বৃহস্পতিবার ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪


ছবি: সংগৃহীত।

শোকক্লান্ত, বিষণ্ণ অযোধ্যাপুরীর কাছে এসে ভরতের রথ থামল। ভরত দূতদের মুখে শুনেছেন, রাজপুরোহিত বশিষ্ঠ এবং মন্ত্রিরা তাঁকে আনতে দূত পাঠিয়েছেন। অতি সত্বর তাঁকে অযোধ্যায় পৌঁছনোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, এ হল আত্যয়িক কর্ম অর্থাৎ, দেরি হলে যে কাজের ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। একথা শুনে ভরত অযোধ্যার সকলের কুশল জিজ্ঞাসা করেন। অযোধ্যার সকল দুঃসংবাদ গোপন করে বশিষ্ঠের আদেশ মতো দূতেরা জানালেন— আপনি যাঁদের কুশল প্রার্থনা করেন, তাঁরা সকলে কুশলেই আছেন। ভরতের মনে সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক ছিল, যে, পিতা বা অগ্রজ রাম দূত না পাঠিয়ে বশিষ্ঠ এবং মন্ত্রিরা কেন পাঠিয়েছেন! পিতাকে নিয়ে অশুভ স্বপ্ন দেখে ভরতের মন কি এতই বিক্ষিপ্ত হয়ে ছিল যে, এ বিষয়টি তাঁর মনে কোনও প্রশ্ন জাগায়নি? অথবা তিনি দূতেদের বাক্য খুব গভীরভাবে ভাবার অবকাশ পাননি বলে শোনামাত্রই সরল বিশ্বাসে অযোধ্যার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন।
দশরথের দ্বিতীয় পুত্র ভরত মহাত্মা, সত্যসন্ধ, ধার্মিক, বিনীত। শাস্ত্র ও শস্ত্রবিদ্যায় নিপুণ। দশরথ কিংবা রামের মুখে তাঁর সম্বন্ধে এ সব বিশেষণ শোনা গিয়েছে অনেকবার। কিন্তু মায়ের অপরিণামদর্শিতা, গর্বোন্মাদনা ভরতের অজ্ঞাতসারেই তাঁর জীবনে এঁকে দিয়েছে চিরস্থায়ী অযশের কালিমা। তাঁর প্রতি অকারণ সংশয়ে দীর্ণ হয়েছে পিতা দশরথের মন। তাঁর অনুপস্থিতিতে রামের রাজ্যাভিষেকের ব্যবস্থা করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন তিনি। কৈকেয়ীর প্রতি গভীর অনুরাগ থাকলেও কৈকেয়ীপুত্রের হাতে রাজ্যভার চলে যাক, কোনও অবস্থাতেই চাননি কোশলাধিপতি দশরথ। ভয় ছিল তাঁর ভরতের পরাক্রমী মাতুলবংশ নিয়েও। দীর্ঘদিন সেখানে বাস করায় বোধ করি পিতা কিংবা রাজ্যের প্রতি ভরতের আনুগত্য বোধ নিয়েও সন্দিহান হয়ে পড়েছিলেন দশরথ। ভরতের প্রতি সংশয়াচ্ছন্ন হৃদয়েই প্রাণ ত্যাগ করেন তিনি। রামের নির্বাসনের সিদ্ধান্তে, ঘোর অবিশ্বাসে ভরতের থেকে বিমুখ হয়েছিলেন প্রজাসাধারণও। কৈকেয়ীর বিবেচনাবুদ্ধিহীন স্বার্থপর আচরণ ভরতের প্রতিও সন্দিগ্ধ করে তুলেছিল তাঁদের।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩২: শোকের আঁধারে আকাশ কালো—অযোধ্যায়

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৫১: তীর্থযাত্রার ফল কি তবে প্রশান্তি!

