিসে ছিলেন। ইনি সার্জেন ছিলেন। কেবল পাশ্চাত্য শল্যচিকিত্সাতেই যে শুধু দক্ষ ছিলেন না তা নয়, তিনি চরক সুশ্রূত এমনকি বেদ ও পড়েন। নিজের লেখায় উল্লেখ করেন বাটিকা, তপোবন ইত্যাদির কথা। প্রাচীনকালে আশ্রমের সঙ্গে সঙ্গে একটা করে এমন বাগান থাকত যেখানে বিভিন্ন ওষধি গাছ চাষ করা হতো। কারণ চিকিত্সাশাস্ত্রে সেগুলি লাগত। রক্সবার্গ এইসমস্ত গাছ নিয়ে খুবই আগ্রহ ছিলেন। তিনি চাইতেন, এসব গাছ বিপুল পরিমাণে চাষ হোক। কিডের তৈরি বাগানে চেষ্টা হয়েছিল চা চাষ করবার। কিন্তু সেটা সফল হয়নি। কিন্তু সারা বিশ্বের বহু গুরুত্বপূর্ণ গাছের বীজ চারা এনে এখানে লাগানো হল।

কিডের হাত ধরে ১৭৮৬ সালে যে বাগানের পথ চলা শুরু হয়েছিল। আজ ২০২২ সালে সেই বাগানে ১২০০০টি এর মতো বড় গাছ আছে। জীবন্ত গাছ ছাড়াও শুষ্ক গাছ অর্থাৎ হার্বেরিয়ামের একটা মস্ত সংগ্রহশালাও আছে এই বাগানে। তাতে আড়াই তিনলাখ মতো নমুনা রয়েছে এবং এটি ভারত তো বটেই সমগ্র দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সবচাইতে বড় সংগ্রহশালা। গাছগুলোকে শুকনো করে এখানে সংরক্ষণ করা হয়েছে। গবেষকদের জন্য এই হার্বেরিয়াম বা সংগ্রহশালা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় অনেক গাছ পাওয়া যায় না, তখন ওই শুকনো অবস্থায় তাদের দেখার জন্য এই সংগ্রহশালার দ্বারস্থ হতে পারে গবেষকরা। বর্তমানে ১২০০০টি বড় গাছ ছাড়াও ২০০ প্রজাতির অর্কিড, নানারকম ছোটবড় প্রজাতির ৩০ রকম বাঁশ গাছ, ১৪০ রকমের বোগেনভেলিয়া, ক্যাকটাস বা রসালো উদ্ভিদ ১২০ প্রকার সাইকাসজাতীয় গাছ, ৩৫ রকম পাইন ইত্যাদি এছাড়াও আরও বহু প্রজাতির গাছ আছে। এই বাগানে ১১৮ রকমের পাম গাছ রয়েছে। উল্লেখযোগ্য গাছ হল বিশাল বটগাছ, যার ঝুরির সংখ্যা প্রায় ১৭০০। এই বটগাছটি ১৮৬৪ এবং ১৮৬৭ সালে দুবার সাইক্লোনের মুখে পড়েছিল। একটি সাইক্লোন আর ছত্রাকের আক্রমণে মূল গুঁড়িটি নষ্ট হলেও এতসংখ্যক ঝুরি ছিল যে গাছটা মরেনি। ডালপালা বিস্তার করে সে আজো বেঁচে রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে শাখাসমন্বিত পাম গাছ, যা আফ্রিকায় জন্মায়। রয়েছে বিশাল লিলি। যার এক একটা পাতা দৈর্ঘ্য প্রস্থে প্রায় ৫ ফুট করে। সেই পাতার ওপরে আর ৪০ কেজি ওজনের একটি বাচ্চা অনায়াসে বসাতে পারবে। এছাড়াও রয়েছে কৃষ্ণ বট, যে গাছের পাতার গোড়া অদ্ভুতভাবে উল্টে গিয়ে ছোট পকেটের মত তৈরি করে। লোককথা আছে যে কৃষ্ণ নাকি মাখন চুরি করে ওই পাতার পকেটের মধ্যে লুকিয়ে রাখতেন। তাই ওই বটের নাম কৃষ্ণ বট। এমন কিছু বিচিত্র গাছ ছাড়াও ভারতীয় উপমহাদেশের নানান দুর্লভ গাছের এক জীবন্ত সংগ্রহশালা বলা যায় এই বোটানিক্যাল গার্ডেনকে।
১৭৮৬ সালে এই বাগানটা তৈরি করার পিছনে ইংরেজ সরকারের আরও একটা উদ্দেশ্য ছিল। ভারত এর আগেই এক মস্ত দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হয়েছে। তাই ঠিক করা হয়, কেবল দুর্লভ গাছ নয়, আলু , রাঙালু, অন্যান্য সবজিও প্রয়োজনে এখানে চাষ করা হবে। যাতে তেমন দুর্দিন এলে সাধারণ মানুষের খাদ্যের জোগান দেওয়া সম্ভব হয়।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে মূলত ব্যবসার জন্যই বাগানটি তৈরি করেছিল। আর তার নাম দিয়েছিল কোম্পানি বাগান। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে নানান ধরণের বাগানের কথা পাওয়া যায়, যেমন রাজারাজড়াদের জন্য প্রমোদ উদ্যান, এছাড়াও নন্দনকানন, বাটিকা, তপোবন সবই কিন্তু ছোটখাটো বোটানিক্যাল গার্ডেন। কিড কিংবা রক্সবার্গ-এর মনে এমন বাগান তৈরির ভাবনার মূলে এদের অবদানও অস্বীকার করা যায় না।

