রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ছত্তিসগড়ে ঢুকলে সবুজের নেশা আপনাকে আকৃষ্ট করবেই। আর রয়েছে অরণ্যভূমির এক অন্য আকর্ষণ। ৪৫ শতাংশ প্রায় এই রাজ্যে বন আর বনানীর বিস্তার। শাল, সেগুন, বাঁশ, পলাশ, অর্জুন, গর্জন, খয়ের, মহুয়া, শিমূল, হরিতকী, তেঁতুল, আমলকী ঘন অরণ্যের ফাঁক দিয়ে যখন আপনি বিচরণ করে বেরাচ্ছেন তখন আপনার সঙ্গে অরণ্যে মুক্ত বিচরণ করে বেড়াচ্ছে টিয়া, ময়না, বুলবুল, হরিয়াল, মাছরাঙার মতো রাত জাগা প্যাঁচা, শকুন, ঈগল। ডালপালা আর পাতার ফাঁকে জংলা ঝোপে অরণ্য অঞ্চলে প্রায়ই দেখা যায় বাঘ, বুনো মোষ, বারকিং ডিয়ার, নীল গাই, শেয়াল, হায়না।

এদের সঙ্গে বেড়াবার জন্য আরণ্যক অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ নিতে আপনি যখন আসবেন, তখন আপনাকে আরও অন্য অনুভব দেবে ছত্তিসগড়ের অরণ্য জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ তার আদিবাসী উপজাতির দল। অরণ্যকে আশ্রয় করে যাদের জীবন জীবিকা আবর্তিত হয়ে চলে। তাদের মধ্যে অন্যতম বাইগা, মারিয়া, ধুরুয়া, রাউত, কাউয়ার। অরণ্য নির্ভর পশুপালক জনগোষ্টি ছাড়াও সভ্য সমাজের চোখের আড়ালে এখানে রয়েছে অরণ্যচারী বন্য পৃথিবীর মানুষ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সম্পদে ভরপুর এই রাজ্যে ওই অরণ্যের মধ্যের মানুষগুলো তারা আজও সমস্তরকম বেঁচে থাকার উপকরণ থেকে বঞ্চিত। একটু তথ্য দিয়ে রাখি, এই রাজ্যে ১৬টির বেশি স্যাংচুয়ারি রয়েছে। সেই স্যাংচুয়ারির মধ্যে বাঘ সংরক্ষণই বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
পর্যটনের দিক থেকে আমার মতে ছত্তিসগড় ভারতের সবচেয়ে আন্ডার রেটেড ট্যুরিজম সেন্টার। এত জিনিস, এত কথা আছে যা বলতে গেলে কথা যেন ফুরোতেই চায় না। এই যে বনের কথা বলছি, এই যে বাঘ সংরক্ষণের কথা বলছি আমরা তো জানতামই না যে এতগুলো বন্যপ্রাণী সংরক্ষণকেন্দ্র আছে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে সংরক্ষিত অভয়ারণ্য, ন্যাশনাল পার্ক। নানা রঙের শেড ধরা সবুজেরা ভিড় করে আসে। রাস্তায় চলছেন আপনি।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ছত্তিসগড়ের রাস্তা অসাধারণ, রাস্তা নিয়ে কোনও অভিযোগ করা যাবে না, সেই রাস্তায় দু’পাশ থেকে ঘন সবুজ অরণ্য, কখনও তার হাল্কা সবুজ রং, কখনও তার ধার দিয়ে সূর্যের আলো আসছে, কখনও জলের মধ্যে গাছ— সে এক অপূর্ব রহস্যময়তা। তাকে ঘুরে ফিরে দেখতে দেখতে জঙ্গলের রূপের থই মিলবে না। বন্যপ্রাণী আর বন্যপ্রকৃতির সংরক্ষণের সুরক্ষা দিয়ে এখানে গড়ে উঠেছে অনেক সংরক্ষিত অভয়ারণ্য। আমার পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা বর্ণনার আগে একটা ছোট্ট ঝলক হিসেবে দেখে নেওয়া যাক ছত্তিসগড়ের অরণ্যভূমির পুরো চেহারাটা।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-২: প্রসঙ্গ ছত্তিসগড়

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-২: এই প্রথম বার মনে হল জীবন কঠিন হতে চলেছে, তাই মনে মনে প্রস্তুত হতে শুরু করলাম

