রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


শতরূপা মজুমদার, প্রতিষ্ঠাতা, স্বপ্নপূরণ শিক্ষা নিকেতন।

মাসুম বিড়লা, বয়স ১২-১৩, ছোট বয়স থেকেই স্বাবলম্বী। কারণ, বাড়িতে অসুস্থ বাবা-মাকে নিয়ে তার দিনযাপন। অনবরত জীবনের পরীক্ষা দিয়ে চলা, কঠিন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলা মাসুমের কখনও প্রত্যয়ের অভাব ছিল না। তাই তার স্কুলে যে বারো জন সায়েন্স অলিম্পিয়াড ফাউন্ডেশন পরীক্ষায় যোগ দেয় তার মধ্যে সে একজন। মেডেল এনে দেয় সে তার স্কুলকে। স্কুল মানে মাসুমের মতো অনেক বাচ্চার স্বপ্নপূরণের ইংরেজি মাধ্যম স্কুল- ‘স্বপ্নপূরণ শিক্ষা নিকেতন’। আর সেই স্বপ্নের কান্ডারী হলেন শতরূপা মজুমদার, যিনি বিগত দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকা হিঙ্গলগঞ্জে ইংরেজি মাধ্যমকে আশ্রয় করে বিদ্যালয় শিক্ষার সুস্থ পরিবেশ তৈরি করে চলেছেন, পড়াশোনার অধিকার থেকে যেন ওই অঞ্চলের কোনও শিশু বঞ্চিত না হয় সেই চেষ্টা করছেন।
খাস কলকাতায় বড় হওয়া শতরূপা ছোট থেকে নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ার সুবাদে মাঝে মাঝে শিক্ষিকাদের তত্ত্বাবধানে মাদার টেরেসার হোমে যেতেন। সেখানে যেতে যেতে সেই ছাত্রী বয়স থেকে সমাজসেবামূলক কাজের মন তৈরি হয়। বাড়িতে নিজের মাকে দেখতেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ। যৌথ পরিবারে বড় হয়েছেন। তাঁর বাবাকে তিনি দেখেছেন পরিবারের সকলের দায়িত্ব নিতে। সকলে ভালো থাকুক এমন পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা শতরূপা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে ১৯৯৯ সালে বিয়ের পর যে বাড়িতে গেলেন, সেটাও যৌথ, রক্ষণশীল পরিবার, অনেক কিছু মেনে চলা। এর মধ্যে ২০০২ সালে স্বামীর কাজের সূত্রে তাঁরা মুঘলসরাইয়ের কাছে থাকতে শুরু করেন। সেই প্রথম তাঁর স্কুলে শিক্ষকতা শুরু। তিনি দেখেন তিনি ছাড়া কেউই ইংরেজিতে স্বচ্ছন্দ নয়। মাতৃভাষার বাইরে কেউ অন্য ভাষার প্রতি আগ্রহী নয়। এই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে তিনি কয়েক বছর পর কলকাতায় ফিরে আসেন।
কলকাতায় ফিরে এসে তিনি নিজের ছোট মেয়েকে দেখার পাশাপাশি অ্যাসেম্বলি অব গড চার্চ স্কুল থেকে প্রি প্রাইমারি মেথডস অব টিচিং-এর ওপরে প্রশিক্ষণ নেন। তিনি জানতেন পড়াশোনার কোনও বিকল্প হয় না। তাই পড়ানোর মাধ্যমে কিছু করার ইচ্ছে তাঁর চিরদিনের। মেয়ে, সংসার সবকিছুর মধ্যে জীবনের উদ্দেশ্য কী? এই নিয়ে শতরূপার মনে বারংবার প্রশ্ন আসত। কী করলে জীবনে পূর্ণতা আসবে? এই প্রশ্নগুলো তাঁর মনে বার বার দানা বাঁধত। মুঘলসরাইতে পড়ানোর পর থেকে তাঁর সবসময় মনে হয়েছে যে যদি তাঁর নিজের মেয়ে, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বান্ধব, পরিচিত পরিজনদের ছেলেমেয়েরা মাতৃভাষার পাশাপাশি ইংরেজিতে স্বচ্ছন্দ হতে পারে (বলা ও লেখার ক্ষেত্রে), তাহলে সেইসব বঞ্চিত মানুষেরা যাদের জীবন এক খাতে বয়, বৈচিত্র্য নেই, যাদের জীবনে বঞ্চনা বেশি, পাওয়া কম, তাদের কেন থাকবে না দুটো, তিনটে ভাষা পড়ার, জানার, কথা বলার অধিকার? বার বার মনে হতো সব কাজ সেরে চলে যাওয়ার পর কী থাকবে? কী রেখে যাবেন পরবর্তীর জন্য।
তাঁর মেয়ের যখন দুই বছর বয়স তখন তিনি কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত স্কুলে পড়াতে শুরু করেন। পড়ানোর বিষয় ছিল অর্থনীতি। তিনি নিজে যদিও বাণিজ্য বিভাগে স্নাতকোত্তর পাশ কিন্তু ইংরেজি বিশেষত যোগাযোগের ইংরেজি যার মাধ্যমে ছোটরা সহজ, সরল ইংরেজি বাক্যের মাধ্যমে নিজেদের প্রকাশ করতে পারে সেই ধরনের শিক্ষার প্রচার-প্রসার তিনি নিজের কর্মজীবনে অনবরত করে গিয়েছেন। এর পাশাপাশি কলকাতার স্কুলের চাকরি সামলাতে সামলাতে তিনি নিচিরেন ডাইশোনিনস (Nichiren daishonins) এই বৌদ্ধ উপাসনা পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত হন। যে পদ্ধতি মানুষকে তার নিজের এবং আশেপাশের সকলকে খুশি, সুখী থাকতে সাহায্য করে।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫: মেরুর দিকে পৃথিবী কিছুটা চাপা, তাই এখানে দুটি কাছাকাছি অঞ্চলের মধ্যেও সূর্যালোকের পার্থক্য অনেকটা

