বুধবার ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪


সজনীকান্ত দাস।

রবীন্দ্রনাথের পরম ভক্ত ছিলেন সজনীকান্ত। বার বার ছুটে গিয়েছেন জোড়াসাঁকোয়, কখনও বা ‌শান্তিনিকেতনে। তরুণ বয়সে কত যে রবীন্দ্রনাথের বই কিনেছেন, তার হিসেবনিকেশ লেখা নেই। সজনীকান্তের বাবা চাননি ছেলে সাহিত্যচর্চা করুক, বই কিনুক। টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে সজনীকান্ত ‘প্রবাসী’র গ্রাহক হয়েছিলেন। ওই বয়সে কষ্ট করে কেনা, তাঁর অনেক বই-ই পরবর্তীকালে থরে থরে সাজানো ছিল আলমারিতে। পছন্দের সব বই যে সজনীকান্ত কিনতে পেরেছিলেন, তা নয়। তাঁর যত আগ্রহ ছিল রবীন্দ্রনাথের বইয়ে। কেনার মতো পর্যাপ্ত টাকা ছিল না। কম খরচে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন বই কী করে নিজের কাছে রাখা যায়, সে ব্যবস্থা করেছিলেন সজনীকান্ত। সরকারি কাগজে বেশ কিছু খাতা বানিয়ে নিয়েছিলেন। সেই খাতায় নিজের হাতে রবীন্দ্রনাথের অনেক বই নকল করেছিলেন। এই ভাবে ‘গোরা’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘বিদায় অভিশাপ’, ‘রাজা ও রানী’ ‘বিসর্জন’—মূল বই থেকে লেখা হয়েছিল খাতায়। কপি করেছিলেন ‘গীতাঞ্জলি’-র ইংরেজি ও বাংলা দুটি সংস্করণই। সব খাতা সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন সজনীকান্ত। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয়ের পর দেখিয়েওছিলেন। শুধু নকল করেননি, কোনও কোনও বই সজনীকান্তের কণ্ঠস্থ হয়ে গিয়েছিল। কবিতার বই, ছোটো নাটকের বই, ঠিক আছে কিন্তু ‘গোরা’-র মতো বিপুলায়তনের উপন্যাসের বহু অংশ আবৃত্তি করার অনায়াস- ক্ষমতা আয়ত্ত করেছিলেন তিনি। ঘটনাটি রবীন্দ্রনাথকে কতখানি স্পর্শ করেছিল, তা সজনীকান্তের লেখা থেকেই জানা যায়। তাঁর লেখায় আছে, ‘তিনি সস্নেহে বিস্ময়ে সেগুলি আমার নিকট হইতে সম্ভবত একলব্য-ভক্তির নিদর্শন-স্বরূপ সংগ্রহ করিয়াছিলেন।’

সজনীকান্ত দাস।

পরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয়, সান্নিধ্যলাভ। সেসময় সজনীকান্তের মুখে সতেরোখানা বই-নকলের কথা শুনে কবি কৌতুক প্রকাশ করেছিলেন। কথার কথা, বানানো কথা নয়, তার প্রমাণও সজনীকান্ত দিয়েছিলেন। ‘আত্মস্মৃতি’তে তিনি লিখেছেন, ‘নকলগুলি তখনও পর্যন্ত আমার নিকটে কলিকাতাতেই ছিল। আমি প্রমাণ দাখিল করিলাম। এতখানি তিনিও আশা করেন নাই। তিনি সেগুলি আমার নিকট হইতে সংগ্রহ করিয়া লইলেন। অনেককেই সেগুলি দেখাইয়াছেন এবং অনেকের কাছে গল্প করিয়াছেন সে কথা পরে জানতে পারিয়াছি।’
নকল করা কপিগুলো রবীন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত কী করেছিলেন, তা অবশ্য সজনীকান্ত জানতে পারেননি। প্রকাশিত বইয়ের এক কপি করে সজনীকান্ত যাতে পান, সে ব্যবস্থা অবশ্য করেছিলেন তিনি। এই প্রাপ্তির সম্ভাবনা সুনিশ্চিত হওয়ার পর সজনীকান্তের মনে হয়েছিল, ‘আমার বাল্য-কৈশোরের শ্রম সার্থক হইয়াছিল।’
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৮: খোকা নয়, খুকি নয়

ইংলিশ টিংলিশ: জেনে নাও Unseen Comprehension এ কীভাবে পাবে ফুল মার্কস এবং পড়বে কোন Phrasal Verbগুলো