জ্যোতির্লিঙ্গ যাত্রাপথে, পর্ব-৩: বাবা বিশ্বনাথের দরবারে

শুরু করি ছত্তিসগড়ের দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে। কাঙ্গেরভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক। ১৯৮২ সালের ২২ জুলাই থেকে এই উদ্যানটি জাতীয় উদ্যানের শিরোপা পেয়েছে। জগদলপুর থেকে ২৭ কিমি দূরে বাস্তার অঞ্চলে এই অরণ্যভূমি আছে। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কোলাবা নদী, অনেকে বলেন খোলাবা। ২০০ বর্গকিমি অঞ্চল জুড়ে এই ন্যাশনাল পার্ক অবস্থিত। পাওয়া যায় সেই বাঘ, চিতল, কাঠবেড়ালি, বিভিন্ন প্রকৃতির সরীসৃপ, নানা ধরনের পাখি। এই কাঙ্গেরভ্যালি ন্যাশনাল পার্কে কিন্তু আছে আরেকটি জলপ্রপাত, তীরথগড়। যে অতটা পর্যটকের কাছে সুপরিচিত নয়, কোনও অংশে চিত্রকূটের থেকে কম নয়।

এরপর ইন্দ্রবতী ন্যাশনাল পার্ক, ১৯৮১-তে এটি ন্যাশনাল পার্কের মর্যাদা পায় এবং ১৯৮৩ তে এটি বাঘ সংরক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এটা কিন্তু জগদলপুর থেকে ১৫০ কিমি। পশ্চিম দিকে গেলে মহারাষ্ট্রের সীমান্ত ছুঁয়ে এই বনভূমি ২৮০০ বর্গকিমি এলাকা জুড়ে অবস্থিত। এবং ইন্দ্রাবতী নদীর আশে পাশে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেখানে আমরা উপভোগ করতে পার…এবং প্রত্যেকটি অরণ্যে একই ধরনের বন্যপ্রাণী, সরীসৃপ, পাখি ইত্যাদি পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৮: খোকা নয়, খুকি নয়

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-৩: মেডিকেল কলেজ থেকে বিশ্বকাপ

বিচিত্রের বৈচিত্র্য: জীবন খাতার প্রতি পাতায় যতই লেখো হিসাব নিকাশ/২

১৯৮১ সালে স্বীকৃতি পেয়েছিল সঞ্জয় জাতীয় উদ্যান বা ঘাসিদাস জাতীয় উদ্যান। এটি ছত্তিসগড়ের একদম উত্তরদিকে সরগুজা জেলায় ২৩০০ বর্গকিমি জুড়ে ছড়িয়ে আছে। বিভিন্ন নদী উপনদীর জলধারার পরিপুষ্ট অরণ্য। এই অরণ্যটি কিন্তু সত্যি কথা জল সমৃদ্ধ। আপনি চাইলে বেনারস বেড়াতে গেলে এখান দিয়ে চলে যেতে পারেন কারণ মির্জাপুর— বারাণসী স্টেট হাইওয়ে দিয়ে এখানে যাওয়া যায়। পরিচিত আরেকটি জায়গা রিভা। রিভা কিন্তু এই সঞ্জয় জাতীয় উদ্যান বা ঘাসিদাস জাতীয় উদ্যানে যাবার জন্য অন্যতম উল্লেখযোগ্য জায়গা। এই উদ্যানে কিন্তু সাদা বাঘের দর্শন পেতে পারেন আপনারা। আবার সঞ্জয় জাতীয় উদ্যান থেকে পৃথক অস্তিত্ব নিয়ে গুরু ঘাসিদাস জাতীয় উদ্যান তৈরি হয়েছিল একইরকম, কিন্তু ঘাসিদাস জাতীয় উদ্যানের জলাভূমি এত বেশি আছে যে পরিযায়ী পাখিদের যাতায়াত এখানে অজস্র।
আপনি দেখতে যাচ্ছেন শিরপুর কাছে রয়েছে বারনোয়াপাড়া অভয়ারণ্য। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এই অভয়ারণ্য স্বীকৃতি পেয়েছে ন্যাশনাল পার্কের। ২৪৫ বর্গকিমি এলাকা জুড়ে অবস্থিত। এনএইচ ৬ এর সঙ্গে যুক্ত এবং এটির সঙ্গে সারা দেশের কানেক্টিভিটি খুব সুন্দর। রায়পুর থেকে মাত্র ৮৫ কিমি দূরে। এখন একটা জিনিস বুঝতে হবে অভয়ারণ্য মানে কিন্তু আপনি একটা কোনও নির্দিষ্ট এলাকায় যাচ্ছেন। সেখানে বন্য পশুপাখি, সরীসৃপ দেখতে পাচ্ছেন তা নয়। কিন্তু একটা তার লাগোয়া একটা বিশাল অঞ্চলকে কিন্তু ওই অভয়ারণ্য বলে ঘোষণা করা হয়। যেমন বারনোয়াপাড়া অভয়ারণ্য যাকে আমরা বলছি, আপনি যদি মহাসমুন্দ জেলার কুডারড্যাম এলাকা শুরু করেন। শিরপুর অবধি এই এলাকা কিন্তু আপনি দেখতে পারবেন লেখা আছে ‘বারনোয়াপাড়া অভয়ারণ্যের অন্তর্গত’। এখানকার যারা অধিবাসী তারা আদিবাসী হতে পারেন বা অন্য অধিবাসিরা তারা এই জঙ্গলের সঙ্গে নিজেদেরকে আশ্লিষ্ট করে নিয়েছে। জঙ্গলের জন্তু জানোয়ার, জঙ্গলের ফল পাখি, ফুল, খাবার-দাবার সবের সঙ্গে তাদের একটা আত্মিক সম্পর্ক। জঙ্গলের ওপর নির্ভর করেই তাদের জীবন চলে।
আরও পড়ুন:

ইংলিশ টিংলিশ: মাধ্যমিকে ইংরেজিতে ভালো নম্বর পাওয়ার উপায় কি? দেখে নাও আজকের বিষয়: Seen Comprehension

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২০: মেলা থেকে ফিরে ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩২: শোকের আঁধারে আকাশ কালো—অযোধ্যায়

১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে ধামতারির কাছাকাছি সীতা নদী অভয়ারণ্য তৈরি হয়েছে। সীতা নদী জলধারাপুষ্ট এই অভয়ারণ্য প্রায় ৫৫৬ বর্গকিমি আয়তনবিশিষ্ট। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে রাজিম থেকে ১১৫ কিমি দূরে রায়পুর—রাজিম রোডে অবস্থিত উদন্তি অভয়ারণ্য, ২৩১ বর্গকিমি এলাকা জুড়ে অবস্থিত। উদন্তিতে কিন্তু প্যান্থার পাবেন, হোয়াইট বাফেলো পাবেন যেমন সীতানদীতে পাবেন লেপার্ড। বারাণসীর কাছাকাছি সেমারসঙ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণকেন্দ্র। ৪৩১ বর্গকিমি এলাকা নিয়ে গঠিত। ডাল্টনগঞ্জ- অম্বিকাপুরের কাছে। এখানে নীল গাই পাবেন, লেপার্ড পাবেন, নানা ধরনের পরিযায়ী পাখি পাওয়া যায়। ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে তৈরি হয়েছিল তামর-পিংলা অভয়ারণ্য। তামর পাহাড় ও পিংলা জলধারা এই নিয়ে এই অরণ্যভূমি প্রায় ৬০৮ বর্গকিমি এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। বিলাসপুর রেল স্টেশন থেকে এই অরণ্যে পৌঁছবার ব্যবস্থা আছে।এখানে কিন্তু সরীসৃপের মধ্যে ময়াল, অজগর নানা প্রজাতির এখানে কিন্তু পাওয়া যায়।

ছত্তিসগড়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অভয়ারণ্য হল অচানকমার। অনেকেই অমরকণ্টক গেলেই অচানকমার অভয়ারণ্য সাফারি করে ফেরে। মধ্যপ্রদেশ দিয়েও যাওয়া যায়, ঠিক অমরকণ্টকের কাছাকাছি। অচানকমার পেরলে কেওনচি, কেওনচি হল ছত্তিসগড়ের বর্ডার। তারপর থেকেই মধ্যপ্রদেশ অর্থাৎ অমরকণ্টক শুরু হয়ে যায়। ১৯৭৫ সালের ২৮ জুন অচানকমার অভয়ারণ্য স্বীকৃতি পায়। মিশ্র পর্ণমোচী বৃক্ষের অরণ্যভূমি ৫৫৭ বর্গকিমি। হিংস্র জন্তু আছে, বাঘ লেপার্ডের বিচরণভূমি। অচানকমারের ভিতর দিয়ে দিনের বেলায় যাতায়াত করাটাও কিন্তু যথেষ্ট সঙ্কুল। পেন্ড্রারোড থেকে এই অরণ্যে আসাটা খুব সহজ, মানে বিলাসপুরের কাছাকাছি।—চলবে
ছবি: লেখক
 

বাইরে দূরে

লেখা পাঠানোর নিয়ম: এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। লেখার সঙ্গে বেশ কিছু ছবি পাঠাতে হবে। চাইলে ভিডিও ক্লিপও পাঠাতে পারেন। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com

* চেনা দেশ অচেনা পথ (Travel Offbeat): লেখক— অর্পিতা ভট্টাচার্য (Arpita Bhattacharya), অধ্যাপিকা, বাংলা বিভাগ, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ। শৈলীবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। বর্তমান আগ্রহ ও কাজ ভ্রমণ-সাহিত্য, ইকো-ট্যুরিজম, কালচার ট্যুরিজম, স্মৃতিকথা নিয়ে। এছাড়াও মুক্তগদ্য চর্চা ভালো লাগার জায়গা। এখন পর্যন্ত প্রকাশিত ৫টি গ্রন্থ এবং ৫০ টিরও বেশি প্রবন্ধ। সম্পাদনা করেছেন একটি বই এবং ধারাবাহিক সম্পাদনা করেন রবীন্দ্রনাথ টেগোর অ্যাডভান্সড রিসার্চ সেন্টারের জার্নাল।

Skip to content