শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী। সংগৃহীত।

একটি কাল্পনিক কিন্তু বাস্তবের মধ্যে মিশে থাকা কথোপকথন দিয়ে শুরু করছি আজকের প্রতিবেদন। ধরে নিন দক্ষিণপাড়ার ঋতু কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে নিজের আবেগকে বশে না রাখতে পেরে পশ্চিমপাড়ার সঞ্জয়কে বিয়ে করেছে মন্দিরে। এই নিয়ে দুটি বাড়িতে তুমুল অশান্তি। দুই পক্ষ একে অন্যকে দেখে নেওয়ার হুমকি পর্যন্ত দিয়ে যেতে লাগল। বিষয়টি থানা পুলিশ গড়াল। পুলিশ দেখল একমাস পরেই আঠারোতে পেড়বে মেয়েটিকে নিয়ে টানা হ্যাচড়া না করে উভয়পক্ষকে মেনে নিতে বলল। এ সব নিয়ে চর্চার মাঝে পরীক্ষার ফলও বেরল। তখন ঋতু বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে বুঝল তার কিছু টাকা পাওয়া বাকি আছে কান্যশ্রী প্রকল্প থেকে। এদিকে সে আর পড়াশুনো করতে ইচ্ছুক নয়। কারণ, সে যদি কলেজে যায় সেখানে যদি ছেলে বন্ধু হয়, তাহলে স্বামী রাগ করবে। দুই বাড়িতে বিষয়টি নিয়ে দফায় দফায় আলোচনা চলল।

ঋতু: আমার এখনও কান্যাশ্রীর টাকা পাওয়া বাকি আছে। কিন্তু ওরা যখন জানতে পারবে আমি বিবাহিত, তখন আর আমাকে ওই টাকা দেবে না।

সঞ্জয়: দেবে না কেন? আলবাত দিতে হবে। দেখছি কী উপায়ে পাওয়া যায়। কিন্তু ঋতু এটা বল ওই টাকাটা পেলে আমাকে দিবি তো? এই যে তোর বাবার পুলিশের ভয়কে উপেক্ষা করে আমি তোকে বিয়ে করে নিয়ে এলাম।

সঞ্জয়: মা, ঋতুর টাকাটা পাওয়া খুব জরুরি। এই টাকাটা পেলে আমি একটা ব্যবসাতে লাগাতে পারব। দেখি কিছু করা যায় কিনা।

মা: হ্যাঁ, তা ঠিক। পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিস বলে তো কিছুই পেলি না। আর বাড়ির বউয়ের এখন বাড়ির কাজ শেখা উচিত। লেখা পড়া ঢের করেছে।

মা: ঋতু তুমি সিঁদুর না পরে কলেজে যাবে। তারপর যেদিন দেখবে ব্যাংকের বইতে টাকা ঢুকেছে সেদিন থেকে তুমি বাড়িতেই থাকবে। আর কলেজ যাওয়ার দরকার নেই।
ঋতু শাশুড়ি মায়ের কথা মতো কলেজে যাওয়া শুরু করল। টাকা ঢোকার আগের দিন অবধি কলেজের শিক্ষকরা দেখলেন, মেয়েটি পড়াশোনা বেশ ভালো বোঝে। আর একটুখানি ঘষামাজা করলে ভালো ফলও করবে পরীক্ষাতে। সেই কাঙ্ক্ষিত পরিক্ষা দেওয়ার আগেই কন্যাশ্রীর টাকা পেয়ে যাওয়াতে তার আর কলেজে যাওয়া হল না।

এরকম শ্বশুরবাড়ির বাধ্য বধূ হতে গিয়ে পড়াশুনা ছেড়ে দেওয়া মেয়েদের সংখ্যা অনেক। এই ছেড়ে যাওয়া মেয়েদের নিজেদের ইচ্ছের কথা জিজ্ঞেস করলে কোনও উত্তরও পাওয়া যায় না।

