বৃহস্পতিবার ২৮ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: সংগৃহীত।

পাণ্ডবভাইয়েরা একের পর এক তীর্থ দর্শন করতে করতে এগিয়ে চলেছেন। সকলেই অধীর হয়ে উঠেছেন, অর্জুনের সঙ্গে দেখা করবার জন্য। কিন্তু অর্জুন যে দেবস্থানে গিয়েছেন। সে স্থান সাধারণের গম্য নয়। অতি কঠোর সে যাত্রাপথ। হিমালয়ের দুর্গম স্থানে সে যাত্রায় কি আদৌ সমর্থ হবেন দ্রৌপদী। কিংবা নকুল অথবা সহদেব? আসলে অর্জুনকে দেখার অদম্য ইচ্ছা সকলের বেড়েই চলেছে। সকলেই প্রতিমুহূর্তে তাঁর অভাব অনুভব করছেন। এমতাবস্থায় ভীমসেন এগিয়ে এলেন, সাহস দিলেন সকলকে। বললেন, এ পথে ক্লান্ত হয়ে পড়লে তিনিই ভার নেবেন তাঁর সহযাত্রীদের। দুর্গম সে পথে চলার ভিন্ন নিয়ম। আহার নিদ্রাদি সংযত করে সংযত চিত্তে এ পথে চলতে হয়। কৈলাসপর্বতের উত্তরে গন্ধমাদন পর্বত। সাধারণের অগম্য। সে পথেই চললেন পাণ্ডবেরা। দীর্ঘতীর্থযাত্রায় আজ তাঁদের অন্তরের গ্নানিগুলো যেন ধুয়ে মুছে গিয়েছে। পথের শ্রম শরীরকে করেছে কঠোর, শ্রমসহিষ্ণু। পথে আহার্যের অপ্রতুলতা তাঁদের স্বভাবসিদ্ধ বিলাসবৈভব থেকে দূরে থেকে মানিয়ে নেওয়ার মন তৈরি করেছে। অর্জুনকে আজ তাঁরা কাছে পেতে চান।
তাই দুর্লঙ্ঘ্য পার্বত্যপথের কঠোরতাও যেন মাথা নত করেছে তাঁদের ইচ্ছার কাছে। লোমশমুনি এ মহাতীর্থপথেও তাঁদের পথপ্রদর্শক। দুর্গম, সাধারণের অগম্য পথে তাঁদের সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন ভীমপুত্র ঘটোত্কচ। হিড়িম্বাপুত্র রাক্ষস ঘটোত্কচ অসীম বলশালী। পিতার কথায় তিনি সানন্দে দ্রৌপদীসহ পাণ্ডবদের ভারবহনে রাজী হলেন। ঘটোৎকচের কথায় আকাশচারী অপরাপর রাক্ষসেরা এগিয়ে এলেন। পর্বতের দুর্গম প্রদেশে রাক্ষসদের সাহায্যে অনায়াসে পথ চলতে চলতে অবশেষে পাণ্ডবেরা বদরিকাশ্রমে এসে পৌঁছলেন। অতিমনোহর সে আশ্রমে ফলমূলভোজী, জিতেন্দ্রিয়, বেদবিৎ মহর্ষিগণের বাস। যুধিষ্ঠির ভাইদের সঙ্গে নিয়ে সংযতচিত্তে মহর্ষিগণের কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন। যুধিষ্ঠিরকে ভাইদের সঙ্গে দেখে মহর্ষিরা অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে সাদরে আমন্ত্রণ জানালেন আর জল, ফুল, ফলমূল দিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন।
আরও পড়ুন:

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৫৮: দেবতাদের আশীর্বাদে আর অর্ব্বাবসুর প্রার্থনায় যবক্রীত বেদজ্ঞান লাভ করলেন

শাশ্বতী রামায়ণী, শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪১: চরৈবেতি—গভীর বনপথে জীবন বহমান

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪: অপবাদ এবং রামচন্দ্রের সুশাসনের রামরাজত্ব

