শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


।।মেধার বাজারিকরণ।।

আজকে বসে ফাইন আর্টস নিয়ে লিখতে গিয়ে সুবর্ণকান্তিকে যথারীতি বইয়ের পাতা উল্টোতে হয়েছে। খোঁজ-খবর নিতে হয়েছে। আসলে সুবর্ণ দেখেছে তাদের ছোটবেলায় হয়তো এতটা ছিল না। কিন্তু আজকাল অনেকে না জেনে না বুঝেই দুমদাম অনেক বিষয়ে মন্তব্য করে দেয়। কিছু একটা মন্তব্য না করতে পারাটা যেন সাংঘাতিক বোকামি। কিন্তু কানে শুনে আন্দাজ করে ঢিল মারা, খতিয়ে না দেখে কিছু একটা বলে দেওয়াটা একেবারেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সেটার শিক্ষা সুবর্ণকান্তির শিকড়ে। বাবাকে দেখেই যত বয়স বেড়েছে সুবর্ণ শোনার অভ্যেস করেছে। অমলকান্তি সেটা শিখেছিল তার বাবা বিনয়কান্তির থেকে। তাই না জেনে না শুনে মন্তব্য করা বা সরাসরি মিথ্যে কথা বলে যাওয়াটা যে একটা রোগ, সেটা সুবর্ণ বোঝে। আর এটাও বোঝে যে, যাঁরা এই রোগের রোগী তাঁরা এটা বোঝেন না। একবার চুরি করলে যেমন আবার চুরি করার ইচ্ছে হয়। মিথ্যে কথা বলার স্বভাবটাও ঠিক তেমন। ডায়াবেটিস হলে মিষ্টি খাওয়ার প্রবল ইচ্ছের মতো বাড়তে থাকে। কিছুতেই সামলানো যায় না।

পারিবারিক কোম্পানিতে জয়েন করেছিল বলে সুবর্ণকান্তি দত্তকে কোনও চাকরির ইন্টারভিউ দিতে হয়নি। কিন্তু প্রচুর লোভনীয় চাকরির অফার সে পেয়েছিল। দেশে এবং বিদেশেও। সেসব চাকরির রোজগার পারিবারিক কোম্পানির রোজগারের থেকে অনেক অংশে বেশি। তার অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবেরা সেইসব চাকরি নিয়েছে। কিন্তু সুবর্ণকান্তি খুশিমনে বসুন্ধরা গ্রুপ অব কোম্পানিজ-এর দায়িত্ব পালন করেছে। সুবর্ণকান্তি যে সময় পড়াশোনা করেছে, তখন শিক্ষাগত যোগ্যতা পরীক্ষার নম্বর ইন্টারভিউ ছাত্র হিসেবে রেজাল্ট-এর ধারাবাহিকতা এসব যাচাই করে চাকরি পাওয়া যেত। যে সময় থেকে ব্যাঙের ছাতার মতো ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ গড়ে উঠতে শুরু করল তখন আমদানি হল কিছু বেসরকারি শিক্ষা-উদ্যোগের। যারা স্বয়ংশাসিত। ঠিক তখন থেকেই শিক্ষাও একটা ইন্ডাস্ট্রি হয়ে উঠল। আর ইন্ডাস্ট্রি থেকে যখন কোনও প্রোডাক্ট বেরোয় তখন সেটা বাজারে বিক্রি করার জন্য আগে মার্কেটিং করতে হয়। তারপর তার বিক্রি বা সেলস হয়। এই স্বয়ংশাসিত সংস্থাগুলো বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে তাদের প্রোডাক্ট বিক্রির একটা লোভনীয় চুক্তি করে ফেলল।
আরও পড়ুন:

পর্ব-২, বসুন্ধরা এবং…/২য় খণ্ড: বিলেতে মার্চ থেকে অক্টোবর ঘড়ি এক ঘণ্টা এগিয়ে দিতে হয়…

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫০: লুকোনো বই পড়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ বাক্সের চাবি চুরি করেছিলেন

