মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: গৌতম চট্টোপাধ্যায়

আমার এক আত্মীয়, পরিবারের নবতম সদস্য হল বুবলি। বয়স মাত্র বছর দুয়েক। পুরো মাথা জুড়ে কোঁকড়ানো সিল্কি চুল। কারণে অকারণে দৌড়ে বেড়ায় সারা বাড়ি। মুখে তো কথার খই ফুটছে। হঠাৎ শুনলাম মা-বাবা তাকে নিয়ে পুরীতে যাচ্ছে বেড়াতে। কিছু ডাক্তারি পরামর্শের ব্যাপারে আমার কাছে এল। আমি একটা ইমার্জেন্সি ওষুধের লিস্ট করে দিলাম। এত ছোট বাচ্চা নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছে, তাই কিছু সাবধান বাণীও শুনিয়ে দিলাম। সপ্তাহখানেক বাদে ওরা ফিরে এল। বুবলিকে দেখে তো আমার চোখ কপালে! মাথায় একটাও চুল নেই, যাকে বলে ন্যাড়ামুন্ডি! জগন্নাথের কাছে নাকি মানত ছিল! তাই পুরীর মন্দিরে গিয়ে কেশ কর্তন করিয়ে এসেছে।

গরম পড়তে না পড়তেই ক্ষৌরকারদের উদ্যত ক্ষুরের তলায় কচিকাঁচাদের নতমস্তক। এ এক অতি পরিচিত দৃশ্য। মা-বাবাদের নির্দেশে মাথা মুড়িয়ে একেবারে মহাপ্রভুর ছাঁট। শিক্ষিত- অশিক্ষিত সবারই ধারণা— গরমকালে ফি বছর মাথা ন্যাড়া করে দিলে শিশুর নাকি গরম কম লাগে। মাথায় চর্মরোগ হয় না। কচি দুববোর মতো চুল গজায়! সত্যিই কি তাই?
চুল আমাদের দেহ ত্বকেরই অংশবিশেষ। ছড়িয়ে থাকে প্রায় সারা দেহ জুড়েই। ত্বকের নিচে থাকে কেশ কূপ বা হেয়ার ফলিকল। এর মধ্যেই থাকে চুলের মূল বা রুট, চুলের কাণ্ড থাকে বাইরে, যেটি আমরা দেখতে পাই। মাথার চুলের দুটি আবরণ, বাইরে কিউটিকল আর ভিতরে করটেক্স। ফলিকলের নিচে থাকে হেয়ার ম্যাট্রিক্স, যাতে থাকে নানা সজীব কোষ। এরাই চুলের বৃদ্ধি, পরিমাণ, রং ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে। চুলের পুষ্টি আসে ত্বকের পুষ্টি থেকে। যেহেতু চুল দেহত্বকেরই অংশ। কাজেই দেহের পুষ্টিই হল চুলের পুষ্টি। আলাদা করে এটা সেটা মাখলে চুলের জেল্লা বাড়তে পারে, কিন্তু পুষ্টি বাড়ে না।

মাথা ন্যাড়া করলে মাথায় গরম কম লাগে, মায়েদের মধ্যে এই ভুল ধারণাটি কারা ঢুকিয়েছিল কে জানে! আসলে ব্যাপারটা তো ঠিক উল্টো। অর্থাৎ ন্যাড়া মাথায় গরম বেশি লাগে। চুলের কাজ তো শুধু দেহের সৌন্দর্য বৃদ্ধি নয়। চুল দেহের সঙ্গে বাইরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, রোদের তাপ ও নানা ক্ষতিকর বিকিরণ (আল্ট্রা ভায়োলেট রে) থেকে দেহকে রক্ষা করে। কাজেই গরম ঠেকাতে মাথায় কিছুটা চুল রাখা অবশ্যই দরকার এবং আরও দরকার সেই চুলের নিয়মিত পরিচর্যা।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২: স্নানের আগে রোজ সর্ষের তেল মাখেন?

ডাক্তারের ডায়েরি, পর্ব-৩৫: শ্যুটিংয়ের মজার গল্প

গরমে ঘাম আর রাস্তার ধুলোবালিতে শিশুর মাথা হয়ে ওঠে চিটচিটে। তার উপর খুশকি, উকুন কিংবা ছত্রাকের উৎপাত হলে তো আর কথাই নেই! স্কুলে যাতায়াত শুরু করলে এই সমস্যাটা বাড়ে। অতএব সহজ উপায় হল, মস্তক মুণ্ডন করিয়ে দেওয়া। ‘গেল ল্যাঠা চুকে। নিজের নেড়ু মাথা নিয়ে যা খুশি করগে যা, আমি এবার টিভি খুলে সিরিয়াল দেখি’। মাফ করবেন, অনেক মায়েরাই কিন্তু এখন এমনটাই ভেবে থাকেন।
আরও পড়ুন:

ডায়াবিটিস ধরা পড়েছে? হার্ট ভালো রাখতে রোজের রান্নায় কোন তেল কতটা ব্যবহার করবেন? দেখুন ভিডিয়ো

মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা সহজে শিখে নাও Transformation of Sentences by changing the DEGREES of Adjectives

শিশু দেখলে অনেকই হামলে পড়েন আদর করার জন্য। বয়স্কদের মাথা থেকে এই সুযোগে উকুন ছড়িয়ে পড়তে পারে শিশুর চুলে। শিশুর মাথা চুলকোয়, তার নখ থেকে সেকেন্ডারি ইনফেকশন হয় চুলের গোড়ায়, ঘা দেখা দিতে পারে। চুল পড়েও যেতে পারে। শিশুর চুলে উকুনের উৎপাত মোটেও হেলাফেলার ব্যাপার নয়। বাজারে উকুন তাড়াবার নানা ওষুধ পাওয়া যায়। বারে বারে ব্যবহার করলে চুলের ক্ষতি হতে পারে। বরং এক মগ জলে দু-চামচ স্যাভলন লোশন মিশিয়ে পরপর তিনদিন মাথা ঘষলে দারুণ উপকার পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১: পৃথিবী খ্যাত ডালটন হাইওয়ে এই শহরকে ছুঁয়েছে আর্কটিক বৃত্ত তথা উত্তরমেরুর সঙ্গে

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১৯: দেখতে দেখতে ‘সদানন্দের মেলা’

গরমকালে শিশুদের মাথায় নানা ধরনের চর্মরোগ হয়, ফোঁড়া হয়, ঘামে নোংরা জমে ছত্রাকের সংক্রমণ হতে পারে। এর ফলে মাথা চুলকোবে, ঘা দেখা দেবে, দাদ হতে পারে। চুল ও মাথা নিয়মিত পরিষ্কার রাখলে কিন্তু এই বিপত্তি ঘটে না। ছত্রাকের জন্য কোট্রাইমাজল বা মাইকোনাজল লোশন চুলের গোড়ায় ব্যবহার করা যেতে পারে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে। তবে মাথায় বড় ধরনের ঘা দেখা দিলে ভালো করে ওষুধ লাগানোর জন্য মাথা ন্যাড়া করে ফেলাই ভালো। মাথা কেটে গেলে বা ফেটে গেলে ভালো করে সেলাই করার জন্য ন্যাড়া করার প্রয়োজন হতেই পারে।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩৭: মাছ বাজারের বর্জ্যই এখন মূল্যবান সামগ্রী প্রস্তুতের অন্যতম সেরা উপাদান হতে চলেছে

খাই খাই: একঘেয়ে কাতলা? স্বাদবদল করুন ‘কমলা কাতলা’ রেসিপিতে! রইল সহজ রেসিপি

মাথা কেটে বা ফেটে গেলে ভালো করে সেলাই করার জন্যই কিন্তু ন্যাড়া হওয়া, অন্য কোনও কারণে নয়। অন্যথায় বারে বারে ন্যাড়া হলে শিশুর নরম চুলের গোড়া অর্থাৎ রুট বা হেয়ার ফলিকল চিরকালের জন্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ফলে চুল আর নাও গজাতে পারে। অর্থাৎ ভালো চুল গজাবার আশায় বারে বারে মাথা কামালে ফল হবে একেবারে উল্টো, এ যেন শিব গড়তে বাঁদর! তাছাড়া আনস্টেরিলাইজড ক্ষুর বা ব্লেড থেকে এডস বা হেপাটাইটিস বি-এর মতো ভয়ংকর অসুখও শিশুর শরীরে রক্ত বাহিত হয়ে প্রবেশ করতে পারে। বিহার এবং উত্তর প্রদেশে এমন কয়েকটি ঘটনার কথা নজরে এসেছে। কাজেই নিতান্ত নিরুপায় না বলে শিশুর মাথা ন্যাড়া করবেন না বরং গরমে চুলটা ছেঁটে দিন বেশ ছোট করে, যাকে বলে কদম ছাঁট। আরেকটা কথা, মানসিক থাকলে, শিশুর মাথা ন্যাড়া না করে কিছুটা চুল কেটে নিবেদন করবেন আপনার ইষ্ট দেবতাকে। আর গরম এড়াতে যদি মাথা ন্যাড়া করতেই হয়, তবে শুধু শিশুর নয়, বাড়ির সবাই ন্যাড়ামুণ্ডি হয়ে একসঙ্গে বসে খোল করতাল বাজাবেন।
* এগুলো কিন্তু ঠিক নয় (Health Tips): ডাঃ অমিতাভ ভট্টাচার্য (Amitava Bhattacharrya), বিশিষ্ট স্বাস্থ্য বিজ্ঞান লেখক।

Skip to content