শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী

এখন সাপেরা সব শীত ঘুম দিচ্ছে। তাই তাদের দেখা যাচ্ছে না বটে কিন্তু উত্তর চব্বিশ পরগণার বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে যাওয়া ট্রেনে কিছু নারী মনসার পালাগান গেয়ে টাকা রোজগারের চেষ্টা করছেন। মূলত নারীরাই বর্ষাকালের আগমনের আগে পরিবারের মঙ্গল কামনায় টাকা দিয়ে তুষ্ট করছেন এই দেবতাকে। আর এই পালাগানের লোকজনও মহিলা। এঁরা মূলত লেডিজ কম্পার্টমেন্টেই ওঠেন।

তবে এখন সরীসৃপকে দেখতে পাওয়া যায় কম, আর দেখা গেলে যে হুলুস্থুল পরিস্থিতি তৈরি হয় তখন আর গল্প নয়, সাপের বিষের গল্প শরীরে মনে ভয় ধরায়। এই দৃশ্যপট আপাত অর্থে খুব সাধারণ মনে হতে পারে। কিন্তু একটু ভাবতে বসলে মনে পড়ে বেহুলা-লখিন্দরের কথা। এক সর্প দেবীর কথা, যিনি মূলত নিজের জীবনের একটি বড় পর্ব লড়াই করে বেঁচেছেন নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। আর বেহুলা বাঙালি সমাজে একটি প্রতিষ্ঠিত নাম, যিনি স্বামীর প্রতি স্ত্রীর দায়িত্ব কী হতে পারে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন এই গল্পের মধ্যে দিয়ে। এই আখ্যানে দুই নারীর দুই বিপরীতমুখী লড়াইয়ের গল্প বলা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে আজকের দিনে বিরোধ-জবানিতে কি শুধু আমরা দেবীর প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লড়াইকে আদি লড়াই বলে কুর্নিশ জানিয়ে ক্ষান্ত হব? না, আমার মনে হয়েছে এই দ্বিমুখী লড়াইয়ের পাশাপাশি যেমন নারীর সামাজিক অবস্থান বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই আমাদের সামাজিক কাঠামোর বেশ কিছু বিষয় এবং তার বিবর্তনকে নিয়ে পর্যালোচনারও দরকার আছে। এই পর্যালোচনা আমাদের সমাজ কাঠামোকে বুঝতে সাহায্য করবে এবং সংগ্রামের ধারাকে পুনর্নির্মাণের প্রয়োজন আছে কিনা সেটাও বুঝিয়ে যাবে। অনেকে বলবেন, একটি মধ্যযুগীয় আখ্যান কীভাবে আমাদের সাহায্য করতে পারে, যেখানে সমাজের কাঠামো আলাদা ছিল, আর রাষ্ট্রের কাঠামো ছিল মধ্যযুগীয় ইতিহাসের লেখ অনুযায়ী।

এছাড়াও একটি আধিভৌতিক অর্থাৎ যেখানে এই সময়ের মানসিক চেতনায় ঐশ্বরিক বিষয়ের প্রাধান্য বেশি আছে, সেখানে আমরা আধুনিক সমাজের যুক্তি খুঁজে পাবো কীভাবে? দেবতা নির্মাণ প্রক্রিয়া কতটা আমাদের দিশা দেখাতে পারে?
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৫: আমরা জাতির পিতাকে পেলেও, মাতাকে পেলাম না— কেন?

ডায়াবিটিস বাগে আনতে কোন প্রোটিন খেতেই হবে, আর কী কী এড়াতেই হবে?