বইমেলায় বিনয়কান্তি…

আইআইটি বা আইআইএম-এর ঝকঝকে মেধার ছেলেমেয়েদের চাহিদা চিরকালই বেশি ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে মেলট্রেনের স্টপেজ বাড়িয়ে বাড়িয়ে যেমন ট্রেনের গতি কমে যায়। ঠিক তেমনই গণ্ডায় গণ্ডায় আইআইটি আইআইএম বাড়লে মান বোধহয় কমেই। অনেকে বলবেন ‘আরে মশাই পপুলেশনটা তো দেখবেন’—এর উত্তরও আজ থেকে প্রায় ৯৪ বছর আগে গুরুদেব দিয়ে গিয়েছেন। শেষের কবিতায় ‘অমিত রায়’-এর মুখ দিয়ে তাজমহল প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন—

তাজমহলকে ভালো লাগার জন্যেই তাজমহলের নেশা ছুটিয়ে দেওয়া দরকার।…বিধাতার রাজ্যে ভালো জিনিস অল্প হয় বলেই তা ভালো, নইলে সে নিজেরই ভিড়ের ঠেলায় হয়ে যেত মাঝারি।
যেহেতু নম্বর চিরকালই যোগ্যতার একটা মাপকাঠি, তাই মাঝারিদের ভালো দেখানোর তাগিদে বিউটি পারলারের মেক-আপের মতো পরীক্ষায় প্রাপ্তনম্বরকে বাড়িয়ে দেওয়া হল। চুক্তিবদ্ধ সংস্থাগুলো চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রার্থীকে সুনিশ্চিত চাকরি দিতে শুরু করল। ইন্টারভিউটা হয়ে গেল একেবারেই নিয়মমাফিক। যে কলেজ বা ইউনিভার্সিটি থেকে বেশি সংখ্যক চাকরি পাওয়া যাচ্ছে সেখানে ভর্তি হবার সংখ্যা রাতারাতি বাড়তে শুরু করল। ছাত্রভর্তির জন্য প্রাপ্য টাকাটাও সেই সেই সংস্থা তাদের খেয়াল খুশিমতো বাড়াতে শুরু করলেন।

কিন্তু মজা হল, প্রাথমিকভাবে চুক্তিমতো প্রার্থীদের নেওয়া হল বটে কিন্তু তাদের কাজে রাখার তো কোনও চুক্তি নেই। তাই ন্যূনতম টাকায় রাখা এইসব প্রার্থীরা এক বা দু’বছরের মধ্যে সে চাকরি ছেড়ে নতুন চাকরি খুঁজতে বাধ্য হল। যাদের আর্থিক সংগতি রয়েছে তারা শিক্ষাগত যোগ্যতা আরেকটু বাড়িয়ে নিতে মনোনিবেশ করল। কিন্তু দিনের পর দিন ব্যবসাটা এভাবেই চলতে শুরু করল। ইদানিং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়-এ তিন বা ছ’ মাস ঘুরিয়ে আনার একটা নতুন ছক। তাই আজকাল কাগজে শাড়ির বিজ্ঞাপন-এর থেকেও বেশি কলেজে ভর্তির বিজ্ঞাপন নজরে আসে। এর মধ্যে যে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী সৎভাবে পড়াশোনা করে নিজেকে তৈরি করে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত করে, তারা হতাশায় ভুগতে শুরু করল। সুবর্ণকান্তির পরিচিত একজন অন্যএকজনকে বেশ গর্বের সঙ্গে বলছিল, ভদ্রলোকের মেয়ে ভীষণ স্মার্ট। ইন্টারভিউতে তাকে কেউ হারাতে পারে না। প্রশ্নের উত্তর জানুক বা না জানুক, মেয়েটি নাকি ঠিক ম্যানেজ করে নেয়। এত ভালো করে প্রেজেন্ট করে যে প্রশ্নের উত্তরটা সে যে ঠিক করে জানত না, সেটা ধরার ক্ষমতা প্রশ্নকর্তার থাকে না। এখন নাকি কথা বলে যাওয়াটাই দস্তুর। নিজেকে বিক্রি করার ক্ষমতাটাই আসল। তাদের পাশে চুপ করে বসে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে সুবর্ণ ভাবছিল, কৃতিত্বটা কোথায়?

