রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


আসুন বন জঙ্গলের পাশাপাশি দেখে নিই ছত্রিশগড়ে কারা থাকে। কারা থাকে এটা তো জানতেই হবে কারণ আপনি যখন একটি অঞ্চল পরিভ্রমণে গেলেন; আপনি কাদের সঙ্গে ঘুরছেন, তাদের সংস্কৃতি দেখছেন, কাদের অনুভব করছেন সেটা সবচেয়ে আগে জরুরি। ছত্রিশগড়ের বাসিন্দাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ হল তপশিলি উপজাতি কিংবা আদিম জনজাতিভুক্ত। নানা ছোট বড় জনজাতির পারস্পরিক সহাবস্থান এখানে আছে। হাজার বছর ধরে ছত্রিশগড়ের অরণ্য-পাহাড়-মালভূমি-বিন্ধ্য পর্বত পেরিয়ে আসা আর্যরা সাতপুরা অতিক্রম করে দ্রাবিড় এবং অস্ট্রিক জনজাতির জোয়ারে মিলে গেল। একটা অসম্ভব আত্তীকরণ ঘটলো। সেই আত্তীকরণের মাঝেও কিন্তু স্বতন্ত্রতার সহাবস্থান লক্ষণীয়।

জীবন অভ্যাসে যেমন সাধারণ ধারা রয়েছে, পরম্পরাগত ধারা রয়েছে তেমন জনজাতি বিশেষেও মূল সাংস্কৃতিক ধারাও কিন্তু কোথাও কোথাও প্রধান হয়ে উঠেছে। একটা যুথবদ্ধ প্রকাশ। ছত্রিশগড় রাজ্যের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আমরা এই যুথবদ্ধতা লক্ষ্য করতে পারি। সবচেয়ে বড় প্রমাণ দশেরা উৎসব। আমরা সকলে জানি বাস্তারের দশেরা ৭৫ দিন ধরে পালিত হয় এবং জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সেখানে মানুষ দশেরা উৎসবে সামিল হয়। দেবী দন্তেশ্বরীর পূজার পরে এই দশেরা।
জনজাতির স্বতন্ত্রতা বজায় থাকলেও কিছু তো পরিবর্তন এসেছে। যেমন আদিম শিকার বৃত্তির বদলে কৃষিকে তারা প্রধান জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করেছে। পরিবর্তন এসেছে ধর্মাচারণে এবং এই যে সর্বধর্মে বিশ্বাসী সর্ব প্রাণে বিশ্বাসী জনজাতি, তারা-দরিদ্র অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ধর্ম সংস্কৃতির হেজিমনিক অবস্থাকে স্বীকার করে নিয়েছে। ফলে তারা অনেকেই ধর্মান্তরিত হয়েছে। ধর্মবিশ্বাসের ভিন্নতা এদের মধ্যে রয়েছে, ক্রস কাজিন বিয়ের মতো সামাজিক ঘটনা এখনও রয়েছে। এর মধ্যে আবার কৃষিজীবী হওয়ায় বীজবপন, নবান্ন উৎসব যা আমাদের মূলধারার সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত সেরকম জিনিসও রয়েছে।
ছত্রিশগড়ের জনজাতিরা ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ব্যবহার করে ও বেশভূষা ব্যবহার করে স্বতন্ত্রতা বজায় রাখলেও বসতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটা প্যাটার্ন অনুসরণ করেছে। দশ বিশটা পরিবার নিয়ে এক একটা গ্রাম গড়ে ওঠে, বাড়িগুলো খড়, বুনোপাতা, বাঁশের কাঠামোর উপর মাটি দিয়ে লেপা, তফাৎ শুধু আকারে। সবচেয়ে বড় কথা বাড়ির মধ্যে কোন জানালা দেখতে পাবেন না, বাড়ির মধ্যে শোবারঘর, রান্নাঘর, ঠাকুরদেবতার ঘর, এমনকি যেমেয়েদের ঋতুস্রাব হয়ে গিয়েছে সেই মেয়েদের ঋতুস্রাবের জন্য আলাদা ঘর একটু নিচু চালের ঘর, যে ঘরে আপনাকে সর্বদা মাথা হেট করেই ঢুকতে হবে।
আরও পড়ুন:

সোনার বাংলার চিঠি, পর্ব-৯: অমর একুশে গ্রন্থমেলা: বাংলাভাষী লেখকদের আবেগ ও স্বপ্নের বইমেলা

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৪: সবুজের নেশায় অভয়ারণ্য/২

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫০: লুকোনো বই পড়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ বাক্সের চাবি চুরি করেছিলেন

উৎসবের দিন এরা পশু বলি দেয়, সমবেত নৃত্য করে এবং ভাত মিলেট কিম্বা মহুয়ার জারানো রসে মাতাল হয়ে ওঠে। গোষ্ঠী স্বাতন্ত্র্যের কারণে কেউ কেউ কূলদেবতায় বিশ্বাস করেন, কেউবা টোটেমে বিশ্বাস করেন। পুরুষেরা কেউ ধুতি পরে, কেউ কেউ পাজামা পরে কেউবা শার্ট পাঞ্জাবি পরে। মেয়েদের পোশাক অভ্যাসেও গোষ্ঠীর একটি বিশেষত্ব লক্ষ্য করা যায়। বেশিরভাগ তারা পরে চোলি, ঘাগড়া, ওড়না, শাড়ি। অলংকার পছন্দ। আমরা যে আজকাল গায়ে ট্যাটু আঁকি, ছত্রিশগড়ের জনজাতিরা বহুদিন আগে থেকেই সেই ট্যাটু আঁকতে অভ্যস্ত।
আরও পড়ুন:

হেলদি ডায়েট: গাল জুড়ে এক রাশ ব্রণ? সমাধান লুকিয়ে আছে এ সবের মধ্যে, কী ভাবে কাজে লাগাবেন ঘরোয়া টোটকা?