অন্যদিকে, এই প্রশ্ন উঠে , শিক্ষাঙ্গন কেন পারলো না এরকম মেয়েদের বাড়ির পরিবারের সদস্যদের বোঝাতে? খামতি কি শুধু শিক্ষাব্যবস্থার, নাকি অন্য কোনও কারণ রয়েছে।

এই কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেশ কিছু বিষয় হুড়মুড়িয়ে সামনে চলে এল। যেমন নারীদের মধ্যে এখনও পড়াশুনোর গুরুত্ব কেন সেভাবে গড়ে ওঠেনি? তাঁদের মধ্যে গৃহবধূ হয়ে থেকে যাওয়ার প্রবণতা বেশি কেন? কেন তাঁরা নিজেদের কর্মী পরিচয়ের থেকে কারও স্ত্রী এই পরিচয়ে সচ্ছন্দ বোধ করেন? নিজেরা দক্ষকর্মী হলেও কাজ পাওয়ার বিষয়ে কিছু ক্ষেত্র ছাড়া তাঁদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয় না কেন?
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১১: গৃহকর্মে নিপুণা বনাম নিজের কাজে সিদ্ধা নারী

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৩: আর্ষ মহাকাব্যদ্বয়ের আদি প্রচারমাধ্যম

ফিজিওথেরাপি: কেউ ঠান্ডায় জব্দ, কেউ গরমে, কোন ব্যথায় কোন ধরনের সেঁক কাজে লাগে?

আবার একটি কথোপকথন আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
একজন চিকিৎসক পাত্রী খুঁজছেন। তিনি নিজের বাড়িতে বলেছেন, পাত্রী চিকিৎসক না হলেও চলবে। তবে চাকরি করতে হবে। পাত্রের বাবা ধরুন শ্যামবাবু। কথা বলছেন পাত্রীর বাবা রামবাবুর সঙ্গে—

শ্যামবাবু: আপনার মেয়ে সায়েন্স নিয়ে পড়েছে?

রামবাবু: হ্যাঁ, পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়েছে। সরকারি স্কলারশিপ পেয়েছে। এখন একটি কলেজে পড়ায়।

শ্যামবাবু: সবই বুঝলাম। কিন্তু আমার গিন্নি বলছিলেন মেয়ের গায়ের রং কি পরিষ্কার? আসলে কি জানেন, ছেলে একজন দক্ষ সার্জেন তো, তাই তার স্ত্রী যিনি হবেন তিনি যেন আর পাঁচ জনের সামনে ছেলের সঙ্গে দাঁড়াতে পারে। আচ্ছা আর একটা কথা, আপনার মেয়ে কলেজ থেকে বাড়ি ফেরেন কখন?

রামবাবু: আসলে মেয়ে তো পিএইচডি করছে, তাই ওকে বিশ্ববিদ্যালয়েও যেতে হয়। সে কারণে কোনও কোনও দিন বাড়ি ফিরতে রাত ৯টাও বেজে যায়।

শ্যামবাবু: না না, তাহলে তো হবেই না। বাড়ির বউকে সন্ধ্যে ছয়টার মধ্যে বাড়িতে ঢুকতেই হবে। না হলে পাড়া প্রতিবেশী কি বলবে?
এরকম আরও না না ধরনের প্রশ্ন যখন মেয়ের বাবাকে শুনতে হয়, তখন আমাদের মতো সমাজে মেয়ের বাবা রামমোহন রায় বা বিদ্যাসাগরের মতো শক্তিশালী না হলে চাইবেন না মেয়ের মেধা থাকলেও তাকে নিজের মতো কেরিয়ার তৈরি করতে দিতে।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৭: অ্যাকোয়াপোনিক্স প্রযুক্তির প্রয়োগে উৎকৃষ্টমানের মাছ এবং গাছ বেড়ে উঠতে পারে

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৬: দুয়ারে অপচ্ছায়া

পর্দার আড়ালে, পর্ব-২৮: সপ্তপদী: মূল কাহিনিতে দুই ভিন্ন ধর্মাবলম্বী পুরুষ ও নারীর ভালোবাসার মধ্যে মিলন রাখেননি তারাশঙ্কর

