শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


উৎসব দিনে। ছবি: লেখক।

বসন্তের আগমনে মনটা কেমন যেন উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। মনে হয় ওই তো উৎসব এল বুঝি। শারুল-শিমুল ফুলের রক্তিম সৌন্দর্যের হাতছানি মনকে বড়ই ব্যাকুল করে তোলে, সন্ধিক্ষণে চৈত্র-বৈশাখ।

বৈশাখের নব দিগন্তের নবীন পবন। শিমুলের ফল ও তার ছড়িয়ে পড়া শিমুল তুলার পাপড়ি আশপাশের জঙ্গলমহলের আদিবাসীদের জীবনে ঝড় তোলার এক নবীন চাবিকাঠি। এরই মধ্যে গাছে শিমুলের ফল চৌচির হয়ে বেরিয়ে আসছে তুলা। বয়ে চলে নব যৌবনের আনন্দধারা।

কবির ভাষায়, “বসন্তের বাতাস যখন কাহাকে কোন খবর না দিয়ে হু হু করিয়া আসিয়া পড়িত”। তখন বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্ৰাম তথা জঙ্গলমহলের আদিবাসী অঞ্চলে ‘বাহা’ বা ‘শারুল’ পরবের জন্য আয়োজনের তৎপরতার তাৎক্ষণিকতাও ততোধিক উল্লেখ্য। অ-আদিবাসীদের দোল উৎসবে আবিরের ব্যকবহার আছে, কিন্তু আদিবাসী সমাজের বাহা উৎসবে আবিরের কোন ভূমিকা নেই। তাই তো শারুল-শিমুল একে অন্যের পরিপূরক। প্রকৃতির মেলবন্ধনের উৎসই হল বাহা পরব এবং শিমুলের ফুল ফাটানোর মাধ্যম তার ফল চৌচির হবার মাহেন্দ্রক্ষণ।
এই অঞ্চলের আদিবাসীদের সব উৎসবই প্রকৃতিকে ঘিরে। বসন্তেই ফোটে পলাশ, শিমুল, মহুয়া। বাহা শব্দটা সাঁওতালি ভাষায় ফুল। বাহা পরব আর কিছুই নয়, সে হল ঋতুরাজ বসন্ত বরণের বর্ণময় উৎসব। সেখানেই আসে শিমুলের উষ্ণ পরশ। কতই রঙিন! কতই নবীন! হোক না তব প্রাণ আনন্দ বিহ্বল- তব আকুল কিরণ! মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সংযোগের এ-এক অনাবিল, অনবদ্য সংযোগ।
আরও পড়ুন:

বিমল মিত্র: এক অসামান্য প্রতিভার অবমূল্যায়ন

৭৮ বছর বয়সে নিভৃতে চলে গিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের ভীষ্ম পিতামহ/৩

আমি বনফুল গো: তিনিই ছিলেন ভারতীয় ছবির প্রথম সিঙ্গিং সুপারস্টার/১

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১১: নাথানিয়্যাল গোবিন্দ সোরেনের গল্প

সাঁওতালিদের ফাল্গুন হল প্রথম মাস। এই সময় ‘নব আনন্দে’ প্রকৃতি জাগে। আম, শাল, পলাশ, মহুল ইত্যাজদি গাছে নতুন পাতায়, মুকুল ধরে। প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা এখানকার জঙ্গলমহলের আদিবাসী লোকায়ত মানুষ বিশ্বাস করে, এ হচ্ছে গাছেদের প্রজননের সময়। এই সময় কোনও মানুষজন যদি ফুল, পাতা, শাখা ছেঁড়ে তাহলে তা গ্ৰামের পক্ষে অমঙ্গল। যদি ভুল করে কেউ গাছের ডালপালা জঙ্গল থেকে জোগাড় করে, তবে সেটা গ্ৰামের বাইরে কোনও ঝোপঝাড়ের আড়ালে রেখে দেন। কারণ, এর শাস্তি স্বরূপ পুরোহিত পুজো করে সেই ঘরে আর আশীর্বাদী শাল ফুল দেন না। তেমনই শিমুলেরও ঘুম ভাঙার পালা। ছড়িয়ে পড়ে অজানার আহ্বান। তাই ফাল্গুন মাস এলেই এই অঞ্চলের আকাশে বাতাসে ভেসে আসে মাদকতাময় বাহাগান—’আজ ফাল্গুনে আগুন লাগে’।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬০: রাতদুপুরে বিপন্নকে বাঁচাতে হাটখোলার পাট আড়তের টাকা এসেছিল জোড়াসাঁকোয়

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৭: অর্থনীতির প্রান্তিকতায় নারী এবং তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-২: এখানে দেশের অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা, বাণিজ্যনীতি এবং বৈদেশিক নীতির চর্চা করা হয়েছে

এই বাহা পরবকে কেন্দ্র করে সমস্ত আদিবাসী তরুণ-তরুণী উজ্জীবিত হয়। বাহা উৎসবে যৌবনের বা তারুণ্যে র উচ্ছলতা লক্ষ্য করা যায়। উৎসবের মধ্যের দিয়ে আদিবাসী তরুণ-তরুণী তাদের মনের মানুষ (সঙ্গী) খুঁজে নেওয়ার একটা সুযোগ পেয়ে যান। আসলে বাহা উৎসব জীবন-যৌবনের উজ্জীবন আর উদযাপনের সম্মিলন। সঙ্গে থাকে শিমুলের মন পবনের ডানা মেলার উদ্বোধন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩২: কি ‘উপহার’ সাজিয়ে দেব

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৮: সলিল চৌধুরীর সুরারোপিত গান খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতেন পঞ্চম

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৭: গরমে পান্তা ভাত কি সত্যিই শরীর ঠান্ডা করে?

উৎসবের আগে আদিবাসী মানুষ গাছের ফুল, পাতা কোনও কিছুই ব্যববহার করে না। জঙ্গলমহলের আদিবাসী মেয়েরা ফুল ভালোবাসে। পরবের দিন থেকেই তারা খোঁপায় শাল, মহুল ফুল দেয়। এই ভূখণ্ডের আদিবাসী সমাজ প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচতে চায়। এইসব পরব, লোকাচার আর লোকবিশ্বাসের মধ্যে দিয়ে নিজেদের সুরক্ষার ব্যকবস্থা নিজেরাই করে নেয়।

দ‍‌ক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গের বসবাসকারী আদিবাসী মানুষের কাছে বাহা পরব হল বর্ষবরণের এক মহৎ উৎসব। তিনদিনের উৎসবের মনোমুগ্ধকর পরিবেশ ও পারিবারিক মিলন এক চঞ্চলতার আবেশ ঘটায়। তাই পার্থিব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ সংগঠন ও তার পারিপার্শ্বিক স্থান অধিকার করে থাকে শারুল-শিমুলের বাৎসরিক পরস্পরা আদি অনন্তকালের উষ্ণ পরশের আলিঙ্গনে— বৈশাখের আহ্বানে।

* প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
* সুপর্ণা সান্যাল মুখোপাধ্যায়, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, ‘এডুকেশন’ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, সিকম সিক্লস বিশ্ববিদ্যালয়।

* সৈকতকুমার বাসু, নির্বাহী গবেষণা পরিচালক, পিএফএস, লেথব্রিজ, আলবার্টা, কানাডা।

Skip to content