সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী। সংগৃহীত।

মহাভারত মানে তো আর শুধু কৌরবপাণ্ডবদের গল্প নিয়ে হয়! মহাভারত টুকরো টুকরো অজস্র গল্পের ধারাবিবরণী যেন। কথক বলেন, শ্রোতা শোনেন। এক এক গল্পের সূত্র ধরে জুড়ে যায় আর এক গল্প। তৈরি হয় আখ্যানমালা। যুধিষ্ঠিরের বনযাত্রা পথে কথকঠাকুর লোমশমুনির বয়ানে আজ আর এক গল্প। এ গল্পের চরিত্রেরা হলেন উদ্দালকমুনি, তাঁর ছেলে শ্বেতকেতু এবং শ্বেতকেতুর ভাগিনেয় অষ্টাবক্রমুনি। বিচিত্র দেশ ভারতবর্ষ। সেই ভারততীর্থপথে যাত্রা করেছেন যুধিষ্ঠির।

এ যাত্রার আনাচেকানাচে কত রাজার কত ইতিহাস, কত মুনিঋষির কত না তপোবিজড়িত ভূমি ছড়িয়ে রয়েছে। লোমশমুনির মতো তীক্ষ্ণ স্মৃতিধর মুনিবর যেখানে যাত্রাসঙ্গী সেখানে তীর্থযাত্রাতেও যেন কোনো ফাঁক থাকার সম্ভাবনাই নেই। মুনি বলে চলেন, যুধিষ্ঠির পথ চলতে চলতে একাগ্র চিত্তে সেসব অশ্রূতপূর্ব আখ্যান শুনতে শুনতে কখন যেন তীর্থের সঙ্গে, ঘটে যাওয়া ঘটনার সাথে একাত্ম হয়ে যান।
সে ত্রেতাযুগের কথা। সে সময় মহর্ষি উদ্দালকের কহোড় নামধারী এক শিষ্য ছিলেন। তিনি অত্যন্ত বিনয়ী আর বাধ্য ছাত্র ছিলেন। গুরু তাঁর সেবায় তুষ্ট হয়ে মনপ্রাণ ঢেলে শিষ্যকে শাস্ত্রজ্ঞানদান করেন। নিজের কন্যা সুজাতাকেও কহোড়ের হাতে সমর্পণ করেন। বিবাহের কিছুদিন পর সুজাতা গর্ভবতী হলেন। বেদাধ্যায়ী পিতার প্রতিদিনের শাস্ত্রাধ্যয়নে সুজাতার গর্ভস্থ সন্তান সর্বশাস্ত্রে পারদর্শী হয়ে উঠেছিল।
আরও পড়ুন:

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৫২: উশীনরের ধর্মভাব পরীক্ষা করলেন বাজরূপী ইন্দ্র

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫০: লুকোনো বই পড়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ বাক্সের চাবি চুরি করেছিলেন

একদিন সুজাতার সেই সন্তান গর্ভস্থ অবস্থাতেই পিতাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, ‘হে পিতঃ! আপনার পাঠ যথাযথ হচ্ছে না।’ পিতা কহোড় সকলের সামনে ভূমিষ্ঠ না হওয়া সন্তানের মুখে এমন কথা শুনে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি বলে উঠলেন, ‘মাতৃজঠরে থাকাকালীনই যখন তুমি পিতৃনিন্দা করছ, তোমার জন্ম হতেই শরীরের আটটি জায়গা বাঁকা হবে।’ পিতার অভিশাপে বালক এমন বিকৃত হয়েই জন্ম নেয়। পরবর্তীকালে তিনি অষ্টাবক্র নামে প্রসিদ্ধ হন। উদ্দালকমুনির পুত্র শ্বেতকেতু আর সুজাতার এবং কহোড়ের পুত্র অষ্টাবক্র সমবয়স্ক ছিলেন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২২: স্বপ্নের সারথি পাঠিয়েছেন ‘বকুল’ ফুল

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪: ভাবলাম এ যাত্রায় কোনও রকমে বাঁচা গেল, কিন্তু এতো সবে সন্ধ্যে! রাত তখনও অনেক বাকি…