আমাদের বাঙালিদের মধ্যে জাতপাতের প্রভাব যেমন আছে, তেমনই কুলীনপ্রথা বজায় রাখার ইচ্ছেও ষোলোআনা রয়েছে। যে শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং দক্ষতা একটি মেয়ের জীবনে অভিশাপ, সেই একই যোগ্যতা ও দক্ষতা একটি ছেলের হলে সমাজ ধন্য ধন্য করতে থাকে। আর তাঁর মাকে বলা হয় তিনি রত্নগর্ভা।

আবারও প্রশ্ন উঠে আমাদের সমাজে শ্রমের এরকম বৈষম্য মূলক মূল্য কেন হয়?
খুব সহজেই বোঝা যায় যে, এই বৈষম্য সমাজ ইচ্ছে করেই টিকিয়ে রাখে। কেন?
এর কারণ শুধু সমাজের আঙ্গিনায় গিয়ে থেমে যায়নি। যেমন গঙ্গা নদীর স্রোত থেমে যায়নি, তেমনি সমাজের পরিবর্তনের ঢেউ থেমে যায়নি। সেই পরিবর্তন এখন অনেক স্রোতের মিলনে বেশ খরস্রোতা। সমাজ, রাষ্ট্র এবং পুঁজিবাদী সমাজ একসঙ্গে মিলে একটা দল তৈরি করেছে। কারণ আমরা উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে যা কিছু উৎপাদন করছি, সমাজে সেখানে মানুষ তার মেধা এবং শ্রমকে কাজে লাগাচ্ছে। সমাজ একা তার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান দিয়ে এই বিপুল উৎপাদন এবং উৎপাদনের পিছনের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলিকে পরিচালনা করতে পারল না।

আগে যাঁরা জমির মালিক ছিলেন, তাঁদের মধ্যে আরও কিছু মানুষ এগিয়ে গেলেন বাকিদের ফেলে এই বৃহৎ কর্মকাণ্ডকে পরিচালনা করতে। এদেরকেই আমরা পুঁজিবাদী বলে থাকি। এই বৃহৎ কর্মকাণ্ডে লোকজন অনেক অনেক বেশি প্রয়োজন। তাই সমাজে যে যৌথ পরিবার বিষয়টি ছিল সেটি পরিবর্তিত হয়ে অনুপরিবার গড়ে উঠল। অনুপরিবার শহরে এসে বসবাস করতে শুরু করে। শহরের ছোট বাড়িতে শ্রমিকের যতটা না হলে নয়, ততটা পরিষেবা যেটা সে তার গ্রামের বাড়িতে পেত সেটা না পেলে সে কাজ ছেড়ে চলে যাবে। শ্রমিককে আটকে রাখার জন্য নারীকেই হাতিয়ার করে নিল পুঁজিবাদী সমাজ।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১১: বন থেকে বনান্তরে

বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ, বাতরক্ত বা গাউটে ভুগছেন? ঘরে বসেই মুক্তির উপায় জানুন

স্বাদে-আহ্লাদে: কুলের আচারের নাম শুনলে জিভে জল আসে? রইল সহজ রেসিপি

নারীর পরিশ্রম করার ক্ষমতা, তার পরবর্তী প্রজন্মের শ্রমিকের জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা এই বিষয়টিকে পুঁজিবাদীরা চাইল ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখতে। সমাজও এক নিয়মে চলে না। পারিশ্রমিকের জন্য স্বামীর মৃত্যুর পর সংসার চালানোর জন্য নারীদেরও বাড়ির বাইরে অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করতে আসতে হল। নারী শ্রমিকদের জন্য পুঁজিবাদীরা আলাদা করে কোনও সুবিধে দেয়নি। পরে নারীরা আন্দোলন করে নিজেদের প্রয়োজন মতো কিছু অধিকার আদায় করে নেয়।

