প্রাচীন শিরপুরের নাম ছিল শ্রীপুরা। চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাং ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে এখানে এসেছিলেন। এর কাছেপিঠে আছে শৈব, বৈষ্ণব, জৈন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। মন্দিরগুলোর অনেকগুলোই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। শিরপুরের বিখ্যাত মন্দির লক্ষ্মণ মন্দির, যা প্রকৃতপক্ষে একটি বিষ্ণু মন্দির। দূর থেকে দেখলে মনে হয় সপ্তম শতাব্দীর প্রথমার্ধে তৈরি এই দেবালয়টি বোধহয় শুধু বিশেষ ধরনের পোড়া ইট দিয়ে তৈরি হয়েছে। কাছে গেলে বোঝা যায় এই মন্দিরটিকে ভারতের তৈরি ইটের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মন্দির বলে কেন গণ্য করা হয়। শুধু বিভিন্ন আকার বা আকৃতি ব্যবহার করে এমন এক কারুকার্যময় মন্দির তৈরি করা হয়েছে, যা আপনাকে মুগ্ধ করবে।
মন্দির প্রাঙ্গণটি ‘আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার (এএসআই)’ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং বিশাল তার অবস্থান। মন্দিরের দু’পাশে পাথরে খণ্ডিত বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি ছাড়াও ১০ অবতারের মূর্তি শোভা পাচ্ছে। প্রবেশদ্বারের ওপরে পাথরে ফ্রেমে বিষ্ণুর অনন্ত নাগশয্যা অনুপম মূর্তিটি নিঃসন্দেহে লক্ষ্মণ মন্দিরের সেরা কারুকার্য। মন্দিরের অদূরে মিউজিয়ামের ভিতরে একটি চতুর্মুখী শিব মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়াও গণেশ মূর্তি, কালো পাথরের বিষ্ণু মূর্তি, ছোট আকারের দুর্গামূর্তি উল্লেখযোগ্য। আরেকটি ঘরে পাথরের শিবলিঙ্গগুলি রয়েছে যেটি সাদামাটা অথচ অসামান্য। এছাড়াও রয়েছে মহিষাসুরমর্দিনী, ঘোড়ায় টানা রথের ওপর সূর্যদেব, ধ্যানোময় পার্শ্বনাথ এবং ঘরের প্রবেশ পথের দুদিকে দণ্ডায়মান দ্বার পালকের জীবন্ত মূর্তি। অনিন্দ্য সুন্দর লক্ষ্মণ মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন হর্ষনাথের বিধবা পত্নী যিনি বিবাহের পূর্বে মগধের রাজকন্যা ছিলেন।
আরও পড়ুন:
চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৭: কুডার ছুঁয়ে শিরপুর
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫২: বইয়ের সব কপি কবির নির্দেশে বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩৬: রামের সন্ধানে ভরতের যাত্রা সফল হল কি?
এই মন্দির থেকে বেরিয়ে উল্টো দিকে রাম মন্দির, সেটিও বিষ্ণু মন্দির। রাম মন্দিরের অদ্ভুত কারুকার্য। রাম মন্দিরে আমরা অনেক শিবলিঙ্গের অদ্ভুত অবস্থান দেখতে পাই। শিরপুরকে ছত্রিশগড়ের হারিয়ে যাওয়া শহর (The lost city of Chhattisgarh) বলা হয়। শিরপুরে ঢুকলেই মনে হবে একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে তাই নয়, বরং মনে হবে মিস্টিরিয়াস। সম্ভবত এটাই কারণ, যে এটি বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের দ্বারা পরিত্যক্ত একটি শহর। পুরনো। এবং এর সমগ্র ইতিহাস এখনও সবার কাছে তার রহস্যগুলো উন্মোচন করে দেয়নি।
আরও পড়ুন:
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৮: জ্বরে ভাত খাবেন?
অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৮: হৃদয়মন্দিরে মন শুদ্ধ করে দেবতা প্রতিষ্ঠা করলে তবেই তো দেবতার পুজো হবে
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৭: একটার পর একটা রেস্তরাঁয় ফোন করে জানতে পারলাম ৫ মাইল দূরে একটি খোলা আছে
শিরপুরকে শ্রীপুরও বলা হতো। এই ধরনের নামকরণের কারণ হল এক সময় স্বর্ণ শহর ছিল। থ্রিবার দিবা এবং শিবগুপ্ত বালারজুনা ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শতাব্দী— এই দুই রাজার রাজত্বকালে এই শহরে কম করে ১০০টি মন্দির, ১০০টির উপরে বৌদ্ধ মনাস্ট্রি ছিল। দশ হাজার বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বাস করতেন। এই পরিত্যক্ত এলাকাটিকে কয়েক দশক ধরে আবিষ্কার করা হয়েছে। অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ স্তূপ খনন করা হয়েছে, যার মধ্যে সুরং টিলা, প্রায় এক ডজন বৌদ্ধবিহার, মনাস্ট্রি, অনেকগুলো হিন্দু মন্দির শিব-বিষ্ণু-শক্তি বা তান্ত্রিক টেম্পেলস যেগুলোকে বলা যায় এবং ষষ্ঠ শতাব্দীর একটি বাজার।
আরও পড়ুন:
হেলদি ডায়েট: অ্যাডিনোভাইরাসের প্রকোপ বাড়ছে শিশুদের মধ্যে! ভাইরাস এড়াতে খুদের পাতে কী কী রাখবেন?
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক,পর্ব-৩: কালাদেওর বলি
পুরাতত্ত্ববিদরা বলছেন, এটি ভারতবর্ষে আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ সাইট। নালন্দা থেকে অনেক অনেক বড়। আমরা এটাও জানি বিখ্যাত বৌদ্ধ সাধক নাগার্জুনা তিনি শিরপুরে গিয়েছিলেন। শিরপুর শিল্প কলার একটি চরমতম নিদর্শন ক্ষেত্র ছিল; এখনও সেটাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করার পরে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবার চেষ্টা করা হচ্ছে। শিরপুর ডান্স অ্যান্ড মিউজিক ফেস্টিভ্যাল আয়োজন করা হচ্ছে। সারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন ধরনের সংস্কৃতির মানুষদের এখানে আনা হচ্ছে। ফোক ডান্সের চর্চা হচ্ছে, ওয়ার্কশপ হচ্ছে শিল্পকর্মের, হ্যান্ডিক্রাফটের, মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টের কিন্তু শিরপুর তো শিরপুরই।
ছবি: লেখিকা
ছবি: লেখিকা
* চেনা দেশ অচেনা পথ (Travel Offbeat): লেখক— অর্পিতা ভট্টাচার্য (Arpita Bhattacharya), অধ্যাপিকা, বাংলা বিভাগ, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ। শৈলীবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। বর্তমান আগ্রহ ও কাজ ভ্রমণ-সাহিত্য, ইকো-ট্যুরিজম, কালচার ট্যুরিজম, স্মৃতিকথা নিয়ে। এছাড়াও মুক্তগদ্য চর্চা ভালো লাগার জায়গা। এখন পর্যন্ত প্রকাশিত ৫টি গ্রন্থ এবং ৫০ টিরও বেশি প্রবন্ধ। সম্পাদনা করেছেন একটি বই এবং ধারাবাহিক সম্পাদনা করেন রবীন্দ্রনাথ টেগোর অ্যাডভান্সড রিসার্চ সেন্টারের জার্নাল।
বাইরে দূরে
লেখা পাঠানোর নিয়ম: এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। লেখার সঙ্গে বেশ কিছু ছবি পাঠাতে হবে। চাইলে ভিডিও ক্লিপও পাঠাতে পারেন। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com