রামের বনবাস যাত্রার পরে তাঁরা রাজ্য কৈকেয়ীর হস্তগত হয়ে গেল এই আশঙ্কায় বিলাপ করতে করতে বলেছিলেন, “রাম, লক্ষ্মণ, সীতার এই বনবাস যাত্রা আসলে ছলনা মাত্র। রুদ্রের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত পশুর মতো আমাদেরকেও ভরতের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হল আসলে- ভরতায়াভিসৃষ্টাঃ স্ম রুদ্রায় পশবো যথা। এর থেকে ভালো বিষ খেয়ে মরা!” কী নিদারুণ অভিব্যক্তি, কী গভীর অবিশ্বাস! রাজপুত্র ভরত এই অবিশ্বাসের, সংশয়ের অতল পারাবারের সামনে নিজের অজ্ঞাতসারেই এসে দাঁড়ালেন। তিনি এও জানেন না, তাঁর রাজসিংহাসন সুনিশ্চিত করতে অগ্রজ রাম লক্ষ্মণ, সীতা সহ চোদ্দ বছরের নির্বাসনে, শোকে-তাপে মৃত পিতা। তাঁর জন্য অপেক্ষায় মৃত পিতার সৎকারযোগ্য দেহ, এবং রাজাহীন রাজ্যের কণ্টকাকীর্ণ রাজসিংহাসন।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়. পর্ব-৪: আপনি কি খেয়ে উঠেই শুয়ে পড়বেন? জানেন কী হচ্ছে এর ফলে

স্বাদে-গন্ধে: সামনেই জন্মদিন? বিশেষ দিনের ভূরিভোজে বানিয়ে ফেলুন কাশ্মীরি পদ মটন রোগান জোস!

যে সব প্রশ্ন সাত রাত পথ চলতে চলতে মনে হয়নি, কোনো সংশয় জাগায়নি, অযোধ্যায় প্রবেশের আগে নগরীর হতশ্রী রূপ ভরতের মনে সে সব প্রশ্ন জাগালো— “এ তো সেই প্রফুল্ল, প্রসন্ন অযোধ্যাপুরী নয়। মনে হচ্ছে যেন কোনো জনমানবহীন বনের মধ্যে এলাম। আগে তো কত দূর থেকে সমুদ্রের কলরোলের মত জনকোলাহল ভেসে আসত। আজ তো কোনও শব্দই শোনা যাচ্ছে না। কাননে, উদ্যানে, পথে-ঘাটে মানুষের কত উচ্ছ্বাস, আনন্দ, কর্মব্যস্ততা চোখে পড়ত। কিছুই তো চোখে পড়ছে না। কেমন অমঙ্গলের চিহ্ন চারদিকে।” ভরতের এসব ভাবনাচিন্তার মধ্যেই দ্বারপালরা সসম্মানে ভরতকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে গেল। পথে যেতে যেতে চোখে পড়ল উৎকণ্ঠিত, মলিনমুখ জনসাধারণ। কারও মুখে হাসি নেই, কথা নেই, চোখ জলভারাক্রান্ত। এ দৃশ্য দেখে আরও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন ভরত। দ্বারপালদেরকেও একই প্রশ্ন করলেন কিন্তু উত্তর পেলেন না ভরত। ভরত স্বভাবে ধীর, মহাধৈর্য্যশালী, জিতেন্দ্রিয়। মনের মধ্যে অনিষ্ট আশঙ্কা আর ভয় আলোড়ন তুললেও ধৈর্য্য হারালেন না।
আরও পড়ুন:

মাধ্যমিক ২০২৩: পাঠ্যবই খুঁটিয়ে পড়লে বাংলায় বেশি নম্বর পাওয়া কঠিন নয়

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৯: গুরুদেবের দেওয়া গুরুদায়িত্ব