অদ্ভুত ব্যাপার, নারীরা যতটা নিজেদের এবং তার আশেপাশের মানুষদের নিয়ে ভেবেছেন, তা আন্দোলনের ইতিহাস দেখলে বোঝা যায় সেরকম আন্দোলন পুরুষ একা কখনও করেনি। প্রকৃতিকে রক্ষা করার মতো বিষয়তেও দেখা গিয়েছে তারা প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে অনেক সহনশীল এবং সংযমী।

পরিবেশ সংক্রান্ত এবং অন্য আন্দোলনের প্রভাবে ধীরে ধীরে প্রথম বিশ্বের দেশে দেখা গেল ভারী শিল্পের পরিবর্তে এখন পরিষেবা ভিত্তিক শিল্প খুব লাভজনক ব্যবসা। বিমানে চড়াকালীন অবস্থা থেকে যেকোনও অফিসে, দোকান, বাজার সব জায়গায় শুধু পরিষেবা নয়, নারীর মতো সেবার প্রয়োজন হয়ে পড়ল। রান্না পছন্দ না হলেও মা বা অন্য নারীরা যে ভাবে আমাদের বলেন, বাবু এবারে খেয়ে নাও, পরের বার আরও ভালো করে দেব। অর্থাৎ নিজেরা দোষের ভাগী হয়ে আদর করে বলছে, পরের বার আরও ভালো পরিষেবা সে দেবেই। আমরা খুব আপ্লুত হই। গ্রাহকরাও আপ্লুত হতে শুরু করল। পুঁজিবাদী মানুষ এবার নারীর এই স্বভাবকে বলে দিল প্রাকৃতিক। নারী মানেই সে গাছের লতার মতো জড়িয়ে থাকবে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৩: ‘তিসরি মঞ্জিল’ ছিল পঞ্চমের প্রথম অগ্নিপরীক্ষা

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৮: পূর্ণ অপূর্ণ-র মাঝে পথ দেখায় ‘দেবত্র’

জ্যোতির্লিঙ্গ যাত্রাপথে, পর্ব-৪: কাশীর পথে-ঘাটে

ব্যাপারটা দাঁড়ালো যে, নারীকে নারীর মতো হতে হবে। আর সেই নারী মিষ্টি ভাষায় কথা বলবে, পরিষেবা দেবে। নারীদের হাসপাতালের নার্স হিসেবে নিয়োগ বেড়ে গেল। এখন নারীর সেবা করার ক্ষমতাকে একটি দক্ষতা বলে মনে করা হয়। একে কাজে লাগিয়ে নারীর অর্থনৈতিক অবস্থান বদলে যেতে পারত। কিন্তু তা আর হল না। এবারে পুঁজিবাদীরা দেখলো নারীরা কাজে যোগদান করলে কিছুতেই বাড়ি সামাল দেবে না। পরবর্তী প্রজন্মের শ্রমিক পেতে অসুবিধে হবে। তাই তারা খুব সুচারুভাবে বাড়ি আর বাইরের জগতকে আলাদা করে দিল। পরিষেবা দেওয়ার কাজ বেড়ে গিয়েছে সমাজে। ব্যাংক থেকে শুরু করে বিমা কোম্পানি সব জায়গায় গ্রাহক পরিষেবা বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এবার পুরুষদের সেই কাজে নিয়োগ করা হল। নারীদের বলা হল বাড়িতে থেকে সমাজে অন্তরালে থেকে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানে ভরসা রেখে সন্তানের জন্ম দিতে। আমরা মেয়েরা যে একদিকে পুঁজিবাদকে অজান্তে পরিষেবা দিচ্ছি, আবার পিতৃতন্ত্রকেও বাঁচিয়ে রাখছি, সেটি বুঝে উঠছি না। উল্টে নিজেদের রাজনৈতিক দাবি ভুলে একে অন্যকে আলাদা করে একবার নারীবাদী হচ্ছি, আবার একবার পিতৃতান্ত্রিক হচ্ছি। ভাবনার সময় এসে গিয়েছে।—চলবে

* প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
* বৈষম্যের বিরোধ-জবানি (Gender Discourse): নিবেদিতা বায়েন (Nibedita Bayen), অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, পি আর ঠাকুর গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content