রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: গৌতম চট্টোপাধ্যায়।

খ্যাক খ্যাক, খুক খুক, ঢং ঢং–চেম্বারে বসে রোগী দেখতে দেখতে কানে আসছে একটু দূরে বসে থাকা প্রতীক্ষারত রোগীদের কাশির কোরাস। গত একমাস ধরে কাশির মহোৎসব শুরু হয়েছে। নাক কান গলার প্র্যাকটিস করি আমি। দশ জনের মধ্যে আট জনই জ্বর সর্দি কাশির রোগী। অ্যাজিথ্রোমাইসিন খেয়ে বা টোটকাটাটকি করে অনেকেরই জ্বর সর্দি মাথা ভার কমে গেলেও, কাশি কিন্তু কমছে না কারও। এ জন্য তারা ইতিমধ্যে কয়েক বোতল কাফ সিরাপও খেয়ে ফেলেছেন, কিন্তু কাশি বিদায়ের কোনও লক্ষণই নেই। সত্যিই কি কাশি কমাতে কাফ সিরাপের কোনও সদর্থক ভূমিকা আছে! কাশি কমাতে গেলে কি বোতল বোতল কাফ সিরাপ খেতেই হবে! দেখা যাক চিকিৎসা বিজ্ঞান কী বলে।
কাশির সঙ্গে আমাদের আবাল্য পরিচয়। একটু আধটু কাশিকে কে-ই বা পাত্তা দেয়। আমাদের শ্বাসযন্ত্রে রয়েছে একটি শ্বাসনালি বা ট্রাকিয়া, যা গলার মাঝামাঝি জায়গা থেকে শুরু হয় বুকে গিয়ে দুটো ক্রোমোনালিতে ভাগ হয়ে দুটো ফুসফুসে প্রবেশ করেছে। শ্বাসনালির শুরুতে রয়েছে দুটো ভোকাল কর্ড বা স্বর রজ্জু। নাক এবং মুখ দিয়ে গৃহীত বাতাস ফারিংস ও ল্যারিংস হয়ে এই দুটো ভোকাল কর্ডের ফাঁক দিয়ে শ্বাসনালীতে প্রবেশ করে। এই বিরাট শ্বাসপথের কোথাও কোনও উত্তেজনা দেখা দিলে, সেই অনুভূতি স্নায়ু বাহিত হয়ে মস্তিষ্কের কাফ সেন্টারে পৌঁছয় এবং তার নির্দেশেই আমরা কাশতে থাকি। যত সহজ করে ব্যাপারটা বলার চেষ্টা করলাম, অত সহজে কিন্তু এটা ঘটে না। জটিল স্নায়ুপথ এবং মস্তিষ্ক পুরো ব্যাপারটি নিয়ন্ত্রণ করে।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৬: কানে খোল, তেল দেন?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫১: বিয়েশাদির ঠাকুরবাড়ি

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৬: প্রকৃতি নিয়ে পর্যটন

 

ডাক্তারি পরিভাষায় কাশি দু’ধরনের

নন প্রডাক্টিভ কাফ বা শুকনো কাশি

যেখানে কাশির সঙ্গে কোনও কফ ওঠে না। যেমন স্মোকার্স কাফ অর্থাৎ যারা দীর্ঘদিন ধূমপান করেন তাদের কাশি, স্বরযন্ত্রের ক্যানসারের প্রথম পর্যায়ের কাশি, অ্যাকিউট বা স্বল্প মেয়াদি প্লুরিসির জন্য কাশি, কোনও ভাইরাল সংক্রমনের জন্য কাশি, অ্যালার্জির কাশি, ধোঁয়া-ধুলো থেকে আচমকা কাশি ইত্যাদি।
 

প্রোডাক্টিভ কাফ

প্রোডাক্টিভ কাফ অর্থাৎ যেখানে কাশির সঙ্গে শ্লেষ্মা বা কফ ওঠে। শ্বাসপথের যে কোনও জায়গায় প্রদাহ বা সংক্রমণ হলে এমনটি ঘটে। যেমন ব্রনকাইটিস, ল্যারিনজাইটিস, নিউমোনিয়া, ব্রনকিয়েকটিসিসি, টিউবারকিউলোসিস ইত্যাদি।

আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৭: ঈশ্বরের ভালোবাসার সমুদ্রে ডুব দিলে তবেই ভক্তিরূপ মুক্তো খুঁজে পাওয়া সম্ভব

এই বইমেলা জানে আমার প্রথম অনেক কিছু…

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৫৪: জ্ঞানবৃদ্ধ অষ্টাবক্র জনকের রাজ্যে প্রবেশের অনুমতি পেলেন?

