ছবি সংগৃহীত।
মায়ের মুখে সব ঘটনা শুনে অষ্টাবক্র সেই রাতেই মাতুল শ্বেতকেতুকে বললেন, ‘হে মাতুল! চলো আমরা জনকরাজার সভায় যাই। শুনেছি সেখানে তিনি নাকি এক মস্ত যজ্ঞের আয়োজন করেছেন, যেখানে বহু ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের সমাগম হয়েছে। সেখানে গেলে পণ্ডিতদের শাস্ত্রীয় বিচারসভায় অংশ নেওয়া যাবে আবার রাজার রাজ্যে উত্কৃষ্ট অন্নভোজনও সম্ভব হবে। সেখানে গেলে আমাদের কল্যাণই হবে।’ শ্বেতকেতু অষ্টাবক্রের এই প্রস্তাবে রাজি হলেন। তারপর দু’জনে মিলে চললেন জনকরাজার রাজসভার পথে।
এদিকে রাজা জনকের রাজ্যে যজ্ঞ উপলক্ষ্যে মহা জাঁকজমক। সেখানে নিমন্ত্রিত কতশত লোকজন। বিকৃতদেহী অষ্টাবক্র মাতুল শ্বেতকেতুর সাথে রাজবাড়ির দুয়ারে এসে পৌঁছতেই দ্বারপাল বাধা দিল। ঢুকতে দেবে না সে। অষ্টাবক্র জন্মবধি জ্ঞানী ছিলেন। তিনি যুক্তিসঙ্গত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ব্রাহ্মণকে অবশ্যই সবার আগে পথ ছেড়ে দেওয়া উচিত। রাজা জনক অদূরেই ছিলেন। দৃঢ় সেই কণ্ঠস্বর তাঁর কানে গেল। তিনি স্বয়ং আদেশ দিলেন, ‘এই বালক ঠিকই বলেছে। ব্রাহ্মণের গতিরোধ করা উচিত নয়। এই বালককে প্রবেশ করতে দাও।’ রাজা জনক বুঝতে পেরেছিলেন, এই বালক বড় সামান্য বালক নয়।
আরও পড়ুন:
মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৫৩: পিতার অভিশাপ—জন্ম হল অষ্টাবক্র বালকের
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩৪: শুধু কি পিতৃবিয়োগব্যথা লাভ ভরতের, না কি আরও দুঃখ অপেক্ষমাণ…
বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৬: নাগদেবী কাহন ও দ্বিমুখী লড়াই
অন্যদিকে রাজা তো আদেশ দিয়ে আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। দ্বারপাল রাজার আদেশ পাওয়া সত্ত্বেও বালককে এত সহজে ছেড়ে দিতে রাজি হল না। সে বলে উঠল, ‘হে বালক! আমি বন্দিনামক বরুণপুত্রের আজ্ঞাবহ। এই যজ্ঞস্থলে বরুণপুত্র বন্দীই নিয়ন্ত্রণ করছেন যে, এখানে কে প্রবেশ করতে পারে আর কার প্রবেশাধিকার নেই। বন্দী আমায় জানিয়েছেন, এই যজ্ঞস্থলে একমাত্র পণ্ডিত বৃদ্ধ ব্রাহ্মণদেরই প্রবেশাধিকার। তুমি ছোট বালক হয়ে কীভাবে এখানে প্রবেশের ইচ্ছা করছো?’ অষ্টাবক্র বলে ওঠেন, “হে দ্বারপাল! বয়সে বালক হলেও আমি শাস্ত্র পড়েছি। সুতরাং আমি বয়োবৃদ্ধ না হলেও জ্ঞানবৃদ্ধ। বালক বলে আমায় তুমি অবজ্ঞা করতে পারো না। কারণ, ‘বালোঽপ্যগ্নির্দহতি স্পৃশ্যমানঃ’। আগুন ছোট হলেও দগ্ধ করে।” দ্বারপাল একথা শুনে ক্রুদ্ধ হল। বালকের প্রগল্ভতায় সে তিরস্কার করে উঠল। অষ্টাবক্র বললেন, “আমি এই রাজসভায় বন্দীকে দেখবার জন্যই এসেছি। তুমি আমায় প্রবেশের অনুমতি দাও। ভবিষ্যতে বিচারসভায় তুমি আমাকেও পণ্ডিতদের সাথে বিচার করতে দেখবে আর বন্দীকে পরাস্ত হতেও দেখবে।”
আরও পড়ুন:
ত্বকের পরিচর্যায়: দাদের সমস্যায় জেরবার? এই সব মানলে সারবে অসুখ
পর্দার আড়ালে, পর্ব-২৬: উত্তম কাছে এসে বললেন, “তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি সাবু, এ বার আমায় মাফ করে দে”
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৬: কানে খোল, তেল দেন?
