বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


শিরপুরের সবচেয়ে বড় মন্দির হল সুরঙ্গটিলা। ২০০৬-২০০৭ সালে আবিষ্কৃত হয়। এটা পঞ্চ আয়তন রীতিতে তৈরি। মহাশিবগুপ্তা বালার্জুনা সপ্তম শতকের রাজা। তাঁর আমলে এটি তৈরি হয়েছিল। পঞ্চ আয়তন মানে হল মূল মন্দিরটি আরও চারটি মন্দিরের দ্বারা সুরক্ষিত। সাধারণত হিন্দু মন্দির গুলো পূর্ব-পশ্চিমমুখী হয় আর এক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রম যে চারটি মন্দির মূল মন্দিরটিকে ঘিরে রয়েছে তারা কিন্তু উত্তর পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব, উত্তর-পশ্চিম, দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত।

সুরঙ্গটিলার যে ধ্বংসাবশেষ সেটিও বিশাল এলাকা জুড়ে পাওয়া গিয়েছে। সাদা পাথরের মন্দির এবং ৯ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। এবং ৩০টি সিঁড়ি অতিক্রম করে এখানে উঠতে হয়। সিঁড়ির সংখ্যা ৩০ হলেও এগুলি আংশিকভাবে আছে অর্থাৎ একটি পা পুরো রাখা যাবে না। মনে করা হয় ১২ শতাব্দীতে যে ভূমিকম্প হয়েছিল, সেই ভূমিকম্পতে সিঁড়িগুলি এরকম হয়ে গিয়েছে। সেই সিঁড়িগুলো দিয়ে আপনি সোজাসুজি উপরে উঠতে পারবেন না। আপনি উঠবার সময়ের ডানদিক অভিমুখী হয়ে উঠবে‌ নামবার সময় বাঁদিক অভিমুখী হয়ে নামতে হবে। আর এই ৩০টি সিঁড়ির মধ্যে প্রত্যেকটিতে একটি করে পিলার ছিল বলে মনে করা হচ্ছে।
এই সিঁড়িগুলি শেষ করে আপনি যখন উপরে উঠলেন সেখানে গিয়ে আপনি দেখতে পাচ্ছেন একটি মণ্ডপ মন্দির। আর চারটি মন্দিরের মধ্যে চারটিই শিবের মন্দির আছে। সাদা, লাল, হলুদ এবং কালো শিব মন্দির। এবং একটা মন্দির চতুর্থ শতকে গণেশের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। যদিও গণেশ বলে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু সেখানে একটি হাতির মাথা সমন্বিত ভগবানের মূর্তি আছে। আর মন্দির চত্বরের ধ্বংসাবশেষের নিচে আরও দুটি মনুমেন্ট পাওয়া যায়। একটি পুরোহিত ও সন্ন্যাসীদের বাসস্থান ও অন্যটিতে একটি ছোট তান্ত্রিক শিবলিঙ্গ আছে।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৮: শ্রীপুরার কাহিনি

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৮: যেখানে বাঘের ভয় সন্ধে ঠিক সেখানেই হয়, আমারও ঠিক তাই হল

