শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


যে বয়সে সাধারণ ভারতীয় মহিলারা নাতি, নাতনি, পুত্র, কন্যা, পুত্রবধূ, ঠাকুর, দেবতা, ছাড়া না ছাড়ার সংসার নিয়ে জীবনসায়াহ্ন যাপন করতে করতে অনেক তো হল, আর কেন? দৈনন্দিন জীবনে এমন বাচিক প্রকাশ ঘটান, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে কেরালার জে রাধামণি আম্মা উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। একাত্তর বছর বয়সে পৌঁছে গাড়ি চালানো তাঁর কাছে এক অন্য আবেগ।
আরও পড়ুন:

দশভুজা: দু’শো বছর আগে হলে তিনি ইঞ্জিনিয়ারের বদলে সতী হতেন

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৩: রবীন্দ্রনাথের পোশাকআশাক

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৯: জলে হরি, স্থলে হরি, হরিময় এ জগৎ

স্বামীর উৎসাহে প্রথম গাড়ি চালানো শেখেন এবং ১৯৮১ সালে তিরিশ বছর বয়সে প্রথম ড্রাইভিং লাইসেন্স পান। সেই শুরু এরপর বাস এবং লরি চালানোর লাইসেন্স পান ১৯৮৮ সালে। ১৯৭০ সাল থেকে তাঁর স্বামী টিভি লালন কেরালার থোপ্পুমপাড়িতে ‘এ টু জেড’ নামে ড্রাইভিং স্কুল চালাতেন। ফলে সাংসারিক জীবনের শুরু থেকেই নানা ধরনের গাড়ি সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা তাঁর হতে থাকে।
মাত্র সতের বছর বয়সে বিয়ে হয়ে আরুকুট্টি (কোচির কাছে) থেকে থোপ্পুমপাড়িতে এসেছিলেন। তখনও জানতেন না স্বামী, পুত্র, সংসারের পাশাপাশি ছোট গাড়ি থেকে ভারী গাড়ি হয়ে উঠবে তাঁর জীবন ও জীবিকার প্রধান অবলম্বন। যেমন দীর্ঘদিন তিনি থোপ্পুমপাড়ি থেকে চেরতলা পর্যন্ত তেত্রিশ কিমি পথ বাস চালিয়ে পাড়ি দিয়েছেন, নিজের স্বামীকে সবসময় পাশে পেয়েছিলেন সেই সময়।
বাস চালানোর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে রাধামণি বলেন, ‘আমার বাস চালাতে কখনও ভয় করেনি। একবার শিখে নিলে এটা অন্য যেকোনও যানবাহন চালানোর মতো ব্যাপার’। এই ভয় না পাওয়ার কারণে তাঁর কাছে এগারো প্রকারের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে, যার মধ্যে এক্সকাভেটর, ফোর্কলিফ্ট, ক্রেন, রোড রোলার, ট্র্যাক্টর, ট্রেলর ট্রাক, বাস, লরি উল্লেখযোগ্য।

সব ঠিক চলতে চলতে ২০০৪ সালে হঠাৎই এক দুর্ঘটনায় রাধামণির স্বামী মারা যান। এই ঘটনার পর সংসার ও পুত্রদের প্রতিপালনের জন্য তিনি ‘এ টু জেড’ ড্রাইভিং স্কুলের দায়িত্ব নেন। কেরালায় তিনিই প্রথম মহিলা যিনি ভারী গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পান।
আরও পড়ুন:

দেশ: ব্যস্ত শহুরে জীবন থেকে সাময়িক মুক্তির আদর্শ ঠিকানা রম্ভা

স্বাদে-আহ্লাদে: চিকেন প্রিয়? তাহলে এমন হায়দরাবাদি চিকেনে জমিয়ে দিন দুপুর

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৩: কালাদেওর বলি

২০২১ সালে তিনি প্রথম বিপজ্জনক পণ্যবাহী গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পান। ভারতে যে কোনও ড্রাইভিং স্কুল চালানোর ক্ষেত্রে নিয়ম হল স্কুলের মালিক বা প্রশিক্ষকদের তারা যে ধরনের গাড়ি চালানো শেখান তার লাইসেন্স তাদের থাকতে হয়। রাধামণি যদিও সবসময় প্রশিক্ষণ দেন না, কিন্তু মাঝে মাঝে ছাত্রছাত্রীদের ভারী গাড়ি চালানোর নিয়মগুলো দেখান। স্কুলে মূলত তিনি কম্পিউটার পরিচালনার দিকটা দেখেন, সঙ্গে থাকেন বাড়ির অন্য সদস্যরা।
শুধু যে ড্রাইভিং স্কুল চালানো তা তো নয়, পাশাপাশি তিনি এই একাত্তরেও কালামাসেরি পলিটেকনিক কলেজ থেকে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ডিপ্লোমা ডিগ্রির জন্য পড়াশোনা করে চলেছেন। কোনও দিন তিনি থেমে যেতে জানেন না। না হলে স্বামীর মৃত্যুর পরেই সব ছেড়ে বাড়িতে বসে যেতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৮: শ্রীপুরার কাহিনি

ষাট পেরিয়ে, পর্ব-২৪: বয়সেও আসুক বসন্ত

ডায়েট ফটাফট: ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেড়েছে? কোন কোন খাবারে বশে থাকে এই সমস্যা? জেনে নিন কী খাবেন, কী নয়

এগারো প্রকারের ড্রাইভিং লাইসেন্স তাঁর ঝুলিতে। তাঁর ঠাকুমার ঝুলি শুধু গল্পে ভরে ওঠেনি, ভরে উঠেছে নানা দুঃসাহসিক কীর্তিতে। যদিও এত কিছুর পরও দু’ চাকার বাহনই তাঁর সবথেকে প্রিয়। অনেক দেরিতে ১৯৯৩ সালে প্রথম দু’ চাকার গাড়ি চালানোর লাইসেন্স তিনি পান। স্বামীর কিনে দেওয়া স্কুটারে তিনি একটা সময় সব জায়গায় যেতে শুরু করেন। খুব প্রয়োজন ছাড়া চার চাকার গাড়ি বের করতেন না।
২০২০ সালে দক্ষিণ ভারতের প্রথম সারির এক দৈনিক সংবাদপত্রে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, একমাত্র টাওয়ার ক্রেন চালানোর চেষ্টা তিনি করেননি, কারণ সেই ক্রেনের কেবিন হয় অনেক উঁচুতে। শাড়ি পরে ওঠা দুঃসাধ্য। এছাড়া সব ধরনের ভারী গাড়ি চালাতে তিনি অভ্যস্ত।

সকলের প্রিয় মণিআম্মা (স্থানীয়রা তাঁকে ভালোবেসে ওই নামেই ডাকেন) মনে করেন বয়স শুধু একটা সংখ্যামাত্র। কোনও কাজ ভালোবেসে করলে বয়স মোটেই বাধা হয় না। সবসময় নতুন কিছু শেখার মধ্যে তিনি নিজেকে নিযুক্ত রাখেন। নতুন প্রজন্মের কাছে তাই তিনি সবসময় অনুপ্রেরণাস্বরূপ। বাস্তবের দশভুজা।
* দশভুজা (women – Special Article) : ড. বিদিশা মিশ্র (Bidisha Misra), সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ। বিদিশা বাঙালি নৈয়ায়িক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য্যের গ্রন্থ কাব্যবিলাসের উপর গবেষণা করেছেন। দেশের বিভিন্ন প্রদেশের পত্রিকায় তাঁর শোধপত্রগুলো প্রকাশিত হয়েছে।

Skip to content