বিচিত্রের বৈচিত্র্য: জীবন খাতার প্রতি পাতায় যতই লেখো হিসাব নিকাশ/২

সজনীকান্ত রেখেঢেকে কথা বলতেন না। যা মনে হতো, তা বলতেন অকপটে। অনেক সময় তাঁর কথার মধ্যে চমক থাকত, মন্তব্য ঘিরে সাধারণের মধ্যে বিতর্ক তৈরি হতো। হয়তো চমক লাগানোর জন্যই বেঢপ কথা বলতেন, বিতর্ক তৈরি করতেন। এ সবই হয়তো-বা পরিকল্পিত। ‘শনিবারের চিঠি’তে তিনি এমন বেমক্কা সব মন্তব্য করতেন, যা নিয়ে খুব আলোড়ন পড়ে যেত। অনেককে নিয়েই সজনীকান্ত এমন করেছেন। জীবনানন্দকে নিয়ে কত কথা লিখেছেন, যা শ্লীলতারও সীমা লঙ্ঘন করেছে। না, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তিনি কখনও ‘শনিবারের চিঠি’তে হালকা মন্তব্য করেননি। রবীন্দ্রনাথের জন্য তাঁর মনের কোণে যে শ্রদ্ধার আসন ছিল, সে আসন কখনও টলে যায়নি। সম্পর্কের বন্ধন দিনে দিনে আরও দৃঢ় হয়েছে, গভীর হয়েছে। আন্তরিকতায় ঘাটতি পড়েনি।

শনিবারের চিঠি।

সজনীকান্ত দাস পত্রিকা-সম্পাদক হিসেবে খ্যাতির শিখরে পৌছলেও তাঁর কাব্যখ্যাতি বা গদ্য সাহিত্যে খ্যাতি কম ছিল না। অনুসন্ধিৎসু গবেষক হিসেবেও যথেষ্ট সুখ্যাতি ছিল। রবীন্দ্রনাথের একাধিক বাল্য-কৈশোরের রচনা উদ্ধার করে কবির তিনি আস্থাভাজন হয়ে উঠেছিলেন। ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার পুরোনো ফাইল নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে সজনীকান্ত একটি কবিতা পেয়েছিলেন। সে কবিতার নাম ‘অভিলাষ’। লেখকের কোনও নাম ছিল না। শুধু লেখা ছিল ‘দ্বাদশ বর্ষীয় বালকের রচিত’। বেশ দীর্ঘ কবিতা, উনচল্লিশটি স্তবকে সম্পূর্ণ। পত্রিকাটি হাতে নিয়ে কবিতাটি পড়ে সজনীকান্তের কেমন যেন সন্দেহ হয়, রবীন্দ্রনাথের লেখা নয় তো! অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের নাম-স্বাক্ষরিত প্রথম রচনা হিসেবে ‘হিন্দুমেলার উপহার’ কবিতাটি মুদ্রিত হয়েছিল। সেই কবিতাটিকে রবীন্দ্রনাথের লেখা প্রথম কবিতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। অমৃতবাজারে মুদ্রিত কবিতার সঙ্গে ‘অভিলাষ’ মিলিয়ে পড়ে সজনীকান্তের বারবার মনে হয়, নির্ঘাত এ কবিতা রবীন্দ্রনাথের লেখা। তর সইছিল না তাঁর। তড়িঘড়ি উপস্থিত হলেন শান্তিনিকেতনে। সজনীকান্ত লিখেছেন, ‘বিলম্ব সহিতেছিল না। সুতরাং বামাল শান্তিনিকেতনে উপস্থিত হইলাম।… দ্বিপ্রহরেই খাইবার টেবিলে পুথিপত্র লইয়া বসিলাম। বলিলাম, আপনাকে একটি কবিতা শোনাইব, শুনুন তো। … খানিকটা পড়িবার পরই বৃদ্ধের চোখ উজ্জ্বল হইয়া উঠল, হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন, ও তো আমার লেখা হে, তুমি কোথায় পেলে? … সংবাদ শান্তিনিকেতনে রটিতে বিলম্ব হইল না। কলিকাতার সংবাদপত্রের প্রতিনিধিরা সেখানে ছিলেন। তাঁহারা টেলিগ্রাম-যোগে কলিকাতায় রবীন্দ্রনাথের প্রথম মুদ্রিত কবিতা আবিষ্কারের সংবাদ প্রেরণ করলেন।’
আরও পড়ুন:

পর্ব-১, বসুন্ধরা এবং…/২য় খণ্ড: ফুলে ফুলে ঢাকা শববাহী গাড়ি, পুলিশি ব্যবস্থা চোখে পড়ার মতো

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৩: সবুজের নেশায় অভয়ারণ্য

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-২: এই প্রথম বার মনে হল জীবন কঠিন হতে চলেছে, তাই মনে মনে প্রস্তুত হতে শুরু করলাম