নতমুখে দুশ্চিন্তা করতে করতে রাজপ্রাসাদে পিতার ভবনে ঢুকে কোথাও তাঁকে দেখতে পেলেন না। এ বার গেলেন মায়ের ভবনে। ভরতকে দেখে ছুটে বেরিয়ে এলেন কৈকেয়ী। খুশির ঝিলিক তাঁর দু’ চোখে। আনন্দে মাথায় চুমো খেয়ে কোলে টেনে নিলেন পুত্রকে। পিতৃগৃহের কুশল সংবাদ জিজ্ঞাসা করলেন ভরতকে। কিন্তু ভরত সব কুশল মঙ্গলের উত্তর দিয়েও অধীর হয়ে অযোধ্যা নগরীর এমন শ্রীহীনতার কারণ এবং পিতার সংবাদ জানতে চাইলেন মায়ের কাছে। কৈকেয়ী যেন কোনও শুভ সংবাদ দিচ্ছেন, এমন মনোজ্ঞ ভঙ্গিমায় বলে উঠলেন, “পুত্রশোকে ব্যথিত তোমার পিতা তোমাকে নিজের রাজ্যভার দিয়ে পুণ্যলব্ধ স্বর্গলোকে গিয়েছেন।”

একথা শোনামাত্রই ভরত মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন শোকের ভার সইতে না পেরে। তারপর মাটিতেই বসে তিনি বিলাপ করতে শুরু করলেন। তাঁর এমন শোকগ্রস্ত অবস্থা হবে, এ বুঝি কৈকেয়ীর ধারণা ছিল না। হয়তো ভেবেছিলেন, রাজ্য লাভের আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠবেন ভরত। কিন্তু এমন কিছুই হল না যখন, তখন ভরতকে তিনি শোকমুক্ত করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন— ভরত, ওঠো, শোকমগ্ন হয়ে থেকো না। তোমার মতো ধার্মিক, ভূয়োদর্শী মানুষ কি মৃতের জন্য শোক করে? তোমার পিতা দীর্ঘকাল সুষ্ঠু ভাবে রাজত্ব করে, যজ্ঞ, দানকর্ম করে তাঁর ঈপ্সিতলোকে গিয়েছেন। তাঁর জন্য কি শোক করা উচিত?”
আরও পড়ুন:

শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেড়েছে? প্রাকৃতিক উপায়েই সহজে জব্দ হবে এই রোগ, কী ভাবে?

ডায়েট ফটাফট: সব খাবারের সেরা সুপারফুড কিনোয়া খান, ওজন কমান

“মা, আমি যে কত আশা নিয়ে এসেছিলাম, পিতা রামকে অভিষিক্ত করবেন, তারপর যজ্ঞ হবে। সেজন্যই হয়তো আমাদের নিয়ে আসা হয়েছে। সেসব কথা ভেবেই আমি তাড়াতাড়ি অযোধ্যায় ফিরে এলাম। আজ দেখছি, আমার মতো নির্বোধ আর হয় না। আমার সব আশা বিফলে গেল। কিন্তু কোন অসুখে পিতার মৃত্যু হল, মা? রাম, লক্ষ্মণ ধন্য, তাঁরা পিতার সেবা শুশ্রূষা করতে পেরেছে তাঁর কাছে থেকে। পিতার সেই স্নেহস্পর্শ আর কখনও কি পাবো না? এখন তো তাহলে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রামই আমার পিতা, আমার আশ্রয়। আমি তার দাসানুদাস। তাঁকে দেখতে পেলে, তাঁর পায়ের কাছে বসতে পেলে আমি একটু শান্তি পাবো।”

ভরতের এই করুণ আর্তি কি মা কৈকেয়ীর মনকে কিছুমাত্র দুর্বল করল? পুত্র ভরতের মনকে বোঝার মতো সামর্থ্য কি তাঁর ছিল? নিজের অগভীরচিত্তের অপরিণামদর্শী ভাবনার ঘূর্ণিপাকে ঘুরতে ঘুরতে কৈকেয়ী ধার্মিক, মনস্বী পুত্রটির মন চেনার দায় বোধ করি অনুভব করেননি কোনওদিনই। চিনতে পারেননি পিতা দশরথও। যে পুত্রকে সংশয়ে, ভয়ে দূরে রাখতে চেয়েছেন, রামের রাজ্যাভিষেকে চাননি তার উপস্থিতি, তার হৃদয়টি এত অমলিন, ভালোবাসায় ভরা স্বচ্ছতোয়া সরোবরের মতো — একথা জেনে, পুত্রকে চিনে যেতে পারলেন না দশরথ। —চলবে

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
* শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।

Skip to content