এদিকে অষ্টাবক্রমুনির জন্মের আগেই একটি দুর্ঘটনা ঘটে। সুজাতা তখন গর্ভবতী। কহোড় বিদ্যায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করলেও ধনহীন ছিলেন। সুজাতার পক্ষে গর্ভস্থ সন্তানসহ এমন দারিদ্র্যদশায় সংসারের ব্যয়বহন করা অসম্ভব হয়ে পড়ছিল। এদিকে স্বামীর সেসব দিকে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। সুজাতা স্বামীকে গিয়ে বলেন, ‘হে মহর্ষে! যে ভাবেই হোক কিছু ধনের ব্যবস্থা করুন। নতুবা আমার এমন অস্বস্থদশায় কীভাবে দিনগুজরান সম্ভব?’ কহোড়মুনি সেকথা শুনে ধনাকাঙ্ক্ষী হয়ে জনকরাজার কাছে গেলেন। রাজা জনকের দরবারে এক বিচারসভা বসেছিল। কহোড়ের নিজের শাস্ত্রজ্ঞানের প্রতি আস্থা ছিল। তাঁর আশা ছিল, তিনি যদি জয়লাভ করতে পারেন, তবে ধনলাভ হতে পারে। কহোড় সে বিচারসভায় পরাস্ত হন। জয়ী প্রতিপক্ষ বন্দি কহোড়কে অন্যায়ভাবে জলে ডুবিয়ে হত্যা করল।
আরও পড়ুন:

স্বাদে-আহ্লাদে: শীতে পছন্দের তালিকায় রয়েছে লাড্ডু? মিষ্টিমুখ হয়ে যাক গাজরের লাড্ডু দিয়েই

ছোটদের যত্নে: সুস্থ ও পরিপুষ্ট সন্তানের জন্য এগুলি মেনে চলছেন তো? সন্তানসম্ভবাদের জরুরি পরামর্শে শিশু বিশেষজ্ঞ

সুজাতার কাছে যখন এই সংবাদ পৌঁছল, তখন তিনি মূর্ছা গেলেন। জ্ঞান ফিরতে শোকবিহ্বল ব্রাহ্মণপত্নী কি করণীয় তা বুঝতে না পেরে বিষাদে অবসাদে নিজেকে ঘরবন্দী করলেন। এমতাবস্থায় পিতা উদ্দালক কন্যা সুজাতাকে সাথে করে নিয়ে গেলেন নিজের আশ্রমে। উদ্দালকপত্নীও তখন গর্ভবতী ছিলেন। মাতা এবং কন্যা অল্প সময়ের ব্যবধানে সন্তানের জন্ম দিলেন। উদ্দালকের পুত্র শ্বেতকেতু আর সুজাতাপুত্র অষ্টাবক্র। উদ্দালকমুনি এই সমস্ত ঘটনা পুত্র অষ্টাবক্রের কাছে গোপন রাখার পরামর্শ দিলেন। অষ্টাবক্র জন্ম হওয়া অবধি পিতার পরিচয় জানতে পারলেন না। তিনি মাতামহ উদ্দালক পিতা বলে জানলেন আর শ্বেতকেতুকে নিজের ভাই বলে চিনলেন। এ ভাবে আরও কিছু বছর পেরিয়ে গেল।
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৫: ভক্তের আন্তরিকতা ও প্রার্থনা, ভগবানকে রেশম সুতোয় বেঁধে রাখে

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৫: আমরা জাতির পিতাকে পেলেও, মাতাকে পেলাম না— কেন?

কিন্তু সত্যকে আর কতই বা গোপন করে রাখা যায়। অষ্টাবক্র আর শ্বেতকেতু দুজনেই তখন বারো বছরের বালক। অষ্টাবক্র একদিন উদ্দালকের কোলে বসে আছেন। শ্বেতকেতুকে গোপন সত্যটা কেউ জানিয়ে দিয়েছে। শ্বেতকেতু পিতার কোলে অষ্টাবক্রকে দেখে খুব রেগে গিয়ে বললেন, ‘তুমি নেমে এসো। এ তো তোমার পিতার কোল নয়! কেন তুমি বসে আছো।’ অষ্টাবক্র এমন কথা শুনে হকচকিয়ে গেলেন। তিনি কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে গিয়ে বললেন, ‘মা আমার পিতা কোথায়? বলো মা, কে আমার পিতা?’ মা সুজাতা মনোকষ্টে ভুগতেন। সন্তানের মুখ চেয়ে তার ভবিষ্যতের কথা ভেবে চুপ করে থাকতেন। আজ যখন পুত্র সব জেনেই গিয়েছে, তা জেনে মা পুত্রের কাছে আর সত্যগোপনের সাহস দেখালেন না। বুদ্ধিমান ছেলে তাঁর। শরীরে বিকৃতি থাকলেও এই বয়সে পাণ্ডিত্যে তার সমতুল্য মেলা ভার। অগত্যা নিরুপায় মাতা বলে চলেন সে যন্ত্রণাময় কাহিনী।
* মহাভারতের আখ্যানমালা (Mahabharater Akhayanmala – Mahabharata) : ড. অদিতি ভট্টাচার্য (Aditi Bhattacharya) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content