শুধু ‘অভিলাষ’ নয়, রবীন্দ্রনাথের আরেকটি অখ্যাত বাল্যরচনার আবিষ্কারক সজনীকান্ত দাস। সেটির নাম ‘প্রকৃতির খেদ’। ছোটবেলায় নামহীনভাবে ছাপা হওয়া একাধিক রচনা সজনীকান্ত খুঁজে পাওয়ায় রবীন্দ্রনাথ বড়ই খুশি হয়েছিলেন। খুশি হয়ে লিখেছিলেন, ‘শ্রীমান সজনীকান্ত দাস আমার বাল্য ও কৈশোরের বেনামী রচনাগুলি আবিষ্কার করে আমাকে বিস্মিত করেছেন। পুরাতন ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় আমার সর্বপ্রথম মুদ্রিত রচনা ‘অভিলাষ’ তাঁর অভিনব আবিষ্কার। এর অস্তিত্ব সম্বন্ধে আমার সম্পূর্ণ বিস্মৃতি ঘটেছিল। জ্যোতিদাদার প্রথম চারটি নাটকের অধিকাংশ কবিতা ও গান যে আমার রচনা তা সজনীকান্তের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়ায়নি।’

রবীন্দ্রনাথ ও সজনীকান্ত দাস।

এ সব হারানো লেখা হাতে পেয়ে রবীন্দ্রনাথ স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছিলেন। সজনীকান্তের প্রতি কবির ভালোবাসা বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই নির্ভরতা থেকে তাঁকে গুরুদায়িত্ব দিয়েছিলেন। গুরুদায়িত্ব নয়, তা ছিল সজনীকান্তের পুরস্কার। একটু ভিন্নতর পারিতোষিক।

কবি ‘রবীন্দ্ররচনাবলি’র অন্যতম সম্পাদক হিসেবে সজনীকান্ত দাসকে নিয়োগ করেছিলেন। সন্দেহ নেই যে, সজনীকান্তের কাছে তা ছিল পরম প্রাপ্তি। গুরুদেবের কাছ থেকে এই পুরস্কার পেয়ে প্রাপ্তির আনন্দে তাঁর মন ভরে উঠেছিল। এমন স্বীকৃতির জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না।
আরও পড়ুন:

ডায়াবিটিস ধরা পড়েছে? হার্ট ভালো রাখতে রোজের রান্নায় কোন তেল কতটা ব্যবহার করবেন? দেখুন ভিডিয়ো

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-৩: মেডিকেল কলেজ থেকে বিশ্বকাপ

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩: টক খেওনা ধরবে গলা

রবীন্দ্রনাথের খুবই আস্থাভাজন হয়ে উঠেছিলেন সজনীকান্ত। সজনীকান্তের কোনও কথাই কবি ফেলতে পারতেন না। মেদিনীপুরে ‘বিদ্যাসাগর স্মৃতি মন্দির’-এর দ্বারোদ্ঘাটন হবে, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে, উদ্যোক্তারা ধরলেন সজনীকান্তকে। জানতেন তাঁর কথা কবি ফেলতে পারবেন না।

রবীন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রনাথ তখন আশির দরজায় দাঁড়িয়ে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা অগ্রাহ্য করে সজনীকান্তের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত মেদিনীপুর গিয়েছিলেন তিনি। সজনীকান্ত তাঁর যাত্রাসঙ্গী হয়েছিলেন। ট্রেন ‌গুসকরায় আসতেই কবির কামরায় সজনীকান্তের ডাক পড়েছিল। পৌঁছে তো সজনীকান্ত হতবাক। মহাউৎসাহের সঙ্গে টিফিন ক্যারিয়ারের বাটি খুলে প্রাতরাশের ব্যবস্থা নিজের হাতে করছেন গুরুদেব। পরোটা, আলুর দম আর হালুয়া। কবি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, পরোটা কেমন লাগছে, তারপর নিজেই হেসে বলেছিলেন, ‘ক্যাস্টর অয়েলে ভাজা অথচ তোমরা কেউ ধরতেই পারলে না।’ মেদিনীপুরে গিয়ে দ্বারোদ্ঘটনকালে কবি বলেছিলেন, ‘আমি আয়ুর শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছি। এইটাই আমার শেষকৃত্য, শেষ উপহার, শেষ উৎসর্গ।’

অনুষ্ঠানটি হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর, ৩০ অগ্ৰহায়ণ। পরের বছরই আসে সেই রোদন ভরা শ্রাবণ, চোখের জলের প্লাবন শ্রাবণের বাইশে।

ছবি সৌজন্যে: লেখক
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content