জ্যোতির্লিঙ্গ যাত্রাপথে, পর্ব-৪: কাশীর পথে-ঘাটে

আরেকটি পরিচিত মন্দির চত্বর হচ্ছে বালেশ্বর মন্দির চত্বর। রাজা মহাশিবগুপ্তা বালার্জুনা অষ্টম শতকের মাঝামাঝি সময়ে এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন। ঠিক থিবরদেব বুদ্ধ বিহারের উল্টো দিকে পঞ্চাশ মিটার দূরত্বে এই মন্দিরটি অবস্থিত। যতটুকু ধ্বংসস্তূপ পাওয়া যায় তার মধ্যে এখনও অসম্ভব সুন্দর কয়েকটি পিলার পাওয়া যায়, অসম্ভব সুন্দর কার্ভিং করা অর্থাৎ পাথরের কাজ করা দরজার নিদর্শন পাওয়া যায়। সুন্দরী রমণীদের মূর্তি পাওয়া যায় এবং মার্বেলের তৈরি শিবলিঙ্গ সেখানে পাওয়া যায়। আর এই প্রত্যেকটি মন্দিরে কিন্তু মহা শিবরাত্রিতে প্রচুর ভিড় হয় এবং মেলা ইত্যাদি বসে। তারই সঙ্গে সঙ্গে উল্লেখযোগ্য আরেকটি শিব মন্দিরের কথা আমি আগেই বলেছি গন্ধেশ্বর শিব মন্দির।
এবার চলে আসি শিরপুরের বৌদ্ধ নিদর্শন গুলোর কথায়। সবচেয়ে প্রথম যার উল্লেখ করতে হয় তা হল থিবরদেব বৌদ্ধবিহার। সাধারণভাবে বলা হয় শিরপুর বৌদ্ধবিহার। অষ্টম শতাব্দীর বুদ্ধিস্ট টেম্পেল, মনাস্ট্রিও আছে। সারা বছরে প্রচুর বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা, তীর্থ যাত্রীরা এখানে আসে। দলাই লামা পর্যন্ত এখানে এসেছিলেন আমরা সেটা জানতে পারি। এই বৌদ্ধ বিহারের দরজাগুলো অসম্ভব সুন্দর মিথুন কলাশৈলী দিয়ে নির্মিত। এই যে পুরাতাত্ত্বিক খনন করে বিহারটি পাওয়া গিয়েছে সেখানে যে শিলালেখগুলো পাওয়া গিয়েছিল, যে ইনক্রিপশনগুলো পাওয়া গিয়েছিল তা থেকে জানা যায়, এই বিহারটি চোদ্দটি ঘর সমন্বিত একটি মনাস্ট্রি এবং এটি নির্মিত হয়েছিল ভিক্ষু আনন্দ প্রভু দ্বারা। পৃষ্ঠপোষক ছিলেন রাজা শিবগুপ্তা বালার্জুনা। এই বৌদ্ধ বিহারের বিশেষ আকর্ষণ হল মনোলিথিক অবলোকিত বুদ্ধ। কম্পেসনেট বুদ্ধর মূর্তি। আর এই বৌদ্ধ বিহারের যতগুলি দরজায় আমরা প্রেমিক প্রেমিকার সুন্দর মূর্তি দেখতে পাই সেগুলি কিন্তু সমস্ত বৌদ্ধ এবং হিন্দু ধর্মের বিশ্বাসের সমন্বয়ের রূপ। এটা দেখে বোঝা যায় যে সেই সময় রাজা এবং শাসনকর্তারা মুক্ত মনের মানুষ ছিলেন সব ধর্মকে গ্রহণ করতে তাদের অসুবিধা ছিল না।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৩: রবীন্দ্রনাথের পোশাকআশাক

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৪: সুন্দরবনের সুন্দর কাঁকড়া

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩৭: অবশেষে অগ্রজের দেখা মিলল বুঝি…

আমরা সকলেই জানি ১৮৮২ তে আলেকজান্ডার কানিংহাম শিরপুর পরিভ্রমণ করার পরে, তাঁর রিপোর্ট অনুযায়ী এটি একটি ভারতবর্ষের অন্যতম পুরাতাত্ত্বিক এলাকা বলে সংরক্ষিত হয়। এতক্ষণ আমরা যে মন্দিরগুলো কথা উল্লেখ করলাম তাতে করে সব মন্দিরের কথা উল্লেখ না করলেও ছোট বড় মিলে বাইশটি শিব মন্দির, পাঁচটি বিষ্ণুমন্দির, দশটি বৌদ্ধবিহার, তিনটি জৈন বিহার এবং একটি বাজারের কথা ও একটি স্নান কুন্ডের কথা আমরা পেয়েছি। এই পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো দেখলে আরেকটি জিনিস আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না। এখানে বৌদ্ধ বা জৈন স্ট্যাচুস বা মূর্তিগুলো বা শিব ও শক্তির মূর্তিগুলি একই সঙ্গে পুজিত অর্চিত হয়। শিরপুর আদি মধ্যযুগের ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি ভাস্কর্যের জন্য উল্লেখযোগ্য। শিরপুর প্রাচীন ভারতের বৌদ্ধ এবং ব্রোঞ্জ আর্টওয়ার্কের বিখ্যাত ছিল। এবং আমরা এটাও শুনে থাকি ইলোরার সঙ্গে শিরপুরের এই একটি জায়গায় সাংঘাতিক মিল আছে। ব্রোঞ্জ আর্টওয়ার্ক।
আরও পড়ুন:

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-৭: ফুটবলের শিল্পী: বিশ্বের দশজনের একজন

হেলদি ডায়েট: সর্দি-কাশিতে ভুগছেন? জেনে নিন কোন ঘরোয়া টোটকায় মিলবে আরাম

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৯: দাঁতে পোকা! সত্যি, নাকি নিছক ধোঁকা?

আবার ফিরে আসি বুদ্ধবিহারগুলোর কথায়। আনন্দ প্রভু বিহারের কথা আলোচনা তো করলামই। আনন্দ প্রভু বিহারের ঠিক পাশেই বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের বিহারকুঠি মানে তাদের আবাসস্থল রয়েছে এবং বিনামূল্যে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। ইনক্রিপসন থেকে জানা যাচ্ছে যে তাদের সাত্ত্বিক ব্যঞ্জন দেওয়া হতো। ঠিক এই বিহারের পাশেই আরেকটি বিহার আছে যেখানে শুধু শাস্ত্রচর্চাই করা হতো। সেইভাবে আসনগুলো নির্দিষ্ট আছে এবং বুদ্ধদেবের মূর্তিটি অনেক নিচুতে অবস্থিত। সেই বিহারটির নাম চুরিয়া বিহার। চুরিয়া কেন? কারণ এই বিহারে অর্থাৎ এই মনাস্ট্রিতে বা এই মন্দিরে মহিলা যারা সন্ন্যাসীরা সাধকরা তারা এখানে আরাধনা করতেন বুদ্ধের।
স্বস্তিকা বিহার ১৯৫০ সালে আবিষ্কৃত হয়। এই বিহারটির এইরকম নামকরণ এই কারণে যে এর চারপাশে যে ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছে তা একটা স্বস্তিক সাইন বা চিহ্নের মত। এই সাইটে একটি বুদ্ধের স্ট্যাচু এবং বুদ্ধের সমসাময়িক কোনও ভগবান তার ধাতু নির্মিত অর্থাৎ ব্রোঞ্জ নির্মিত স্ট্যাচু আছে। বলা হয় পদ্মপাণির মূর্তি সেটি। আরেকটি মনাস্ট্রি রয়েছে লক্ষ্মণ মন্দিরের কাছাকাছি এক কিলোমিটারের মধ্যে। এটি শৈব রাজা ও বুদ্ধিস্ট রানির মিলনস্থল। এছাড়াও আরো অনেক বুদ্ধবিহার রয়েছে যার ধ্বংসাবশেষে সন্ন্যাসীদের বাসস্থান ঘর ইত্যাদি বোঝা যায়।—চলবে

ছবি: লেখিকা
* চেনা দেশ অচেনা পথ (Travel Offbeat): লেখক— অর্পিতা ভট্টাচার্য (Arpita Bhattacharya), অধ্যাপিকা, বাংলা বিভাগ, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ। শৈলীবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। বর্তমান আগ্রহ ও কাজ ভ্রমণ-সাহিত্য, ইকো-ট্যুরিজম, কালচার ট্যুরিজম, স্মৃতিকথা নিয়ে। এছাড়াও মুক্তগদ্য চর্চা ভালো লাগার জায়গা। এখন পর্যন্ত প্রকাশিত ৫টি গ্রন্থ এবং ৫০ টিরও বেশি প্রবন্ধ। সম্পাদনা করেছেন একটি বই এবং ধারাবাহিক সম্পাদনা করেন রবীন্দ্রনাথ টেগোর অ্যাডভান্সড রিসার্চ সেন্টারের জার্নাল।
 

বাইরে দূরে

লেখা পাঠানোর নিয়ম: এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। লেখার সঙ্গে বেশ কিছু ছবি পাঠাতে হবে। চাইলে ভিডিও ক্লিপও পাঠাতে পারেন। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content