পর্দার আড়ালে, পর্ব-২৫: নচিকেতা ঘোষ দেখলেন শান্তাপ্রসাদের হাতের সঙ্গে বোল মিলছে না, সুরকার নিরুপায় হয়ে ডাকলেন তবলা বাদক রাধাকান্তকে

মনসা দেবীর আখ্যান মধ্যযুগীয় মোড়কে মোড়া হলেও যে ভাবে লেখা হয়েছে এবং যে বিস্তীর্ণ সময় ধরে বহু কবির লেখনী দিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে, সেই ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় পূর্ব ভারতে মাতৃতান্ত্রিক অনার্য সমাজের সঙ্গে পিতৃতান্ত্রিক আর্য সমাজের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে সংশ্লেষ হয়েছে। অর্থাৎ আর্য এবং অনার্য সমাজ পরস্পরের সঙ্গে সমঝোতা করেছে। সেই সমঝোতা মূলত আজকের ভাষায় নলেজ ট্রান্সফার করা। উভয় সমাজ বুঝেছিল এই পূর্ব ভারতে জল,জঙ্গল, কাদায় টিকে থাকতে হলে কিছু কৌশল রপ্ত করতে হবে। অনার্যরা আগে থেকে এই অঞ্চলে থাকার কারণে কিছু কৌশল তৈরি করতে পেরেছিল।

আর্যদের সেই কৌশল দরকার পড়ল বেঁচে থাকার জন্য। সেই সংযুক্তিকরণ বা পরস্পর নলেজ ট্রান্সফার প্রক্রিয়াতে আর্যরা শিখল কৃষিকাজের ফলে উৎপাদিত খাদ্য সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ কি ভাবে করতে হয়, যা মূলত মাটির হাঁড়িতে হতো। তখন শস্য ছিল ধনসম্পদ এবং মাটির তলায় রাখা হতো মাটির হাঁড়িতে। সাপও থাকে মাটির তলায়। আধিভৌতিক মন মানুষ জানালো সাপ রক্ষা করে সম্পদ আর মাঠে ইঁদুর খায়। সাপ তাই মাতৃসম। সাপকে মনে করা হল তাই উর্বরতা বা ফার্টিলিটির প্রতীক। তাই বংশরক্ষা করার দেবী। সেই সূত্রে পরিবারে নারীর ভূমিকা, অর্থাৎ নারী এবং তার উৎপাদন শক্তি ইত্যাদি বিষয়ে দু’পক্ষই অনেক বেশি আগ্রহী হয়ে পড়েছিলেন। তাই মাটির হাঁড়ি কে মনসা রূপে পূজো করার চল আছে এখনও। তবে বর্তমান কালে মাটির হাঁড়ির ব্যবহার কমে গেলেও পরিবারে নারীর ভূমিকা এবং তার সন্তান ধারণের ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে যে রাজনীতি চলে তার সেরকম কোনও পরিবর্তন চোখে পড়ছে না।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫: মেরুর দিকে পৃথিবী কিছুটা চাপা, তাই এখানে দুটি কাছাকাছি অঞ্চলের মধ্যেও সূর্যালোকের পার্থক্য অনেকটা

স্বাদে-গন্ধে: রোজকার খাবার একঘেয়ে হয়ে গিয়েছে? বাড়িতে সহজেই বানিয়ে ফেলুন সুস্বাদু পালং পনির