বিষয়টা জানায় না অনর্গল অপ্রাসঙ্গিক কথা বলায়? তার মানে সেই সুপার স্মার্ট ক্যান্ডিডেটের পরবর্তী কোনো ছাত্র বা ছাত্রী যদি সৎভাবে নির্ভয়ে প্রশ্নকর্তাকে বলে যে ‘আমি এই প্রশ্নের উত্তরটা ঠিক জানি না। আমাকে যদি আপনি আর অন্য কোনো প্রশ্ন করেন আমি চেষ্টা করতে পারি।’ তাহলে তো আজকের জালিয়াতির মাপকাঠিতে সেই সৎ নির্ভীক ছাত্র বা ছাত্রী বাতিল হয়ে যাবে। এসব ভাবতে গেলে সুবর্ণ’র মাথা গোলমাল হয়ে যায়। নিজেকে বারবার বলতে থাকে এই ধরনের সংকট আসে আবার চলেও যায়। মেধার অবক্ষয়টা সাময়িক। সুতরাং পরবর্তী প্রজন্মকে নির্ভীক হবার সৎ হবার, সাহসী হওয়ার উদ্যম বা উদ্যোগ যোগাতে হবে।
আরও পড়ুন:

ডায়াবিটিস বাগে আনতে কোন প্রোটিন খেতেই হবে, আর কী কী এড়াতেই হবে?

স্বাদে-আহ্লাদে: শীতে পছন্দের তালিকায় রয়েছে লাড্ডু? মিষ্টিমুখ হয়ে যাক গাজরের লাড্ডু দিয়েই

লেখার মাঝে মাঝে সুবর্ণ শ্রীতমাকে পড়ে শোনায়। তারিফ শোনবার জন্য নয়। একটা সৎ প্রতিক্রিয়া পাওয়ার জন্যে। এই অংশটা শোনার পর শ্রীতমা বলল—

‘এইসব না লিখলেই পারতে। সকলের ভালো লাগবে না’

‘আমি কি অল ইন্ডিয়া রেডিও? সব সময় সঠিক সংবাদ পরিবেশন করব’

‘মানে’

‘আমার কথা নয়। কিছুদিন আগে গান্ধীকে নিয়ে একটা নাটক দেখেছিলাম। তাতে কারও একটা কথায় গান্ধীজি এই কথাটা তাকে বলছেন। নাট্যকারের লেখা।’

‘ও’

‘আর এটা তো আমার স্বাধীন মতামত। কেউ সহমত হতে পারেন নাও পারেন। এই কথাটার তো কোন ঐতিহাসিক মান নেই। বিধানসভা এই নিয়ে আইন পাস করবে না। নিছকই একটা কথা। যাঁর অপছন্দ হবে তিনি বলবেন, এসব বেকার ফালতু কথা। কেউ হয়ত জুড়ে দেবেন পাস করে দাদুর কোম্পানিতে ঢুকে গিয়েছে। চাকরি খোঁজার জ্বালা-যন্ত্রণা ও কী বোঝে? আবার যে বা যারা এই পরিস্থিতি এই সংকট উপলব্ধি করেছেন, তারা বলবেন ঠিক কথা। এটাই তো হয়। চাকরির গ্যারান্টি দেওয়া শিক্ষাপদ্ধতির ঝোলানো গাজর, যে আসলে একজন মানুষের প্রকৃত যোগ্যতাকে নষ্ট করে দিচ্ছে, সেটা যারা ঠিক মনে করবেন তারা মানবেন। যারা মনে করবেন না তারা মানবেন না।’