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫: সত্যিই কি মায়ের দয়ায় পক্স হয়?

প্রাচীন যুগের—প্রাচীন যুগ বলব কেন? মহাকাব্যের পুরানের যুগের যে নারীদের চোলি পরিহিতা আমরা দেখেছি আজকের ছত্রিশগড়ের গোঁন্দ রমণীরাও কিন্তু সেরকমই পোশাক পরে। একটা সুতির কাপড় গলা থেকে বুক হয়ে পিঠের পাশ দিয়ে কোমরে পেঁচিয়ে রাখে। এদের বেশির ভাগেরই থিতু জীবন নয়, যাযাবর জীবন। এই যাযাবর জীবনে তাদের নানারকম পরিবর্তন আসে, চলতে চলতে অন্যান্য জাতিদের সঙ্গে মিলতে মিলতে মেলবন্ধনের নানা উপায় তৈরি করতে করতে তারা হয়তো বা অনেক জায়গায় নিজেদের অস্তিত্বটাকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হচ্ছেনা, আবার অনেক জায়গায় নিজেদের অস্তিত্বকে একটু আধটু পাল্টে ফেলেও টিকিয়ে রাখছে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২২: স্বপ্নের সারথি পাঠিয়েছেন ‘বকুল’ ফুল

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪: ভাবলাম এ যাত্রায় কোনও রকমে বাঁচা গেল, কিন্তু এতো সবে সন্ধ্যে! রাত তখনও অনেক বাকি…

আসুন একটু জনজাতিদের নামের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। কত জনজাতি বলবো। সব জনজাতির নাম বোধহয় আমার জানা নেই। যতটুকু জানতে পেরেছি—অগাড়িয়া, মারিয়া, দরলা, ভুরুয়া, ঘুরু, কানওয়ার, ওঁরাও, ভাতরা, কোরবা, নাগেশিয়া, বইগা, মাঝি, আগারিয়া, মাঝোয়ার, ভাইগ, ধানোয়ার, খারিয়া, কোল, মুন্ডা, কোন্ড, ভুঞ্জিয়া, বীরহর। আবার মারিয়াদের অনেক ভাগ রয়েছে চার-পাঁচ রকম ভাগ মারিয়ার পাওয়া যায়। এরা সমগ্র ছত্রিশগড় জুড়েই রয়েছে। বেশি আছে কোরবা অঞ্চলে, রাজনন্দনগাঁও অঞ্চলে, বাস্তার অঞ্চলে, সারগুজা অঞ্চলে, রায়গড় অঞ্চলে, কাওরধা অঞ্চলে। কিন্তু সমগ্র ছত্রিশগড় জুড়েই রয়েছে।
এরা কিছুটা নিজেদের ভাষা বলে। তাছাড়া কিছুটা হিন্দি ভাষা বলে—ছত্রিশগড়ি হিন্দি। ছত্রিশগড়ি হিন্দির একটা আলাদা টান আছে, সব কথা শেষে তারা’হাউ’ শব্দ যোগ করে এবং এছাড়াও এরা গোণ্ডি ভাষা বলে, হালবি ভাষা বলে, কুরুক ভাষা বলে এরকম নানা ভাষাতে তারা কথা বলে। বইগা জাতির আলাদা ভাষা লক্ষ্য করা গিয়েছে। কিছু কিছু হিন্দি এবং মারাঠি ভাষার লক্ষণ আমরা পাই। ওড়িয়া ভাষার কিছু নিদর্শনও দেখা গিয়েছে কারণ ছত্রিশগড় ওড়িশা, অন্ধপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রের, মধ্যপ্রদেশের সঙ্গেতার সীমানা শেয়ার করেছে। ফলে চারদিকের ভাষার ভাষাতাত্ত্বিক লক্ষণও ছত্রিশগড়ে দেখা যায়।—চলবে

ছবি সৌজন্যে: লেখিকা
 

বাইরে দূরে

লেখা পাঠানোর নিয়ম: এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। লেখার সঙ্গে বেশ কিছু ছবি পাঠাতে হবে। চাইলে ভিডিও ক্লিপও পাঠাতে পারেন। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com

* চেনা দেশ অচেনা পথ (Travel Offbeat): লেখক— অর্পিতা ভট্টাচার্য (Arpita Bhattacharya), অধ্যাপিকা, বাংলা বিভাগ, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ। শৈলীবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। বর্তমান আগ্রহ ও কাজ ভ্রমণ-সাহিত্য, ইকো-ট্যুরিজম, কালচার ট্যুরিজম, স্মৃতিকথা নিয়ে। এছাড়াও মুক্তগদ্য চর্চা ভালো লাগার জায়গা। এখন পর্যন্ত প্রকাশিত ৫টি গ্রন্থ এবং ৫০ টিরও বেশি প্রবন্ধ। সম্পাদনা করেছেন একটি বই এবং ধারাবাহিক সম্পাদনা করেন রবীন্দ্রনাথ টেগোর অ্যাডভান্সড রিসার্চ সেন্টারের জার্নাল।

Skip to content