দশভুজা: সুন্দরবনের অনেক শিশুর শিক্ষার অধিকার রক্ষায় ব্রতী এই শিক্ষিকা

বেহুলার সংগ্রামের কাহিনীর আগেও গল্পের শুরুতে মনসা দেবীর জন্ম বৃত্তান্ত লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, তিনি শিবের সন্তান কিন্তু বিবাহবহির্ভূত। বিবাহবহির্ভূত সন্তানকে সমাজে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রক্রিয়াতে দেখা যাচ্ছে শিবের স্ত্রী চণ্ডী, যিনি একগামি মানে একজন পুরুষ একজন নারী কে বিয়ে করবেন, বিবাহতে অভ্যস্ত। তিনি শিবের বহুগামীতা নিয়ে ব্যাস্ত হচ্ছেন এবং অভিশাপ দিচ্ছেন। মনসা জন্মলগ্ন থেকে তাই ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত এক নারী। কিন্তু শিব সবরকম ভাবে সাহায্য করে একজন বোনের জন্মও দিচ্ছেন, যাতে একাকী আরও অতলে না তলিয়ে যায়। এই ঘটনা পরম্পরা থেকে বোঝা যায় মধ্যযুগেও নারীর বৈবাহিক জীবন অনেকটাই জটিল ছিল। প্রত্যেক নারী বহু বিবাহের কারণে নিজেদের অস্থিত্ব বজায় রাখার জন্য নানা রকম উপায় অবলম্বন করতে হতো। তাঁদের কাছে সহজ উপায় ছিল শারীরিক অত্যাচার করা স্বামীর অন্য সন্তানদের উপর। মনসার উপর সেই অত্যাচার হতে মনসা প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হন এবং বিষের প্রয়োগ ঘটান।

মৃত স্ত্রীকে দেখে শিব শোকপ্রকাশ করতে গিয়ে বলেই ফেলেন পুত্রের থেকে বেশি ভালোবাসা দিয়েছেন তিনি কন্যাকে। কিন্তু স্ত্রী অহংকারী হয়ে পড়ায় তাঁকে এই দিন দেখতে হল। শিব এরপর কাঁদতে শুরু করলে নারদ বলে ওঠেন যে, শিবের লজ্জা হওয়া উচিত এই রকম ভাবে কান্নাকাটি করার জন্য। পুরুষমানুষের সেই যুগেই পৌরুষ আয়ত্ত করতে হয়েছে নিজেকে সিংহের ন্যায় শক্তিশালী প্রমাণ করে। তবে মনসা এবং শিব দুজনেই পরস্পরের প্রতি সহানুভুতি প্রকাশ করার সঙ্গে এই বিষয়টিও মেনে নিতে বাধ্য হন যে, সমাজে টিকে থাকতে গেলে কতগুলি ন্যায়-নীতিবোধকে মেনে চলতে হবে যা মূলত পিতৃতান্ত্রিক।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩৩: শোকস্তব্ধ অযোধ্যানগরী কি আপন করে নিল ভরতকে?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫০: লুকোনো বই পড়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ বাক্সের চাবি চুরি করেছিলেন

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৫৩: পিতার অভিশাপ—জন্ম হল অষ্টাবক্র বালকের

মাতৃ হত্যা করা ভালো কাজ নয়, যতই তিনি অত্যাচার করুন না কেন। ভারতীয় পারিবারিক কাঠামোর মধ্যে যে লিঙ্গ-বৈষম্য প্রথিত হয়েছে তার অন্যতম রূপ হল হিংসা। মনসার উপর এই শারীরিক অত্যাচার সেই বৈষম্যকেই আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়।

গল্পের মোড় এর পর ঘুরে যাচ্ছে মনসার বিয়েকে কেন্দ্র করে। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা পাত্রস্থ করার চেষ্টা করেন এবং জরৎকারুকে পাত্র নির্বাচন করেন। কিন্তু এই বিয়ে স্থায়ী হয়নি। কারণ হিসেবে যা বর্ণনা করা আছে তা এখনও আমাদের দেশের একটি সমস্যা। জরৎকারু সন্ধ্যারতি করবেন বলে মনসাকে বাগান থেকে ফুল তুলে আনতে বলেন। অর্থাৎ স্ত্রীয়ের কাছ থেকে তিনি সেবা চাইছেন। মনসা সরাসরি এই কাজ করতে অরাজি হন। মনসা আসলে না না বিদ্যাতে পারদর্শী একজন নারী। তিনি প্রাণ যেমন নিতে পারেন, আবার কাউকে প্রাণ ফিরিয়ে দিতেও পারেন। যিনি এই সব বিদ্যাতে পারদর্শী, একজন স্বাধীনচেতা নারী তিনি বিবাহের অল্প কিছুদিন পরেই এই সেবা করার আদেশ পালন করতে অস্বীকার করেন। যদিও পরে মনসা বিষয়টি মিটিয়ে নিতে চান। কিন্তু জরৎকারু এই রকম প্রতাপশালী নারীর সঙ্গে থাকতে অস্বীকার করেন। মনসা যখন জানান তিনি একা থাকতে পারবেন না, তখন জরৎকারু আশ্বস্ত করেন এই বলে যে তাঁর আট সন্তান হবে।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪১: মৎস্যজীবীদের মীন সংগ্রহে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিলে প্রচুর অপচয় কমবে, রক্ষা পাবে মাছের জীব বৈচিত্র্যও