সুবর্ণকান্তির এটা একটা বড় সমস্যা। তার লেখা আপন গতিতে চলে। লেখাকে সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না লেখা তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। বড় সাহিত্যিকরা নিশ্চয়ই লেখাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তাই তাঁরা এত নামি-দামি।
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৫: ভক্তের আন্তরিকতা ও প্রার্থনা, ভগবানকে রেশম সুতোয় বেঁধে রাখে

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪১: মৎস্যজীবীদের মীন সংগ্রহে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিলে প্রচুর অপচয় কমবে, রক্ষা পাবে মাছের জীব বৈচিত্র্যও

সুজাতা দত্ত বিয়ের আগে কখনও কাগজে পেন্সিল দিয়ে একটা আঁকও কাটেননি। সব ছেলেরাই যেমন একটা সময় দু’ চার লাইন কবিতা লেখে। প্রায় সব বিবাহযোগ্যা মেয়েরাই নিজে হারমোনিয়াম বাজাতে না পারলেও হারমোনিয়াম-এর সঙ্গে একটা বা দুটো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারে। ঠিক তেমনি সব বাচ্চারাই একটা বয়সে অক্ষর লেখার সঙ্গে সঙ্গে ছবিও আঁকে। গোলশূন্য পাকিয়ে পাশ দিয়ে ছোট আর বড় দাগ দিয়ে সূর্য। ইংরেজি জেড দিয়ে পাখির ঠোঁট, মাছের মতো করে শরীর আর ল্যাজ। পেটের কাছে বাংলার ২২ লিখে পা। আর পাখির ঠোঁট আর পা-টুকু বাদ দিয়ে মুখটা তে-কোণা করে একটা গোল চোখ বসিয়ে দিলেই ব্যাস! আস্ত একটা মাছ। গায়ের গোল গোল মাছের আঁশ, বা ল্যাজে দাগ কেটে দেওয়াটা ফুচকার ফাউয়ের মতো। না চাইলে পাওয়া যায় না।

সুজাতা নাচ শিখেছিল। সে নাচতে এবং নাচাতে ভালোবাসত।

নিজের কাকিমা গুরুজন তার সম্বন্ধে এধরনের শব্দবন্ধ ব্যবহার করাটা উচিত নয়। কিন্তু লিখতে বসে সুবর্ণর মনে হয়েছে ‘বসুন্ধরা এবং…’ তার কনফেশন বক্স। তার না হলেও বসুন্ধরা ভিলার আত্মজীবনী লিখছে সে। তাই ভনিতা না করে মনের সব কথা উগরে দিতে হবে। অপ্রিয় হলেও সে প্রসঙ্গ বাদ দেওয়া যাবে না। স্ত্রী সুজাতা সম্পর্কে এই শব্দবন্ধ তরুণকান্তি তার সেজবৌদি সুরঙ্গমাকে বলেছিল। এসব কথা তরুণকান্তি আর কাউকে বলতে পারত না। তাই খুব কষ্ট হলে সুবর্ণ’র মার কাছে এসে মন হালকা করতে চাইত। বাবা আর ন’কাকার বন্ধুত্ব বেশি। ছোট থেকে ওরা রুমমেট। ভাইবোন হলেই যে মনের মিল হবে এমন কোন গ্যারান্টি নেই। সুবর্ণ মায়ের ঘরে আসতে গিয়ে ন’কাকার গলা পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। তখনই তার কানে আসে এসব কথা।—চলবে
ছবি সৌজন্যে: সত্রাগ্নি
 

বসুন্ধরা এবং… ২য় খণ্ড/পর্ব-৩

“বসুন্ধরা ভিলায় থাকি বটে কিন্তু সেই পরিবারের ঐতিহ্য বা পরম্পরা কোনওটাই আমার নেই। তেমন কিছুই করি না, সামান্য একটু লেখালেখি করি। এটা জেনেও আপনি যে আমার সঙ্গে আপনার রূপে ও গুণে বিখ্যাত কন্যাটির বিয়ে দিতে রাজি হয়েছেন এটা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।”
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।

Skip to content