এই বাগানকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ঘটনাও রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের বাঘের গল্পটি। বাংলার সহায়সম্বলহীন শেষ নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ তখন মেটিয়াবুরুজে এসে থাকতেন। সহায় সম্বলহীন হলে কী হবে, নবাব বলে কথা! তাঁর একটি ছোট চিড়িয়াখানা ছিল। কোনও এক সাইক্লোনের সময় তাঁর ওই চিড়িয়াখানার দরজা ভেঙে একটি বাঘ পালিয়ে গঙ্গায় সাঁতরে এসে এপারে শিবপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনে একটি গাছের তলায় আশ্রয় নেয়। সেখানকার দুই কর্মীকে আহত করে সেই বাঘ। পরে এক ইংরেজ শিকারী সেই বাঘকে গুলি করে মারে। যে গাছটির তলায় বাঘটি আশ্রয় নিয়েছিল, সেই গাছ আজও আছে। সেই গাছ আর গুলিতে দু’ ভাগ হওয়া গুঁড়িটিও দেখতে পাওয়া যাবে বোটানিক্যাল গার্ডেনে গেলে।

উদ্ভিদবিদ না হয়েও গাছপালার প্রতি অমোঘ আকর্ষণে ইংরেজ সাহেবরা তৈরি করেছেন এমন এক আশ্চর্য বাগান, যেখানে গাছপালা ছাড়াও রয়েছে ২৪ টি হ্রদ। প্রতিটা হ্রদ নল দিয়ে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। আর মূল নলটি গঙ্গার সঙ্গে যুক্ত। গঙ্গায় যখন জোয়ার আসে, এই হ্রদগুলোতেই জল বেড়ে যায়। তবে বর্তমানে এই জল বেশ দূষিত হওয়ার কারণে মাঝে মাঝে মাছ মরে যায় বেশ কিছু। সে যাই হোক, এই ২৪টা হ্রদ, এত গাছপালা সমস্ত কিছু নিয়ে একটা সুন্দর বাস্ত্তুতন্ত্র তৈরি হয়েছে ঠিক রয়্যাল বোটানিক গার্ডেন, কিউ এর আদলে। ওখানেও যেমন বড় পাম হাউস আছে, ক্যাকটাস হাউস আছে, আছে হার্বেরিয়াম রয়েছে, এখানেও ঠিক তেমনি রয়েছে। আর রয়েছে বিশাল আশ্চর্য বট, যে কত ঝড় সময়ে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে স্থির হয়ে। এমন সহনশীলতা শেখার জন্য ও গাছের কাছে যাওয়া উচিত। আজ যখন ক্রমবর্ধমান উষ্ণায়নে জীবন ওষ্ঠাগতপ্রায়, তখন পড়শি এই আশ্চর্য বাগানে গাছপালা, পাখি, প্রজাপতিদের সাথে নীরবে দু’দণ্ড সময় কাটালে জীবনের অর্থ ও হয়তো বদলে যাবে!

ছবি: লেখিকা

Skip to content