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৬: যে কোনও ভাবে নিজেকে উৎসর্গ করাই ঈশ্বর লাভের উপায়

শিশুর যত্নে কোন কোন দিকে বিশেষ নজর রাখবেন? জেনে নিন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ

এরকম স্বামী হিসেবে মানসিক ভাবে পাশে না থেকে যা একজন স্বামীর কর্তব্য, নারীর সন্তান পালনের ভূমিকাতেই মনসাকে সন্তুষ্ট থাকতে বলে সরে যান মনসার জীবন থেকে। গল্প আরও এগতে থাকে এবং দেখা যায় মনসাকে কেউ ভালোবেসে নিজের কাছে রাখতে চাইছে না। চণ্ডী রেগে গিয়ে বলেন, স্বামীকে রেখে তিনি বাপের বাড়ি চলে যাবেন যদি মনসাকে বাড়ি থেকে বের করে না দেওয়া হয়। চণ্ডী এতটাই বদ্ধপরিকর ছিলেন যে, তিনি বলেন, দরকার হলে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে চলে যাবেন বাপের বাড়ি। চণ্ডীর মূল অভিযোগ ছিল, মনসা সমাজ নির্দিষ্ট পথে চলতে চান না। নিজের মতো করে চলাতেই আপত্তি উঠছে। স্বামীর সঙ্গে ঘর না করেও পুত্র চাইছেন। এতেও আপত্তি সবার। নারী হয়ে উঠতে পারেনি বলেই মনসাকে নিয়ে এত কথা এত সমালোচনা।

মনসা বনবাসী হয়েও নিজের বাড়ি নির্মাণ করতে সমর্থ হন। এই বিষয়টিও ভাবার আছে যে, মনসা কোনও ভাবেই ভেঙ্গে পড়েনি। নিজেকে কখনই কারও অধীন বা দুর্বল ভাবার অবকাশ রাখেনি। প্রতিটি অবমাননার জবাব তিনি দিয়েছেন।

এই লড়াইয়েরর পাশে যদি বেহুলার সংগ্রামকে তুলনা করা হয়, তাহলে আমরা কী পেতে পারি? বেহুলা স্বামীকে বাঁচানোর জন্য দেবতাদের সামনে নৃত্য পরিবেশন করলেন। প্রবল মানসিক চাপ সামলে নৃত্য পরিবেশন করা এবং মৃত ভাসুরের জীবন ভিক্ষা করা প্রমাণ করে বেহুলা খুব লড়াকু একজন নারী ছিলেন। কিন্তু তাঁর কোন লড়াই আমাদের কাছে গ্রহণীয়? প্রথাগত পিতৃতান্ত্রিক নির্মাণকে সমর্থন করে স্বামী-সংসার বাঁচিয়ে নিজেকে একজন যুগের পর যুগ অনুপ্রেরণাদায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা, নাকি এমন একজন নারী হয়ে ওঠা যিনি প্রতিরোধের শিকল দিয়ে নিজের জন্য গয়না বানিয়ে নিতে পারেন। আপনারাই একটু ভাবুন।

* প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
* বৈষম্যের বিরোধ-জবানি (Gender Discourse): নিবেদিতা বায়েন (Nibedita Bayen), অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, পি আর ঠাকুর গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content