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৫: জনজাতি ও জনসত্ত্বা

দশভুজা: রুমা দেবী—তিরিশ হাজার মহিলার ভাগ্য পরিবর্তনের কান্ডারি তিনি

রক্ষণশীল বাড়ির বউ তিনি, নানা নিগড়ে বদ্ধ ছিল তাঁর সংসার। কখনও ভাবেননি শ্বশুরবাড়ির মানুষদের সাহায্য পাবেন। কিন্তু সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেন তাঁর শাশুড়ি মা। পুরো সপ্তাহ কলকাতার স্কুলে পড়ানোর পর বাড়িতে ছোট বাচ্চা রেখে আবার হিঙ্গলগঞ্জে গিয়ে সপ্তাহান্তে বাচ্চাদের পড়ানো, এই রুটিন চলতে থাকে তাঁর ২০১২ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত টানা দু’ বছর।
২০১৪ সালে তাঁর প্রথম স্থানীয় বাসিন্দা আমির হোসেনের (আমির দা) সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি তাঁর বাড়িতে থেকে শতরূপাকে কাজ করতে বলেন। এই মানুষটির প্রত্যক্ষ সাহায্যে স্কুলের কাজ আরও এগোয়। ২০১৫ তে স্কুলের নিজস্ব বোর্ড গঠিত হয়। কলকাতা ও হিঙ্গলগঞ্জের বহু মানুষ তাতে যোগদান করেন। ২০১৬ তে হঠাৎ করেই তাঁর আমির দা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এই মৃত্যু শতরূপার নিকট আত্মীয় বিয়োগের থেকে কিছু কম ছিল না।
এরপর ২০১৮ সালে কলকাতার স্কুলের ভালো মাইনের চাকরি ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে তিনি তাঁর স্বপ্নের ‘স্বপ্নপূরণ শিক্ষা নিকেতন’ এর কাজে ব্রতী হন। শুরুটা হয়েছিল ২০১২ সালে তিনি যখন তাঁর কানাডা নিবাসী মাসির সঙ্গে প্রথম সেলাই মেশিন বিতরণ করতে হিঙ্গলগঞ্জে গিয়েছিলেন। সেদিন প্রথম তাঁকে দেখে সেখানকার মানুষেরা তাদের বাচ্চাদের পড়ানোর জন্য অনুরোধ করতে থাকেন। তিনিও সেই অনুরোধ ফেলতে পারেননি। তাঁর প্রথম থেকে মনে হয়েছিল যে পড়াশোনার সুযোগ তাঁর নিজের মেয়ে পেয়েছে তার ন্যূনতম সুযোগ কি এদের দেওয়া যায় না? শুধু কাদামাটিতে খেলে আর বিড়ি বাঁধার কাজে সাহায্য করেই কি কেটে যাবে এইসব শৈশব?
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫০: লুকোনো বই পড়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ বাক্সের চাবি চুরি করেছিলেন

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫: সত্যিই কি মায়ের দয়ায় পক্স হয়?