হিমালয়ের সুউচ্চ স্থানে ভাগীরথীনদীর তীরবর্তীস্থানে অবস্থিত বিশাল বদরীবৃক্ষের নিকটে নর আর নারায়ণ ঋষির তপস্থলী বদরিকাশ্রমে পাণ্ডবেরা বাস করতে লাগলেন। সেখানে তাঁদের দিনগুলো অতি আনন্দে কাটতে লাগল। একদিন তাঁরা একান্তে বসে অর্জুনের কথা আলোচনা করছিলেন। অর্জুনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হলে আরও দুর্গমতর প্রদেশে যেতে হবে। কীভাবে সে যাত্রা সম্ভব হতে পারে, সে কথাই বলছিলেন তাঁরা। হঠাৎ বায়ুবাহিত এক অপূর্ব গন্ধযুক্ত পদ্মফুল তাঁদের সামনে মাটুতে এসে পড়ল। দ্রৌপদী ফুলটি দেখে খুব খুশি হয়ে মধ্যম পাণ্ডবকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন, ‘হে পরন্তপ! এই ফুলখানি যেমন গন্ধে মধুর, তেমনি চিত্তাপহারকও বটে। আমি এই রকম একখানি ফুল ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে উপহারস্বরূপ দিতে চাই।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৩: বাইগা বস্তি হয়ে ভোরামদেব মন্দির

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৩: যৌন নিগ্রহের রোজনামচা এবং আমাদের প্রতিক্রিয়া

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮: ‘বাইরে বেরুলেই বিপদ!’

আপনি যদি এইজাতীয় অনেক কটি ফুল আমার জন্য নিয়ে আসেন, তবে আমি অত্যন্ত তৃপ্ত হই।’ ভীমসেন তাঁর প্রিয়তমা মহিষীর জন্য অপূর্বগন্ধযুক্ত সেই ফুলের খোঁজে রওনা দিলেন। মহাবলশালী ভীমসেন ধনুর্বাণ হাতে নিয়ে মত্ত হাতির মতো পরমরমণীয় গন্ধমাদন পর্বতের উপত্যকাভূমিতে বিচরণ করতে লাগলেন। সে পথ যক্ষকিন্নরগণের চারণভূমি। তবে তাঁরা সাধারণ মানুষের দৃষ্টিপথে আসেন না। তাই সাধারণের অগম্য সে পথ। এদিকে ভীমসেন সে পথে চলেছেন অপনমনে। মনের মধ্যে দুটো চিন্তা তাঁকে যুগপৎ বিচলিত করছে। কখনও তিনি ভাবছেন, অর্জুন উপস্থিত নেই। তিনি নিজেও অনুপস্থিত। এমতাবস্থায় যুধিষ্ঠির দ্রৌপদী নকুল ও সহদেবকে নিয়ে দিনযাপনে কোনও অসুবিধার সম্মুখীন হবে না তো? পরক্ষণেই এই চিন্তা তাঁর মনকে ঘিরে ফেলে যে, প্রিয়তমা পত্নী দ্রৌপদী বলেছেন, ফুল আনতে। সে কথা মনে হতেই তিনি ভীমবেগে ছুটে চলে। তাঁর গতিতে হরিণেরা ছুটে পালাতে লাগল, পশুরা ভয়ে সেই বন ত্যাগ করতে লাগল, বাঘেরা গাছের আড়ালে লুকোতে লাগল, অনেক পশু মৃত হল, যারা বেঁচে রইল তারা প্রাণভয়ে আর্তনাদ করতে লাগল।
আরও পড়ুন:

দশভুজা: ‘ওগো তুমি যে আমার…’— আজও তাঁর জায়গা কেউ নিতে পারেনি/২

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৫: আরডি-র ‘লাকড়ি কি কাঠি কাঠি পে ঘোড়া’ আজও ছোটদের মধ্যে সমানভাবে জনপ্রিয়

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৩: সারাদিন যত পারেন জল খান! এতে শরীরের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে না তো? কী করে বুঝবেন?

এদিকে ভীমসেন গর্বিত নৃসিংহের মতো গর্জন করতে করতে বায়ুবেগে ছুটতে লাগলেন। এদিকে সে পথেই বীরশ্রেষ্ঠ হনুমান বাস করতেন। বায়ুর ঔরসে ভীমের জন্ম। অন্যদিকে হনুমানও পবনপুত্র। তিনি বিবেচনা করলেন, এ পথ দেবতাদের পথ, তাঁদের বাসভূমি। তাই যদি ভ্রাতা ভীমের পথরোধ না করি, তবে তাঁরই বিপদ। এসব ভেবে তিনি কলাবনের মধ্যবর্ত্তী অতিসঙ্কুচিত পথে সে পথ রোধ করে নিজের লেজখানি ছড়িয়ে নিদ্রার ভান করে পড়ে রইলেন।
* মহাভারতের আখ্যানমালা (Mahabharater Akhayanmala – Mahabharata) : ড. অদিতি ভট্টাচার্য (Aditi Bhattacharya) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content