দ্বারপাল একথা শুনে থমকে গেল। তারপর বলে উঠল, “তুমি যা বললে, তা কি করে সম্ভব?ঠিক আছে, এতে করে বলছ যখন, আমি তোমার রাজসভায় প্রবেশের ব্যবস্থা করে দেব।” অষ্টাবক্র অনুমতি রাজসভায় পেলেন। রাজার মুখোমুখি হলেন তিনি। তারপর নির্ভীক স্বরে বলে উঠলেন, “হে রাজন! আপনার রাজসভায় যে বিচারসভা বসে, তাতে বন্দী পরাজিত প্রতিপক্ষকে জলে ডুবিয়ে হত্যা করছেন, একথা আপনি জানেন কি?” অষ্টাবক্র বলে চলেন, “এমন ঘটনা জানবার পর আমি বন্দীর সাথে সাক্ষাত্ করতে এসেছি। আমি তার সাথে বিচারে প্রবৃত্ত হতে চাই।’ রাজা জনক বালককে নিবৃত্ত করবার ইচ্ছায় বলে ওঠেন, “হে বালক! তুমি বন্দীর বিদ্যাবত্তা না জেনেই এ কথা বলছ। বন্দী বহু ব্রাহ্মণকে বিচারে পরাস্ত করেছেন।” রাজার সাবধানবাণী শুনেও অষ্টাবক্র নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫১: বিয়েশাদির ঠাকুরবাড়ি
বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-৪: সত্তরের হীরের টুকরো
অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৬: যে কোনও ভাবে নিজেকে উৎসর্গ করাই ঈশ্বর লাভের উপায়
রাজা বালকের বিদ্যাবত্তা পরীক্ষার ইচ্ছাতে তাকে কিছু প্রশ্ন করেন, যে প্রশ্নের উত্তর যথার্থ পণ্ডিতব্যক্তি ছাড়া কারো পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। বালক অষ্টাবক্র অবলীলায় সেসব প্রশ্নের উত্তর দেন। রাজা মুগ্ধ হন। তিনি বলে ওঠেন, “হে বালক! তুমি সাধারণ নও। আমি তোমায় বাক্পটুত্বে মুগ্ধ। তোমায় ছেড়ে দিলাম।” অষ্টাবক্র পিতার মৃত্যুসংবাদ শোনা অবধি হৃদয়ে রাগ পোষণ করছিলেন। তিনি রাজাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “হে রাজন! আমি বন্দীকে চিনি না। আপনি দয়া করে আমাকে তার কাছে উপস্থিত করুন।” অবশেষে সেই মুহূর্ত এল। যজ্ঞসভায় বিচারের আসরে মুখোমুখি বসলেন পণ্ডিত বরুণপুত্র বন্দী আর বালক অষ্টাবক্র।
* মহাভারতের আখ্যানমালা (Mahabharater Akhayanmala – Mahabharata) : ড. অদিতি ভট্টাচার্য (Aditi Bhattacharya) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।