স্বাদে-গন্ধে: রোজকার খাবার একঘেয়ে হয়ে গিয়েছে? বাড়িতে সহজেই বানিয়ে ফেলুন সুস্বাদু পালং পনির

কিন্তু ২০১৭ পর্যন্ত যেহেতু স্বপ্নপূরণের পাকা বাড়ি তৈরি হয়নি এবং চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ ছিল। তাই ছাত্রছাত্রীদের বাংলা মাধ্যমের সরকারি স্কুলে চলে যেতে হচ্ছিল। এই সময় অভিভাবকরা বলতে থাকেন যে তাদের ছেলেমেয়েরা পুরো স্কুলজীবন ইংরেজি মাধ্যমে পড়তে পারছে না ফলে শেখা জিনিস তারা ভুলে যাচ্ছে। তাদের তীব্র ইচ্ছায় সাড়া দিয়ে নিজের ছেড়ে দেওয়া চাকরির প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকায় এবং অন্যান্য সহায়তায় ২০১৮ সালে কাটাখালি, হিঙ্গলগঞ্জে (বর্তমানে জোড়া বটতলায়) প্রথম তাঁর স্বপ্নের ‘স্বপ্নপূরণ শিক্ষা নিকেতন’ এর পাকা স্কুল বাড়ি তৈরি হয়। এরপর অতিমারির মধ্যে ব্যানা, পশ্চিম খেজুরবেড়িয়া, ছোট সাহেব খালি ও কালিতলা হিঙ্গলগঞ্জে গড়ে তোলেন স্বপ্নপূরণের আরও চারটি শাখা। বর্তমানে স্বপ্নপূরণের সব শাখা মিলিয়ে তিরিশের কাছাকাছি শিক্ষক শিক্ষিকা নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন। সর্ব মোট ৮১০ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে এগিয়ে চলেছে এই প্রতিষ্ঠান।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪১: মৎস্যজীবীদের মীন সংগ্রহে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিলে প্রচুর অপচয় কমবে, রক্ষা পাবে মাছের জীব বৈচিত্র্যও

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৫: আমরা জাতির পিতাকে পেলেও, মাতাকে পেলাম না— কেন?

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৬: যে কোনও ভাবে নিজেকে উৎসর্গ করাই ঈশ্বর লাভের উপায়

শুধু স্বপ্ন নয়, সেই স্বপ্নকে অতিমারির মধ্যেও দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অর্থাৎ প্রথম লকডাউন শুরু হওয়ার বারো থেকে পনের দিনের মধ্যে যাদের কাছে স্মার্টফোন ছিল তাদের অনলাইন ক্লাস করানো আর যাদের স্মার্টফোন ছিল না তাদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ওয়ার্কশিটের মাধ্যমে পড়াশোনার সঙ্গে যুক্ত করে রাখার মতো কাজ শতরূপা ও তার সহযোগীরা করে গিয়েছেন। আমফানের সময় ঝঞ্ঝা বিধ্বস্ত হিঙ্গলগঞ্জে তারা স্বপ্নপূরণ ওয়েলফেয়ার সোসাইটির (SWS) মাধ্যমে উদয়স্ত পরিশ্রম করেছেন। ত্রিপল, রেশনকিট, রান্না করা খাবার, শুকনো খাবারের যোগান দিয়ে সবরকম ভাবে স্থানীয় মানুষদের সাহায্য করেছেন।
তাদের কাজের ধরন দেখে স্বপ্নপূরণের অন্যান্য শাখা খোলার জন্য অনেক মানুষ এগিয়ে এসে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে জমি দান করেছেন। সুন্দরবনের প্রথম সায়েন্স ল্যাব ‘স্বপ্নপূরণ শিক্ষা নিকেতন’ এ গড়ে উঠেছে। তাই সব শিশু যেন পড়াশোনার অধিকার পায়, সকলে যেন পড়াশোনাকে ভালোবাসে এই লক্ষ্যপূরণেই শতরূপা এগিয়ে চলেছেন ও চলবেন।

সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে লিখিত।
* দশভুজা (women – Special Article) : ড. বিদিশা মিশ্র (Bidisha Misra), সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ। বিদিশা বাঙালি নৈয়ায়িক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য্যের গ্রন্থ কাব্যবিলাসের উপর গবেষণা করেছেন। দেশের বিভিন্ন প্রদেশের পত্রিকায় তাঁর শোধপত্রগুলো প্রকাশিত হয়েছে।

Skip to content