শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: গৌতম চট্টোপাধ্যায়।

অপাত্রে তৈল মর্দন আমাদের মজ্জাগত। অন্য দেশে তেলের স্থান শুধু খাদ্য তালিকায়। অথচ আমরা নাকে, কানে, নাভি দেশে এবং অবশ্যই দেহ ত্বকে ও চুলে যথেচ্ছ তৈল মর্দন করে থাকি। তবে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চুল এবং দেহে তেলের ব্যবহার কমতে থাকলেও কানে এখনও কারণে অকারণে তেল দেওয়া হয়ে থাকে। এর পিছনে প্রচলিত বিশ্বাস হল, তেল কানে খোল জমতে দেয় না, কানের খোলকে নরম করে। কিন্তু সত্যি কি তাই!
বিস্তারিত আলোচনায় যাবার আগে কানের গঠন নিয়ে দু’ চার কথা বলি। কানে তিনটে অংশ। বহিঃকর্ণ: যা শুরু হয় কানের পাতা থেকে, শেষ হয় কানের পর্দায়। কানের পর্দার ওপারে থাকে মধ্যকর্ণ এবং মধ্যকর্ণর পর থাকে অন্তঃকর্ণ। শব্দ বাতাস বাহিত হয়ে কানের সুড়ঙ্গ ধরে কানের পর্দায় গিয়ে ধাক্কা খায়, তারপর শব্দ তরঙ্গ মধ্যকর্ণর ছোট ছোট তিনটি হাড় বেয়ে পৌঁছে যায় অন্তঃকর্ণে। এখানে শব্দ তরঙ্গ বিদ্যুৎ তরঙ্গে রূপান্তরিত হয়ে কানের শ্রবণ স্নায়ু বা অডিটরি নার্ভ ধরে মস্তিষ্কের শ্রবণ অঞ্চল বা অডিটরি এরিয়াতে পৌঁছে যায়। এই অঞ্চলের নির্দেশেই আমরা কানে শুনি।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫: সত্যিই কি মায়ের দয়ায় পক্স হয়?

ডায়েট ফটাফট: না খেয়ে নয়, বরং খেয়েই কমান ওজন! কী কী খেলে মেদ ঝরবে? দেখুন ভিডিয়ো

খোল জমে বহিঃকর্ণের সুড়ঙ্গ পথে। কানের পর্দা অন্য কেউ টেনে ধরলে বাদামি রঙের খোল সহজেই চোখে পড়ে। আমাদের কানের সুড়ঙ্গ পথে বেশ কিছু গ্ল্যান্ড বা গ্রন্থি থাকে, যেগুলো থেকে তৈলাক্ত ক্ষরণ হয়। তার ফলে কানের সুড়ঙ্গ পথ কখনই শুকিয়ে যায় না, ধুলোবালি বা কোনও জীবাণু সহজে কানে ঢুকতেও পারে না। ঢুকলে সেগুলো ওই তেলেই আটকে যায়। এক কথায় এই কানের গ্ল্যান্ডগুলো কানের সুড়ঙ্গের সুরক্ষার কাজ করে। সপ্তাহে একদিন একটু বাডস দিয়ে কানের সুড়ঙ্গটা বুলিয়ে নিলে কান সহজেই পরিষ্কার হয়ে যায়।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৩: মোর সাধের বাসরে ঘটল ‘গৃহ প্রবেশ’

স্বাদে-গন্ধে: রোজকার খাবার একঘেয়ে হয়ে গিয়েছে? বাড়িতে সহজেই বানিয়ে ফেলুন সুস্বাদু পালং পনির

মায়েরা ছোট শিশুর কান নিয়ে খুবই বিব্রত থাকেন। তাই প্রায়ই কান টেনে টেনে দেখেন খোল জমেছে কিনা! যদি তৈলাক্ত কিছু দেখতে পান, সেটা খুঁচিয়ে বার করার চেষ্টা করেন এবং প্রায় ক্ষেত্রেই বিপত্তি ঘটান। ডাক্তারের কাছে ছুটে এসে বলেন, ওর কানে প্রচুর খোল জমেছে, সেজন্য ব্যথায় কান্নাকাটি করছে। তাই আমি বার করার চেষ্টা করেছিলাম। আগেই বলেছি, কানের সুড়ঙ্গের বিভিন্ন গ্ল্যান্ডের তৈলাক্ত ক্ষরণ কানকে ঠিক রাখার জন্য দরকার। এটাকে ময়লা জমেছে ভেবে খোঁচাখুঁচির কোনও দরকার নেই। তাছাড়া ছোট শিশুরা তো রাস্তাঘাটে ঘুরেফিরে বেড়ায় না, যে বাইরের ময়লা তার কানে ঢুকে যাবে। কাজেই অন্তত ৩-৪ বছর বয়স পর্যন্ত এ নিয়ে বেশি চিন্তাভাবনা না করাই ভালো।
আরও পড়ুন:

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৫৩: পিতার অভিশাপ—জন্ম হল অষ্টাবক্র বালকের

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩৩: শোকস্তব্ধ অযোধ্যানগরী কি আপন করে নিল ভরতকে?

মায়েরা প্রশ্ন করতেই পারেন, কানের ব্যথায় বাচ্চা কান্নাকাটি করে তো কানে খোল জমলেই, তখন কী করব! খোল নয়, বাচ্চা কানের ব্যাথায় কান্নাকাটি করে কানে ঠান্ডা লাগলে এবং এই ঠান্ডা ঢোকে নাক ও গলা দিয়ে অর্থাৎ নাক-গলায় কোনও সংক্রমণ হলে, সেটা সরাসরি মধ্যকর্ণে চলে যায়। কানের পর্দার উপর চাপ পড়ে, কানে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। এ জন্য ব্যথা কমার সিরাপ, অ্যালার্জির ওষুধ, অ্যান্টিবায়োটিক এবং নাকের ড্রপ দিয়ে চিকিৎসা করতে হয়। কান খুঁচিয়ে নয় বা কানে কোনও ড্রপ দিয়েও নয়। শিশু একটু বড় হলে যখন স্কুলে যাতায়াত শুরু করে, রাস্তাঘাটে বার হয়, তখন বাইরের ধুলোবালি ঢুকে কানের ভিতরের তেলে আটকে যেতেই পারে। নিয়মিত কান পরিষ্কার না করলে এর থেকে সংক্রমণ হয়ে কান ব্যথাও হতে পারে। আবার দীর্ঘদিন জমে থাকা খোলে হঠাৎ করে জল ঢুকলে, সেই জল আটকে গিয়ে কানের খোল ফুলে গিয়ে কানে তালা ধরতে পারে, ব্যথা হতে পারে, রস গড়াতে পারে। একমাত্র ডাক্তারবাবুই কান পরীক্ষা করে বলতে পারেন, কানে ব্যথার সঠিক কারণ কী!
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৬: যে কোনও ভাবে নিজেকে উৎসর্গ করাই ঈশ্বর লাভের উপায়

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪১: মৎস্যজীবীদের মীন সংগ্রহে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিলে প্রচুর অপচয় কমবে, রক্ষা পাবে মাছের জীব বৈচিত্র্যও

শিশুর কানে হঠাৎ ব্যথা হলে করবেনটা কি! হাতের কাছে তো আর ডাক্তার পাবেন না। উত্তরটা অনেকেই দেবেন, কেন ঘরে তো সরষের তেল আছে, একটু গরম করে কানে ঢেলে দেব। এ কাজ কখনই করবেন না। সরষের তেল কখনই কানে ব্যথার ওষুধ নয়, সে ঠান্ডা করেই দিন বা গরম করেই দিন। গরম তেল থেকে শিশুর কানের সুড়ঙ্গ বা পর্দা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বরং শুকনো সেঁক দেবেন শিশুর কানের উপর। একটা রুমাল ভাঁজ করে নিয়ে হ্যারিকেন, চাটু, ইলেকট্রিক ইস্ত্রি বা ওভেনে অল্প গরম করে নিয়ে শিশুর কানের উপর আলতো করে সেঁক দেবেন। গরমটা ঠিকঠাক আছে কিনা সেটা পরীক্ষার জন্য প্রথমে নিজের কানের উপর দিয়ে দেখে নিতে পারেন। মিনিট পাঁচেক দিলেই বাচ্চা আরাম বোধ করবে। প্যারাসিটামল জাতীয় সিরাপ বয়স অনুযায়ী বাচ্চাকে খাইয়ে দেবেন। যদি দেখেন সর্দিতে নাক বন্ধ হয়ে রয়েছে, নাকের দুটো ফুটোতে এক ফোঁটা এক ফোঁটা করে দু’ ফোঁটা ড্রপ দেবেন। বাকি চিকিৎসার ভার ডাক্তারের উপর ছেড়ে দিন।
আরও পড়ুন:

ছোটদের যত্নে: সদ্যোজাতকে স্তন্যপান করানোর সময় কোন কোন বিষয় মাথায় রাখবেন? রইল শিশু বিশেষজ্ঞের মতামত

পর্ব-৩, বসুন্ধরা এবং…/২য় খণ্ড: লিখতে বসে সুবর্ণর মনে হয়েছে ‘বসুন্ধরা এবং…’ তার কনফেশন বক্স …

যদি সত্যিই কানে খোল জমে ব্যথা হয়, ডাক্তারবাবু কান পরীক্ষা করে খোল নরম করার ড্রপ ২-৩ ফোঁটা করে পরপর তিন-চার দিন কানে ব্যবহার করতে বলেন। দ্বিতীয়বার ডাক্তারবাবুর কাছে গেলে তিনি অরাল সিরিঞ্জে (ছোট পিচকিরি) জল ভরে কান ওয়াশ করে ময়লা বার করে দেন। এতে না লাগে ব্যথা, না হয় কানের কোনও ক্ষতি। অনেকে ডাক্তারবাবুকে এসে বলেন, কানের খোল বার করার সেই ড্রপটা লিখে দিন ডাক্তারবাবু, যেটা দিলে সঙ্গে সঙ্গে ভুস ভুস করে কানের ময়লা বার হয়ে আসবে! একসময় হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড-যুক্ত এই ড্রপ সত্যিই বাজারে পাওয়া যেত। কিন্তু এটা ব্যবহারে কানের ক্ষতি হয় বলে, এখন আর ডাক্তারবাবুরা এটা প্রেসক্রাইব করেন না। আর তাছাড়া ড্রপ দেবার সঙ্গে সঙ্গেই কানের ময়লা লাফাতে লাফাতে বাইরে বেরিয়ে আসবে, এটা ভাবারও কোনও কারণ নেই। খোল বা ময়লা নরম করার জন্য সময় দিতে হয়, তারপর সেটি বার করার ব্যবস্থা করা হয়।
আরও পড়ুন:

স্বাদে-গন্ধে: একঘেয়ে কাতলা? স্বাদবদল করুন ‘কমলা কাতলা’ রেসিপিতে! রইল সহজ রেসিপি

দশভুজা: যে গান যায়নি ভোলা— প্রাক জন্মদিনে তাঁর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য…/১

শেষ কথা হল, কান ব্যথা কিংবা কান বন্ধ হয়ে যাওয়া অনেক কারণেই হতে পারে। সঠিক কারণ নির্ণয় করে তার চিকিৎসা করতে হবে এবং যেটি করবেন একজন ডাক্তারবাবু। আপনি অযথা কানে তেল দিতে যাবেন না, আপনার শিশুর কানেও দেবেন না। ব্যথা হলে কানে শুকনো গরম সেঁক দেবেন, ব্যথা কমানোর কোনও ওষুধ খাবেন। ছোট শিশুর কান রোজ খুঁচিয়ে পরিষ্কার করার কোনও দরকার নেই। কানে দুধ ঢুকে গিয়ে কান ব্যথা হচ্ছে, এমন শিশুও আমরা খুব কমই পাই। মনগড়া কোনও ধারনা না করে, কোনও অসুবিধা হলে আপনার শিশুকে নিয়ে বরং ডাক্তারবাবুর কাছেই যাবেন।
* এগুলো কিন্তু ঠিক নয় (Health Tips): ডাঃ অমিতাভ ভট্টাচার্য (Amitava Bhattacharrya), বিশিষ্ট স্বাস্থ্য বিজ্ঞান লেখক। পেশায় কান নাক গলা (ক্যানসার) বিশেষজ্ঞ হলেও মানুষটি আদতে ভীষণ আড্ডাবাজ এবং নাটক প্রাণ। এ পর্যন্ত ছোট বড় মিলিয়ে শতাধিক নাটক লিখেছেন। পরিচালনা করেছেন ৩০টিরও বেশি নাটক। দূরদর্শন এবং আকাশবাণীর অভিনয় পুরস্কার পেয়েছেন। বেলঘরিয়া থিয়েটার আকাডেমি নামে নিজে একটি নাটকের দল পরিচালনা করেন। দে’জ পাবলিশিং থেকে এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫২। নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন বছর ভর।।

Skip to content