সাধারণ কাশির জন্য কেউ সচরাচর ডাক্তারের কাছে যেতে চান না। নিজেরাই ওষুধের দোকান থেকে এক বোতল কাফ সিরাপ কিনে খান বেশ কিছু নগদ গচ্চা দিয়ে। কাশি কমাবার মহৌষধ একমাত্র কাফ সিরাপ, ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপনের চটক প্রচার আর কিছু মানুষের পৃষ্ঠপোষকতায় এই ধারণা আমাদের রক্তমজ্জায় ঢুকে গিয়েছে।

কিন্তু আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান মনে করে, কাশি কমাতে কাফ সিরাপের ভূমিকা অতি নগণ্য। কাশির চিকিৎসা হওয়া উচিত তার কারণ অনুযায়ী। কাফ সিরাপে দুই ধরনের উপাদান থাকে। এক ধরনের উপাদান কফকে তরল করে কাশির সঙ্গে বার করে দেয়, যাদের বলে এক্সপেক্টরান্ট যেমন অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড কিংবা পটাশিয়াম আয়োড ইত্যাদি। আর এক ধরনের উপাদান কাফ সেন্টার সিডেট করে, মানে ঝিমিয়ে দেয় বা ঘুম পাড়িয়ে দেয়। যেমন কোডিন, নানা ধরনের অ্যান্টিহিস্টামিন ইত্যাদি।

অনেক কাফ সিরাপে আবার পরস্পরের বিপরীতধর্মী দু’ধরনের উপাদানও থাকে, যা কখনওই বিজ্ঞানসম্মত নয়। নিজের বুদ্ধিতে কাফ সিরাপ কিনলে বিপত্তি ঘটতেই পারে। ধরুন, আপনার বুকের কোনও অসুখের জন্য প্রোডাক্টিভ কাফ হচ্ছে। আপনি দোকান থেকে এমন কাফ সিরাপ নিয়ে এলেন যাতে কাফ সিডেটিভ আছে। যা শ্লেষমা ও কফকে বার হতে দিল না। এই কফ জমে গিয়ে জীবাণু সংক্রমণ আরও বাড়বে, কাশি তো কমবেই না উল্টে রোগীর অবস্থা খারাপ হবে।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪২: সুন্দরবনের কিছু মূল্যবান মাছ যেগুলো আজ লুপ্তপ্রায়

অতিথি আপ্যায়নে চাই পাঁঠার মাংসের লোভনীয় পদ? চিন্তা নেই ১০ মিনিটেই জমে যাবে পুজোর ভূরিভোজ! কেমন করে?

হেলদি ডায়েট: আপেল খেতে ভালোবাসেন? পুষ্টিগুণ বেশি পেতে দিনের কোন সময়ে খেতে হবে জানেন?

প্রশ্ন করবেন, তবে হঠাৎ কাশি হলে করবটা কি! সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের কাছে ছুটবো! প্রথম দু-চার দিন কোনও ওষুধ না খেয়ে গরম জলের বাষ্প নাক মুখ দিয়ে টানুন দিনে অন্তত বার তিনেক। ঠান্ডা কিছু না খেয়ে কয়েক দিন ইষদুষ্ণ জল বেশি করে খান। কয়েক ফোঁটা মধুও ওই জলে ফেলে দিতে পারেন। তুলসী পাতা বা বাসক পাতার রসও খেতে পারেন। তিন-চারদিন পরেও যদি কাশি না কমে, কিংবা কাশির সঙ্গে অন্যান্য উপসর্গ থাকে তবে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন। মনে রাখবেন দীর্ঘদিন কাশি ল্যারিংস এবং ফুসফুস ক্যানসারের অন্যতম উপসর্গ।

চারপাশে এখন ভয়ংকর দূষণ। ধূমপানের অভ্যাস থাকলে ছেড়ে দিন। খোলামেলা পরিবেশে থাকার চেষ্টা করুন। ধোঁয়া ধুলোবালি যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন। বাড়ি থেকে বার হলে মুখে অবশ্যই মাক্স ব্যবহার করবেন। শিশুদের কাশি হলে শুরুতেই সাবধান হবেন। শেষ কথা হল, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া বোতল বোতল কাফ সিরাপ কিনে খাবেন না।
* এগুলো কিন্তু ঠিক নয় (Health Tips): ডাঃ অমিতাভ ভট্টাচার্য (Amitava Bhattacharrya), বিশিষ্ট স্বাস্থ্য বিজ্ঞান লেখক। পেশায় কান নাক গলা (ক্যানসার) বিশেষজ্ঞ হলেও মানুষটি আদতে ভীষণ আড্ডাবাজ এবং নাটক প্রাণ। এ পর্যন্ত ছোট বড় মিলিয়ে শতাধিক নাটক লিখেছেন। পরিচালনা করেছেন ৩০টিরও বেশি নাটক। দূরদর্শন এবং আকাশবাণীর অভিনয় পুরস্কার পেয়েছেন। বেলঘরিয়া থিয়েটার আকাডেমি নামে নিজে একটি নাটকের দল পরিচালনা করেন। দে’জ পাবলিশিং থেকে এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫২। নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন বছর ভর।

Skip to content